অদ্ভুত আঁধার এক

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই - প্রীতি নেই - করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয়
মহত্‍‌ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

কবি ঃ জীবনানন্দ দাশ



An Overwhelming Night


These days on earth reigns an overwhelming night
Those who claim to see most have no eye sight
And to advance ahead the world awaits advice
From those who know no love, no pity but vice.

The fox and the vulture devour the hearts
Of those who have deep faith on humanity
Of those who think no queer of truth or arts
And of those who dream of a world of sanity.


Poet : Jibanananda Das
Translated : S M Maniruzzaman

বাংলাভাষা পরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮)

হওয়া থাকা আর করা, এই তিন অবস্থাকে প্রকাশ করে ক্রিয়াপদে। আমি ধনী, তুমি পণ্ডিত-- এ কথা ইংরেজিতে বলতে গেলে এর সঙ্গে "হওয়া' ক্রিয়াপদ যোগ করতে হয়, বাংলায় সেটা ঊহ্য থাকে। "রাস্তাটা সোজা', "পুকুরটা গভীর', যখন বলি তখন সেটাতে তার নিত্য অবস্থা জানায়। কিন্তু "বর্ষায় পুকুর ঘোলা হয়েছে' এটা আকস্মিক অবস্থা, তাই হওয়ার কথাটা তুলতে হয়। ওর লোভ হয়েছে, মনে হচ্ছে ওর জ্বর হবে-- বাক্যগুলিও এইরকম।

সাবেক বাংলায় বিশেষ্য বা সর্বনাম শব্দ-সহযোগে ইংরেজি is ও are-এর অনুরূপ প্রয়োগ পাওয়া যায় : তুমি কে বটো, সে কে বটে, আমি রাজার ঝিয়ারি বটি। অচেতনবাচক শব্দেও চলত, যেমন : ঐ গাছটা কী বটে, এই নদী গঙ্গাই বটে। "বটে' শব্দটা এখনো ভাষায় আছে, বিশেষ ঝোঁক দেবার জন্যে, যেমন : লোকটা ধনী বটে। আবার ভঙ্গীর কাজেও লাগে, যেমন : বটে, চালাকি পেয়েছ! "বটে'র সঙ্গে "কিন্তু'র যোগ হলে ভঙ্গীটা আরও জমে, যেমন : উনি সর্দারি করেন বটে কিন্তু টের পাবেন। ইংরেজিতে স্বভাব বা অবস্থা বোঝাতে isবা are ব্যতীত বিশেষ্যের গতি নেই, বাংলায় না নয়। ইংরেজিতে বলাই চাই এন ভড় রতলন, কিন্তু বাংলায় যদি বলি "সে খোঁড়া বটে' তা হলে হয় বোঝাবে, তার খোঁড়া অবস্থাটা একটা বিশেষ আবিষ্কার, নয় ওর সঙ্গে একটা অসংগত ব্যাপারের যোগ আছে। যেমন : ও খোঁড়া বটে কিন্তু দৌড়য় খুব। কিংবা সন্দেহের বিদ্রূপ প্রকাশ করে : তুমি খোঁড়া বটে! অর্থাৎ, খোঁড়া নও যে তা প্রমাণ করতে পারি।

বাংলায় থাকার কথাটা যখন জানাই তখন বলি-- আছি বা আছে, ছিলে ছিল বা ছিলুম। "আছিল' শব্দেরই সংক্ষেপ "ছিল'। কিন্তু ভবিষ্যতের বেলায় হয় "থাকব'। বাংলায় ক্রিয়াপদের রূপ প্রধানত এই থাকার ভাবকে আশ্রয় করে। করেছে করছে করেছিল করছিল-- শব্দগুলো "আছি' ক্রিয়াপদেক ভিত্তি ক'রে স্থিতির অর্থকেই মুখ্য করেছে। সংস্কৃত ভাষায় এটা নেই, গৌড়ীয় ভাষায় আছে। হিন্দিতে বলে "চলা থা', চলেছিল। কাজটা যদিও চলা, তবু থা শব্দে বলা হচ্ছে, চলার অবস্থাতে স্থিতি করেছিল। গতিটা যেন স্থিতির উপরেই প্রতিষ্ঠিত।

যে কাজকে নির্দেশ করা হচ্ছে প্রধানত সেই কাজের মূল ধাতুকে দিয়েই ক্রিয়াপদের গড়ন। "খা' ধাতুতে খাওয়া বোঝায়, খাওয়া কাজের সমস্ত ক্রিয়ারূপ এই ধাতুর যোগেই তৈরি। কিন্তু বাংলা ভাষায় অনেকস্থলে কার্যটা ক্রিয়ার রূপ ধরে নি। ক্ষুধা পাওয়া, তৃষ্ণা পাওয়া, প্রতিদিনের ঘটনা; অথচ বাংলায় সেটা ক্রিয়ারূপ নেয় নি, বিশেষ্যের সঙ্গে জোড়া লাগিয়ে বলতে হয় : ক্ষুধা পেল, তৃষ্ণা পেল। হওয়া উচিত ছিল ক্ষুধিল' "তৃষিল', কাব্যে এইরকম ক্রিয়ারূপের কোনো বাধা নেই। কিন্তু গদ্যবাংলায় ক্রিয়াপদকে অনেক স্থলে গোটা বিশেষ্যপদের ভার বয়ে বেড়াতে হয়।

বাংলায় দুটো ক্রিয়াপদ জুড়ে ক্রিয়াবিশেষণ গড়ার একটা রীতি আছে। তাতে যে ইঙ্গিতের ভাষা তৈরি হয়েছে তার ভাবপ্রকাশের শক্তি অসাধারণ। সামান্য এই কথাটা "রয়ে বসে কাজ করা' যা বলে তা কোনো বাঁধা সংস্কৃত শব্দে বলাই যায় না। "উঠেপ'ড়ে "উঠেহেঁটে' কিংবা "নেচেকুঁদে' বেড়ানোতে যে ফুর্তি প্রকাশ পায় সেটার ঠিক উপযুক্ত শব্দ অভিধানে খুঁজে পাওয়া যায় না। এদের স্বজাতীয় শব্দ : তেড়েফুঁড়ে কেটেছেঁটে বেঁচেবর্তে রয়েসয়ে হেসেখেলে। এমন আরও বিস্তর আছে। অনেক স্থলে ঐ জোড়া শব্দের দুটিতে অর্থের সাম্য থাকে না। বস্তুত ওগুলো শব্দযোজনার একরকম খেপামি। "বয়েছেয়ে দেখা'য় যা বলা হচ্ছে তার সঙ্গে বাওয়া এবং ছাওয়ার কোনো সম্পর্কই নেই। যখন বলি "নেড়েচেড়ে দেখতে হবে' তখন "নেড়ে' শব্দের সহচরটিকে ব্যবহার করা হয় অর্থহীন বাটখারার মতো ওজন ভারি করবার জন্যে। চেয়েচিন্তে কেঁদেকেটে : এরা আছে অনুপ্রাসের গাঁঠ বাঁধার কাজে। এঁটেসেঁটে খেটেখুটে খেয়েদেয়ে ঠেলেঠুলে : এরা ধ্বনির পুনরাবৃত্তিতে মনকে ঠেলে দেবার কাজ করে।

আর-একরকম ক্রিয়াবিশেষণ আছে ক্রিয়া পদকে দুনো করে নিয়ে। যেমন,"জ্বর হবে হবে' কিংবা "জ্বর জ্বর করছে'। মনটা "পালাই পালাই' করে। এর মধ্যে খানিকটা অনিশ্চয়তা অর্থাৎ হওয়ার কাছাকাছি ভাব আছে। "লড়াই লড়াই খেলা' সত্যিকার লড়াই নয় কিন্তু যেন লড়াই। "হতে হতে হল না' অর্থাৎ হতে গিয়ে হল না। এতে যেমন জোর কমায়, আবার কোনো স্থলে জোর বাড়ায় : দেখতে দেখতে জল বেড়ে গেল, হাতে হাতে ফল পাওয়া। সরে সরে যাওয়া, চলে চলে ক্লান্ত, কেঁদে কেঁদে চোখ লাল, পিছু পিছু চলা, কাছে কাছে থাকা : এই দ্বিত্বে নিরন্তরতার ভাব পাওয়া যায়, কিন্তু একটাকা নিরন্তরতা নয়, এর মধ্যে একটা বারংবারত্ব আছে। "পাতেপাতেই মাছের মুড়ো দেওয়া হয়েছে' বললে মনে হয় সেটা যেন একে একে পরে পরে গণনীয়। "পাথরটা পড়ি পড়ি করছে', কোনো কালেই হয়তো পড়বে না, কিন্তু প্রত্যেক মুহূর্তে বারে বারে তার ভাবখানা পড়বার মতো। "আপনি আপনিই তিনি বকে যাচ্ছেন' বললে কেবল যে স্বগত বকা বোঝায় তা নয়, বোঝায় পুনঃ পুনঃ বকা। এরকম ভাবব্যঞ্জনা কোনো স্পষ্টার্থক বিশেষণের দ্বারা সম্ভব নয়। এ যেন সিনেমায় ছবি নেওয়ার প্রণালীতে পুনঃ পুনঃ অনুভূতির সমষ্টি।

ক্রিয়ার বিশেষণে অর্থহীন ধ্বনি সম্বন্ধে "বাংলা শব্দতত্ত্ব' বইখানিতে অনেক দৃষ্টান্ত দেখিয়েছি, যেমন : ফস্‌ ক'রে, চট্‌ ক'রে, ধুপ্‌ ক'রে, ধাঁ ক'রে, সোঁ ক'রে, ঢ্যাঁচ করে দেওয়া, গ্যাঁট হয়ে বসা, ঢিপ করে প্রণাম করা। এদের কোনো শব্দই সার্থক নয় অথচ অর্থবান শব্দের চেয়ে এরা স্পষ্ট করে মনে রেখাপাত করে। ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ্‌দুর, ধু ধু করছে মাঠ, থই থই করছে জল : এরা এক আঁচড়ের ছবি।

শারীরিক বেদনাগুলি ইংরেজি ভাষায় অর্থবান শব্দ দিয়ে বোঝানো হয়, যেমন : throbbing cutting gnawing pricking ইত্যাদি। এরকম দৈহিক উপলব্ধির ভিন্ন ভিন্ন শব্দ বাংলা ভাষায় নেই। বাংলার আছে ধ্বনি : দব্‌দব্‌ ঝন্‌ঝন্‌ টন্‌টন্‌ কন্‌কন্‌ কুট্‌কুট্‌ কর্‌কর্‌ তিড়িক্‌তিড়িক্‌ ঘিন্‌ঘিন্‌ ঝিম্‌ঝিম্‌ সুড়্‌সুড়্‌ সির্‌সির্‌। এই ধ্বনিগুলির সঙ্গে অনুভূতির কোনোই শব্দগত সাদৃশ্য নেই, তুব এই নিরর্থক শব্দগুলির দ্বারা অনুভূতির যেমন স্পষ্ট ধারণা হয় এমন আর কিছুতেই হতে পারে না।

বাংলা ক্রিয়াপদে আর-এক বিশেষত্ব আছে দুটো ক্রিয়ার জোড় দেওয়া, তাদের মধ্যে অর্থের সংগতি না থাকলেও, যেমন : হয়ে যাওয়া, হয়ে পড়া, হতে থাকা, হয়ে ওঠা; করে যাওয়া, করে ফেলা, করে তোলা, করে দেওয়া, করে চলা, করে ওঠা, করতে থাকা। হয়ে পড়া, করে ফেলা'র ভাবটা একই; একটা অক্রিয়, একটা সক্রিয়। আর-একরকম আছে বিশেষ্যের সঙ্গে ক্রিয়ার কিংবা দুই ক্রিয়ার অসংগত যোগ, যেমন : মার খাওয়া, উঠে পড়া, গাল দেওয়া, বসে যাওয়া, ঘুরে মরা, গিয়ে পড়া, খেয়ে বাঁচা, নেড়ে দেওয়া।

৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন

২১ শে ফেব্রুয়ারি।

“২১ শে ফেব্রুয়ারি কি হয়েছিল?

‘অনেক ফাইটিং হয়েছিল’

“কি নিয়ে জানি?”

‘ভাষা নিয়ে... ল্যাঙ্গুয়েজ প্রবলেম নিয়ে’

“ও আচ্ছা, তারপর?”

‘তারপর উই ওউন... জিতে গেছি... পত পত করে পতাকা উড়িয়েছি’

“কিসের পতাকা?”

‘স্বাধীন বাংলার পতাকা’

“ও .. আচ্ছা সেদিনের কারো নাম মনে আছে?”

‘অবশ্যই মনে আছে... বীরশ্রেষ্ঠ সালাম,রফিক,বরকত,জব্বার ... এরা ফ্রন্ট লাইনে ছিলো তাই আগে গুলি খাইসে’

“ওরা তো বীরশ্রেষ্ঠ না”

‘ও আচ্ছা আচ্ছা মনে পড়েছে...ভাষা-সৈনিক’

“উহু হয়নি... আচ্ছা, ভাষা-সৈনিক আর ভাষা-শহীদের পার্থক্যটা জানেন?”

‘জানতাম... ভুলে গেছি... সেইই কবে স্কুলে পড়ে এসেছি, মনে থাকে কেমনে? আপনাকে যদি এখন কোলা ব্যাঙ আর কুনো ব্যাঙের পার্থক্য জিজ্ঞেস করি, পারবেন?’

“না”

‘তাইলে? প্যাঁচান কেন?’

“সরি

‘ওকে ঠিকাছে... যাইগা’

“সরি সালাম সাহেব”

‘আমার নাম তো সালাম না’

“সরি রফিক সাহেব”

‘আরে, রফিক আমার নাম কে বলল?’

“সরি জব্বার সাহেব”

‘কি শুরু করেছেন?’

“আমি তো আপনাকে সরি বলছি না”

লেখক ঃ আরিফ আর হোসাইন

বাংলাভাষা পরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৭)

"হতে' আর "থেকে' এই দুটো শব্দ বাংলা অপাদানের সম্বল। প্রাচীন হিন্দিতে "হতে' শব্দের জুড়ি পাওয়া যায় "হুন্তো', নেপালিতে "ভন্দা', সংস্কৃত "ভবন্ত'। প্রাচীন রামায়ণে দেখেছি : ঘরে হনে, ভূমি হনে।

অপভ্রংশ প্রাকৃতের অপাদানে পাওয়া যায় : হোংতও হোংতউ। "থেকে' শব্দটার ধ্বনিসাদৃশ্য পাওয়া যায় নেপালিতে, যেমন : "তাঁহা দেখি = সেখান থেকে, মাঝ দেখি = মাঝ থেকে।' গুজরাটিতে আছে "থকি'। বাংলায় অপাদানে একটা গ্রাম্য প্রয়োগ আছে "ঠেঞে' (ঠাঁই হতে), যথা : তোমার ঠেঞে কিছু আদায় করতে হবে।

একদা পালি ব্যাকরণে পেয়েছিলুম "অজ্জতগ্‌গে' শব্দ। এর সংস্কৃত মূল "অদ্যতঃ অগ্রে'; "আজ থেকে' শব্দের সঙ্গে এর ধ্বনি ও অর্থের মিল আছে। জানি নে পণ্ডিতদের কাছে এ ইঙ্গিত গ্রাহ্য হবে কি না।

এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে। "পশুর থেকে মানুষের উৎপত্তি' এ কথা বলা চলে। কিন্তু "মানুষ থেকে গন্ধ বেরচ্ছে' বলি নে, বলি "মানুষের গা থেকে' কিংবা "কাপড় থেকে'। "বিপিন থেকে টাকা পেয়েছি' বলা চলে না, বলতে হয় "বিপিনের কাছ থেকে টাকা পেয়েছি'। এর কারণ, অচেতন পদার্থের নামের সঙ্গেই "থেকে' শব্দের সাক্ষাৎ সম্বন্ধ। তাই "মেঘ থেকে' বৃষ্টি নামে, "পাখি থেকে' গান ওঠে না, "পাখির কণ্ঠ থেকে' গান ওঠে।

কেবল "থেকে' নয়, "হতে' শব্দ-প্রয়োগেও ঐ একই কথা। "অযোধ্যা হতে' রাম নির্বাসিত হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন "রাবণের কাছ হতে'।

তুলনামুলক অর্থেও ব্যবহৃত হয় : হতে থাকে চেয়ে চাইতে।

অন্য প্রসঙ্গে সম্বন্ধপদের আলোচনা হয়ে গেছে। এক কালে বহুবচনে সম্বন্ধপদের "দিগের' শব্দের পূর্বেও সম্বন্ধের আর-একটা বিভক্তি থাকত, যেমন "আমারদিগের'।

বাংলা সম্বন্ধপদের একটা প্রত্যয় আছে "কার'। এর ব্যবহার সার্বত্রিক নয়। সময়-বাচক ক্রিয়াবিশেষণে "এখন' "তখন' "যখন' "কখন'এর সঙ্গে "কার' জোড়া হয়। বিশেষ কোনো "বেলাকার' "দিনকার' "রাতকার'ও চলে। "আজ' এবং "কাল' শব্দে কর্মকারকের বিভক্তির সঙ্গে যোগ ক'রে ওর ব্যবহার : আজকেকার কালকেকার। "পশুLl', অমুক "হপ্তাকার' বা "বছরকার' হয়, কিন্তু অমুক "মাসকার' কিংবা অমুক "ঘণ্টাকার' হয় না। "সকলকার' হয়, "সমস্তকার' হয় না। "সত্যকার' হয়, "মিথ্যাকার' হয় না। ভিতরকার বাহিরকার উপরকার নিচেকার এদিককার ওদিককার এধারকার ওধারকার-- চলে। ব্যক্তি বা বস্তুবাচক শব্দ সম্পর্কে এর ব্যবহার নেই। "জন' শব্দ যোগে সংখ্যাবাচক শব্দে "কার' প্রয়োগ হয় : একজনকার দুজনকার। কিন্তু "জন' ছাড়া মনুষ্যবাচক আর-কোনো শব্দের সঙ্গে ওর যোগ নেই। "ইংরেজকার' বলা চলে না।

৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন

বাংলাভাষা পরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৬)

বাংলা বিশেষ্যশব্দে সংস্কৃত বিশেষ্যশব্দের অনুস্বার বিসর্গ না থাকাতে কর্তৃকারকে চিহ্নের কোনো উৎপাত নেই। একেবারে নেই বলাও চলে না। কর্তৃপদে মাঝে মাঝে একারের সংকেত দেখা যায়, যেমন : পাগলে কী না বলে।

ভাষাবিজ্ঞানীরা এইরকম প্রয়োগকে তির্যকরূপ বলেন, এ যেন শব্দকে ত্যাড়চা করে দেওয়া। সব গৌড়ীয় ভাষায় এই তির্যকরূপ পাওয়া যায়, যেমন : দেবে জনে ঘোড়ে। বাংলায় বলি : দেবে মানবে লেগেছে, পাঁচজনে যা বলে। "ঘোড়ে' বাংলায় নেই, আছে "ঘোড়ায়' : ঘোড়ায় লাথি মেরেছে।

এই তির্যকরূপের ভিতর দিয়েই কারকের বিভক্তিগুলো তৈরি হয়েছে, আর হয়েছে বহুবচনের রূপ, যেমন : মানুষে থেকে, মানুষেরা মানুষেতে মানুষেদের। তোমা আমা যাহা তাহা থেকে: তোমার আমার যাহার তাহার তোমাকে আমাকে ইত্যাদি।

এই তির্যকরূপের কর্তৃকারক এক সময়ে সাধারণ অর্থে ছিল : আপনে শিখায় প্রভু শচীর নন্দনে, সোই আপনে করু সেবা। প্রাচীন রামায়ণে দেখা যায় নামসংজ্ঞায় প্রায় সর্বত্রই এই তির্যকরূপ, যেমন : সুমিত্রায়ে কৌশল্যায়ে মন্থরায়ে লোমপাদে। এখন এর ব্যবহারে একটা বিশেষত্ব ঘটেছে। "বানরে কলা খায়' বলে থাকি, "গোপালে সন্দেশ খায়' বলি নে। বাংলার কোনো কোনো অংশে তাও বলে শুনেছি। ময়মনসিংহগীতিকায় আছে : কোনো দোষে দোষী নয় আমার সোয়ামিজনে।

শ্রেণীবাচক কর্তৃপদে তির্যকরূপ দেখা যায়, অন্যত্র যায় না। "বাঘে গোরুটাকে খেয়েছে' বললে বোঝায় : বাঘজাতীয় জন্তুতে গোরুকে খেয়েছে, ভালুকে খায় নি। যখন বলি "রামে মারলে মরব, রাবণে মারলেও মরব', তখন বক্তিগত রামরাবণের কথা বলি নে; তখন রামশ্রেণীয় আঘাতকারী ও রাবণশ্রেণীয় আঘাতকারীর কথা বলা হয়।

"জন' শব্দের তির্যকরূপ "জনা'। একো জনা একো রকমের : এই "জনা' বিশেষ একজনের সম্বন্ধে নয়, জনগুলি এক-একটি শ্রেণীগত। "একহ' শব্দ থেকে হয়েছে "একো'।

মনে রাখা দরকার, কর্তৃপদের এই তির্রকরূপ জড় পদার্থে খাটে না। যখন বলি "মেঘে অন্ধকার করেছে' তখন বুঝতে হবে, "মেঘে' করণকারক।

গৌড়ীয় ভাষার প্রাচীন ইতিহাসে দেখা যায়, শব্দরূপে সম্বন্ধপদের চিহ্নই প্রাধান্য পেয়েছিল। অবশেষে প্রয়োজনমতো তারই উপরে স্বতন্ত্র কারকের বিভক্তি যোগ করতে হয়েছে। তারই নিদর্শন পাই কর্মকারকে "তোমারে' "শ্রীরামেরে' প্রভৃতি শব্দে। আধুনিক বাংলা পদ্যেও এই রে বিভক্তিরই প্রাধান্য। বাংলা রামায়ণ-মহাভারতে কর্মকারকে কে বিভক্তি অল্প। কবিকঙ্কণে দেখা গেছে : খাওয়াব তোমাকে হে নবাৎ আম্ররসে। অন্যত্র : উজানী নগরকে বাসিবে যেন হিম। এরকম প্রয়োগ বেশি নেই।

বাংলা নির্বস্তুক পদার্থ-বাচক শব্দের কর্মকারকে টা টি'র প্রয়োগবাহুল্য, যথা : "মৃত্যুভয় দূর করো', "চক্ষুলজ্জা ছাড়ো'। কিন্তু ওরই মধ্যে একটু বিশেষত্বের ঝোঁক দিয়ে বলা চলে : মৃত্যুভয়টা দূর করো, চক্ষুলজ্জাটা ছাড়ো। "মৃত্যুভয়টাকে দূর করো' বলতেও চোষ নেই।

মানুষের বা জন্তু-জানোয়ারের বেলায় কর্মকারকের চিহ্ন নিয়ে শৈথিল্য করা হয় নি : গোপাল যদি সন্দেশের যোগ্য হয় তা হলে গোপালকেই সন্দেশ দেওয়া যায়। কিন্তু যে বিশেষ্যপদ সাধারণবাচক তার বেলায় কর্মকারকের চিহ্ন কাজে লাগে না, যেমন : রাখাল গোরু চরায়। "গোরুকে' করায় না। ময়রা সন্দেশ বানায়, "সন্দেশকে' বানায় না।

বিপদ এই, একটা নিয়মের নাগাল যেই পাওয়া যায় অমনি জুটে যায় অনিয়মের দৃষ্টান্ত, যথা : যে গাড়োয়ান গোরুকে পীড়ন করে সে তো কশাইয়েরই খুড়তুতো ভাই। এখানে গোরু যদিও সাধারণ বিশেষ্য তবু এখানে কর্মকারকে কে বিভক্তি দ্বারা তার সঙ্গে বিশেষ বিশেষ্যের মতো ব্যবহার করা হল। ঝিকে মেরে বৌকে শেখানো : এখানে "ঝি' "বৌ' বিশেষ বিশেষ্য নয়, সাধারণ বিশেষ্য, তবু কে বিভক্তি গ্রহণ করেছে। এটা বেআইনি বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আইন আছে প্রচ্ছন্ন হয়ে। রাখালসাধারণ গোরু চরিয়ে থাকে, সেই তার ব্যাবসা। কিন্তু গাড়োয়ান গোরুকে যে পীড়ন করে সে একটা বিশেষ ঘটনা, না পিটোতেও পারত। বউয়ের উপকারের জন্যে শাশুড়ি যদি ঝিকে মারে সে একটা বিশেষ ব্যাপার, মারাটা সাধারণ ঘটনা নয়। ব'লে থাকি "ময়রা মালপো তৈরি ক'রে, "মালপোকে তৈরি করে' বলিই নে। কিন্তু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলা অসম্ভব নয় যে : ময়রা মালপোকে করে তোলে জুতোর সুকতলা। মালপো তৈরি করা সাধারণ ময়রা কর্তৃক সাধারণ ব্যাপার; সুকতলার মতো মালপো তৈরি করাটা নিঃসন্দেহ সাধারণ ব্যাপার নয়।

সর্বনামের প্রসঙ্গে করণকারকের নিয়ম পূর্বেই বলা হয়েছে। অন্য বিশেষ্যপদ সম্বন্ধেও প্রায় সেই একই কথা। দ্বারা দিয়ে ক'রে : এই তিনটে শব্দ করণকারকের প্রধান উপকরণ। সর্বনামের সঙ্গে অন্য বিশেষ্যপদের একটা প্রভেদ বিভক্তি নিয়ে; সর্বনামে কে, বিশেষ্যে এ। যথা : হাতে মারা ভালো ভাতে মারার চেয়ে, পৃথিবী পুরাবে তুমি ভরতের ধনে। সর্বনামে এই বিভক্তি বিকল্পে য়, যেমন : তোমায় দিয়ে। নিম্নের দৃষ্টান্তে কর্মকারকের চিহ্ন দেখি নে, যথা : মন দিয়ে শোনো, হাত দিয়ে খাও, লোক দিয়ে চিঠি পাঠাও। মন দিয়ে কাজ করো, বাজে কাজে হাত দিয়ো না : এখানে মনও নির্বস্তুক, হাতও তাই; এ হাত দৈহিক হাত নয়, এ হাত বলতে বোঝায় চেষ্টা। লোক দিয়ে চিঠি পাঠাও : এ লোক কোনো বিশেষ লোক নয়, সাধারণভাবে যাকে হোক কাউকে দিয়ে চিঠি পাঠাবার কথা হচ্ছে। ঘরামি দিয়ে চাল ছাইতে হবে : এখানে বিকল্পে "ঘরামিকে দিয়ে'ও হয়। কিন্তু ব্যক্তিবাচক বিশেষ্যে কর্মকারকে কে বিভক্তি থাকাই চাই : রামকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়ো। মানুষ ছাড়া অন্য জীববাচক বিশেষ্য সম্বন্ধেও এই নিয়ম, যেমন : বাঁদরকে দিয়ে চাষ করানো চলে না, ধোবার গাধাকে দিয়ে ঘোড়দৌড় খেলাবে না কি।

করণকারকে "ক'রে শব্দ অধিকরণরূপের সঙ্গে যুক্ত হয় : গ্লাসে ক'রে জল খাও, তুলিতে ক'রে আঁকো।

করণকারকে "দিয়ে' আর "ক'রে' শব্দে পার্থক্য আছে। "পাল্কিতে ক'রে' যাওয়া চলে, "পাল্কি দিয়ে' চলে না। খাবার বেলায় বলি "হাতে ক'রে খাও'; নেবার বেলায় বলি "হাত দিয়ে নাও'। একটাতে হাত হচ্ছে উপায়, আর-একটাতে হাত হচ্ছে আধার। পাল্কিতে "ক'রে' মানুষ যায়, কিন্তু যায় পথ "দিয়ে'। এখানে পাল্কি উপায়, পথ আধার। কিন্তু অর্থহিসাবে বিকল্পে হাত উপায়ও হতে পারে, আধারও হতে পারে। তাই "হাত দিয়ে খাও' বলাও চলে, "হাতে ক'রে খাও' বলতেও দোষ নেই।

ব'লে থাকি : বড়ো রাস্তা দিয়ে যখন যাবে গাড়িতে ক'রে যেয়ো। কোনো সাহেব যদি বলে "রাস্তায় ক'রে যাবার সময় গাড়ি দিয়ে যেয়ো', বুঝব সে বাঙালি নয়। লোক "দিয়ে' পাঠাব চিঠি, লোকটা উপায়; ব্যাগে "ক'রে' সে চিঠি নেবে, ব্যাগটা আধার।

৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন

সৃজনশীল প্রশ্ন - ১

কিছু সৃজনশীল প্রশ্ন -মার্ক -৪০
১/ একটি বাঁশের ১.৫ অংশ কাদায় আর এবং ২.৮ অংশ হচ্ছে পানিতে । যদি পানির উপর তৈল মাখা অবস্থায় বাঁশটির দৈর্ঘ্য ৪ মিটার হয় । এবং সৈয়দ মহসীন আলীর সাথে তিনটি বানর বাঁশের আগায় উঠে সিগারেট টানে ? তাহলে বের করতে হবে পুরো বাশটির দৈর্ঘ্য কত? ---১০
২/ লতিফের বাবা এক কেজি গাঁজার দাম নির্ধারণ করে দিলেন ৭০ টাকায় । বাজার থেকে ফেরার পথে লতিফ ২০০ গ্রাম দিয়ে তিনটি স্টিক ৩ ইঞ্ছি করে বানালেন । প্রত্যেক টানে .২ ইঞ্ছি করে শেষ হলে ২০ মিনিট পর গাঁজার পরিমান কত ? --১০
৩/ জনাব নাহিদ সাহেব একটি “হউক মাওলা” স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল , পরীক্ষার আগের রাতে সব ছাত্রদের হাতে প্রশ্ন তুলে দিয়ে । স্যারদের বলে দিলেন এইবার আপনাদের কষ্ট কম ।আপনাদের খাতা দেখতে হবে না । আমার সব স্টুডেন্ট সঠিক উত্তর দিয়েছে। তবুও ঐ স্কুলে চারজন ছাত্র ফেল করার কারন কি? ---১০
৪/ একটি মেয়ে সাতটি ছেলের সাথে প্রেম করে । একটি ছেলেকে দিনে সে ১৭ মিনিট করে টাইম দেন । তিনটি ছেলের বয়স গড়ে ২৪ বছর । এবং প্রথম ছেলেটির বাবা রাবিশ আলীর বয়স ২৯ হলে। মেয়েটির প্রেমর বয়স কত ? একটি টাক এবং ভুঁড়ির আলোকে বিশ্লেষণ কর ? ---১০

By : Merely Nayamul

একজন আদর্শ(!!!) ছাত্র হবার মিশন !

- সকালে ক্লাস শুরুর আগে ১০ মিনিট আগে উঠে, কোন রকমে হাত-মুখ ধুয়ে, শার্ট-প্যান্ট সামনে যা পাবেন সেটা পড়েই ক্লাস অভিমুখে দৌড় লাগান। যাওয়ার পথে, আশে পাশের কোন দোকানে চুইংগাম পাইলে, চুইংগাম চিবাইতে চিবাইতে দৌড়ান ... মিশন, “ম্যাডামের আগে ক্লাসে ঢুকা” [হলে/ হোস্টেলে থাকাদের জন্যে প্রযোজ্য]
-ঐ সব ব্যাগ-ট্যাগের ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে, প্যান্টের পিছনের পকেটে কোন রকমে একটা খাতা দুই ভাজ করে নিয়ে যেতে হবে ক্লাসে। মনে রাখবেন, আপনি কিন্তুক আদর্শ ছাত্র হবার মিশনে আছেন!! যদি মোবাইল প্যান্ট ইউজ করেন, তাইলে সাইডের পকেটেও নিতে পারেন খাতাটি।। মনের ভুলে(!!) বেশিরভাগ সময়েই কলম না নিয়ে যাবেন (আসলে, আপনার কলম আছে কিনা, আপনি নিজেই জানেন না!!)। অতঃপর, ক্লাসে কোন বন্ধুর কাছ থেকে কলম নিয়ে সেটা আজীবনের বাকির খাতায় তুলে দিবেন...।
- ক্লাসে ঢুকেই সামনের বেঞ্চের দিকে কোন রকম ভ্রুক্ষেপ না করে, শেষ দিকের কোন বেঞ্চে জায়গা আছে, সেটা শকুইন্না চোখ দিয়ে খুঁজে বের করে ফেলেন। এবং, যতটা পিছনের বেঞ্চে সম্ভব বসে পড়েন। আজকাল সবাই আদর্শ ছাত্র হবার প্রানপ্রন চেষ্টায় লিপ্ত বিধায়, শেষ দিকের বেঞ্চে বেশী দেড়িতে গেলে সিট পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়।
বি দ্রঃ কিছু স্যার ক্লাসে বেছে বেছে লাস্ট বেঞ্চের ব্রিলিয়ান্ট (!!) ছাত্রদের মগজের পরীক্ষা নেন। তাদের ক্লাসের ক্ষেত্রে, অবশ্যই অবশ্যই সামনের সারিতে স্থান করে নিতে হইবে নিজ দায়িত্বে।
- ক্লাসে সফল ভাবে ঘুমাতে হবে। সফল ভাবে মানে, এমন ভাবে ঘুমাতে হবে যাতে শিক্ষক ঘুণাক্ষরেও টের না পান। এ জন্যে আপনাকে স্যারের দিকে তাকিয়ে চোখ খোলা রেখে শরীরের সকল অঙ্গ-প্রতঙ্গকে ঘুমের রাজ্যে নিয়ে যাবার বিশেষ ক্ষমতা থাকা লাগবে। সেই সাথে, মেরুদণ্ড বাকা না করে ঘুমানো, জেগে জেগে ঘুমানো, পিছনের টেবিলে হেলান না দিয়ে ঘুমাতে পারা বিশেষ সক্ষমতা হিসেবে বিবেচ্য...
- মাঝে সাজে ঘুমের অতিশাহ্যে দুয়েকটা ক্লাস মিস হতেই পারে।
তবে খেয়াল রাখতে হবে, নিজের এটেন্ডেন্স টা যেনো ঠিক মত থাকে ! এ জন্যে আগে থেকেই প্রক্সিমেট ঠিক করে রাখা বাঞ্চনীয়।।
- সকাল বিকাল,ঘুরতে ফিরতে, খাইতে-খেলতে-পড়তে পড়তে, ডেটিং এর সময়,আউটপুট ডেলিভারির সময়ও সমানহারে ফেসবুকিং এ মত্ত থাকা একজন আদর্শ ছাত্রের এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচ্য!!!
- ক্লাসে কোন স্যার পড়া ধরলে এমন ভাবে তাকাতে হবে, যেন আপনি এই মাত্র পৃথিবীতে ল্যান্ড করেছেন। পৃথিবীর মানুষের ভাষা এখনো শিখতে পারেন নি।
- ক্লাসে সফলতার সাথে ফেসবুকিং করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
- এবং বছর শেষে ঠিকই পরীক্ষার আগে একটা কোপ দিয়ে, কোন রকমে একটা “পাস” দিয়া পরবর্তী ক্লাসে/ইয়ারে সফলভাবে গমন করা... এবং যথারিতি উপরের কাজগুলো সফল ভাবে ও অব্যাহতভাবে করে যাওয়া।
... এভাবেই আপনি হয়ে যাবেন একজন আদর্শ(!!) ছাত্র।

লেখক ঃ এ এন ফায়সাল আহমেদ

বাংলাভাষা পরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৫)

বাংলায় নির্দেশকশব্দরূপে প্রধানত ব্যবহৃত হয় : টি টা খানি খানা। ইংরেজিতে এর প্রতিরূপ the। ইংরেজিতে the বসে শব্দের পূর্বে, বাংলায় নির্দেশক শব্দ বসে শব্দের পরে, বস্তুবাচক বা জীববাচক শব্দের অনুষঙ্গে। যা বস্তু বা জীব-বাচক নয় স্থানবিশেষে তার সঙ্গেও যোগ হয়, যেমন : বেশি লজ্জাটা ভালো নয়, ওর হাসিটা বড়ো মিষ্টি। এখানে লজ্জা ও হাসিকে বস্তুর মতোই কল্পনা করে নেওয়া হয়েছে।

এক দুই তিন শব্দ সংখ্যাবাচক। ওদের সঙ্গে প্রায় নিত্যযোগ টি ও টা'র। ইংরেজিতে এ দস্তুর নেই। বাংলায় সংখ্যাবাচক শব্দ যখন সমাসে বাঁধা পড়ে তখন তাদের টি টা পড়ে খ'সে, যেমন : দশসের আটহাত পাঁচমিশলি। তা ছাড়া "জন' শব্দের সংযোগে টি টা চলে না। "একটি জন' বলি নে, "একটি মানুষ' বলেই থাকি।

আরও কয়েকটি নির্দেশক শব্দ আছে, যেমন : টু টুক্‌ টুকু গোছা গাছি। তেল জল ধুলো কাদা প্রভৃতি অনির্দিষ্ট-আকার-বাচক শব্দে সংখ্যাবাচক শব্দের ব্যবহার চলে না। "একটা তেল' "একটি ধুলো' বলি নে, কিন্তু "একটু তেল' "একটু ধুলো' বলেই থাকি। "অনেকটা জল' "অনেকটা ময়দা' বলে থাকি কিন্তু "অনেকটি' মাটি বা দুধ বলা চলে না। কেননা টা শব্দে ব্যাপকতা বোঝায়, টি শব্দে বোঝায় খণ্ডতা।

টু টুক্‌ টুকু : স্বল্পতাসূচক। সজীব পদার্থে এর ব্যবহার নেই। ছোটো গাধার বাচ্ছাকেও কেউ "গাধাটুকু' বলবে না, পরিহাস ক'রে "মানুষটুকু' বলা চলে।

সরু লম্বা জিনিসের সঙ্গে "গাছি' "গাছা'র ব্যবহার : দড়িগাছা বেতগাছা হারগাছা। দুই-একটা ব্যতিক্রম থাকতে পারে, যেমন "চুড়িগাছি'। লম্বায়-ছোটো জিনিসে চলে না; "গোঁফগাছি' কিছুতেই নয়। টুকু চলে ছোটো জিনিসে, কিন্তু গড়নওয়ালা জিনিসে নয়। "চুনটুকু' হয়, "পদ্মটুকু' হয় না; "আংটিটুকু' হয় না, "পশমটুকু' হয়। সন্নাসীঠাকুরের "রাগটুকু' প্রভৃতি অবস্তুবাচক শব্দেও চলে। "একটুক' হয়, কিন্তু "দুটুকু' তিনটুকু' হয় না। "ঐটুক্‌' শব্দের সঙ্গে "খানি' জোড়া যায়, "খানা' যায় না; "একটুখানি', কিন্তু "একটুখানা ' নয়। জীববাচক শব্দে খাটে না; "একটুক জীব' নেই কোথাও।

আরও কয়েকটি নির্দেশক পদ আছে যা শব্দের পূর্বে বসে। তারা সর্বনাম জাতের, যেমন : সেই এই ঐ।

৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন

বাংলাভাষা পরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৪)

বাংলা বিশেষ্যপদে বহুবচনের প্রভাব অল্পই। অধিকাংশ স্থলেই "সব' "গুলি' "সকল' প্রভৃতি শব্দ জোড়া দিয়ে কাজ চালানো হয়। এ ভাষায় সর্বনাম শব্দে বহুবচনের বিভক্তি যতটা চলে অন্যত্র ততটা নয়। বহুবচনে "মানুষরা' ব'লে থাকি অথচ "ঘোড়ারা' বলতে কানে ঠেকে, অথচ "ঘোড়াদের' বলা চলে। মোটের উপর এ কথা খাটে যে সচেতন জীবদের নিয়ে বহুবচনে রা এবং সম্বন্ধে ও কর্মকারকে দের চিহ্ন ব্যবহার হয়ে থাকে। "মোষেরা খুব বলবান জীব' বা "ময়ূরদের পুচ্ছ লম্বা' এটা নিয়মবিরুদ্ধ নয়। এই রা চিহ্ন সাধারণ বিশেষ্যে লাগে। বিশেষ বিশেষ্যে ওর প্রয়োগ কানে বাধে। বলতে পারি "ঐ মোষরা পাঁকে ডুবে আছে', কিন্তু "ঐ মোষগুলো পাঁকে ডুবে আছে' বললেই মানানসই হয়। "মোষরা' বললে মোষজাতিকে মনে আসে, "মোষগুলো' বললে মনে আসে বিশেষ মোষের দল।

"মানুষরা নিষ্ঠুরতায় পশুকে হার মানালো' ঠিক শোনায়, এও ঠিক শোনায় : কুলিগুলো নির্দয়ভাবে গাড়িতে বোঝা চাপিয়েছে। কিন্তু "মানুষগুলো পশুকে হার মানায়' অশুদ্ধ। সাধারণ বিশেষ্যে রা চলে কিন্তু বিশেষ বিশেষ্যে গুলো। "মানুষরা ওখানে জটলা করছে' বললে মনে হয় যেন জানানো হচ্ছে অন্য কোনো জীব করে নি। এখানে "মানুষগুলো' বললেই সংশয় থাকে না।

"টেবিলরা' "চৌকিরা' নিষিদ্ধ। জড়পদার্থের "গুলো' ছাড়া গতি নেই। আর-একটা শব্দ আছে, কথার পূর্বে বসে সমষ্টি বোঝায়, যেমন "সব' : সব চৌকি, সব জন্তু, সব মানুষ। কিন্তু এখানে এই শব্দ কেবলমাত্র বহুবচন বোঝায় না, সঙ্গে সঙ্গে একটা ঝোঁক দেয়। সব চৌকি সরিয়ে দাও, অর্থাৎ একটাও বাকি রেখো না। সব ভিখিরিই বাঙালি, অর্থাৎ নির্বশেষে বাঙালি। "সব' প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে "গুলো' প্রয়োগটা যোগ দিতে চায়, যেমন : সব চৌকিগুলোই ভাঙা, সব ভিখিরিগুলোই চেঁচাচ্ছে। এখানে "সব' বোঝাচ্ছে একান্ততা, আর "গুলো' বোঝাচ্ছে বহুবচন। বহুবচনে এক সময়ে "সব' ব্যবহৃত হত। কবিতায় এখনো দেখা যায়, যেমন : পাখিসব তোমাসব ইত্যাদি। আমরা বলি : কাফ্রিরা সব কালো। বহুবচনের রা বিভক্তির সঙ্গে জোড়া লাগে "সব' শব্দ : এরা সব গেল কোথায়। শুধু "এরা গেল কোথায়' বললেই চলে, কিন্তু "সব' শব্দের দ্বারা সমষ্টির উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এই "সব' শব্দ একবচনকে বহুবচন করে না, বহুবচনকে সুনির্দিষ্ট করে। "সবাই' শব্দে আরও বেশি জোর লাগে : এরা যে সবাই চলে গেছে, কিংবা, চৌধুরীদের সবাইকেই নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। "সব' শব্দের সমার্থক হচ্ছে "সকল' : এরা সকলেই চ'লে গেছে, কিংবা, চৌধুরীদের সকলকেই নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। কিন্তু "সকল' শব্দের প্রয়োগ "সব' শব্দের চেয়ে সংকীর্ণ।

এই প্রসঙ্গে আমাদের ভাষার একটা বিশেষ ভঙ্গীর কথা বলি। "সব' শব্দের অর্থে কোনো দূষণীয়তা নেই, "যত' সর্বনাম শব্দটাও নিরীহ। কিন্তু দুটোকে এক করলে সেই জুড়িশব্দটা হয়ে ওঠে নিন্দার বাহন। "মূর্খ' "কুঁড়ে' কিংবা "লক্ষ্মীছাড়া' প্রভৃতি কটুস্বাদ বিশেষণ ঐ "যত সব' শব্দটাকে বাহন ক'রে ভাষার যেন মুখ সিট্‌কোতে আসে, যথা : যত সব বাঁদর, কিংবা কুঁড়ে, কিংবা লক্ষ্মীছাড়া। এখানে বলা উচিত ঐ "যত' শব্দটার মধ্যেই আছে বিষ। "যত বাঁদর এক জায়গায় জুটেছে' বললেই যথেষ্ট অকথ্য বলা হয়। লক্ষ্য করবার বিষয়টা এই যে, "যত' শব্দটা একটা অসম্পূর্ণ সর্বনাম, "তত' দিয়ে তবে এর সম্পূর্ণতা। "তত' বাদ দিলে "যত' হয়ে পড়ে বেকার, লেগে যায় অনর্থক গালমন্দর কাজে।

বাংলা ভাষায় সর্বনামের খুব ঘটা। নানা শ্রেণীর সর্বনাম, যথা ব্যক্তিবাচক, স্থানবাচক, কালবাচক, পরিমাণবাচক, তুলনাবাচক, প্রশ্নবাচক।

"মুই' এক কালে উত্তমপুরুষ সর্বনামের সাধারণ ব্যবহারে প্রচলিত ছিল, প্রাচীন কাব্যগ্রন্থে তা দেখতে পাই। "আমহি' ক্রমশ "আমি' রূপ ধরে ওকে করলে কোণঠেসা, ও রইল গ্রাম্য ভাষার আড়ালে। সেকালের সাহিত্যে ওকে দেখা গেছে দীনতাপ্রকাশের কাজে, যেমন : মুঞি অতি অভাগিনী।

নিজের প্রতি অবজ্ঞা স্বাভাবিক নয় তাই ওকে সংকোচে সরে দাঁড়াতে হল। কিন্তু মধ্যমপুরুষের বেলায় যথাস্থানে কুণ্ঠার কোনো কারণ নেই, তাই "তুই' শব্দে বাধা ঘটে নি, নীচের বেঞ্চিতে ও রয়ে গেল। "তুহিঁ' "তুমি'-রূপে ভর্তি হয়েছে উপরের কোঠায়। এরও গৌরবার্থ অনেকখানি ক্ষয়ে গেল, বোধকরি নির্বিচার সৌজন্যের আতিশয্যে। তাই উপরওয়ালাদের জন্যে আরও একটা শব্দের আমদানি করতে হয়েছে, "আপহিঁ' থেকে "আপনি'। আইনমদে মধ্যমপুরুষের আসন ওর নয়, ওর অনুবর্তী ক্রিয়াপদের রূপ দেখলেই তার প্রমাণ হয়। "তুমি'র বেলায় "আছ'; "আপনি'র বেলায় "আছেন', এই শব্দটি যদি খাঁটি মধ্যমপুরুষ-জাতীয় হত তা হলে ওর অনুচর ক্রিয়াপদ হতে পারত "আপনি আছ' কিংবা "আছঁ'।

"আপনি' শব্দের মূল হচ্ছে সংস্কৃত "আত্মন্‌'। বাংলায় প্রথমপুরুষেও "স্বয়ং' অর্থে এর ব্যবহার আছে, যেমন : সে আপনিই আপনার প্রভু। আত্মীয়কে বলা হয় "আপন লোক'। হিন্দিতে সম্মানসূচক অর্থে প্রথমপুরুষ মধ্যমপুরুষ উভয়তই "আপ' ব্যবহৃত হয়।

বাংলা ভাষায় উত্তমপুরুষে "আম'-প্রত্যয়যুক্ত ক্রিয়াপদের ব্যবহার চলে, সে সম্বন্ধে কিছু বক্তব্য আছে। তার তিনরকম রূপ প্রচলিত : করলাম, করলুম, করলেম। "করলাম' নদিয়া হতে শুরু করে বাংলার পূর্বে ও উত্তরে চলে থাকে। এর প্রাচীন রূপ দেখেছি : আইলাঙ কইলাঙ। আমরা দক্ষিণী বাঙালি, আমাদের অভ্যস্ত "করলুম' ও "করলেম'। উত্তমপুরুষের ক্রিয়াপদে সানুনাসিক উকার পদ্যে এখনো চলে, যেমন : হেরিনু করিনু। কলকাতার অপভাষায় "করনু' "খেনু' ব্যবহার শোনা যায়। ক্রিয়াপদে এই সানুনাসিক উ প্রাচীন সাহিত্যে যথেষ্ট পাই : কেন গেলুঁ কালিন্দীর কূলে, দুকুলে দিলুঁ দুখ, মলুঁ মলুঁ সই। "করলেম' শব্দের আলোচনা পরে করা যাবে। কৃত্তিবাসের পুরাতন রামায়ণে দেখেছি "রাখিলোম প্রাণ'। তেমনি পাওয়া যায় "তুমি'র জায়গায় "তোমি'। বাংলা ভাষায় উকারে ওকারে দেনাপাওনা চলে এ তার প্রমাণ।

প্রথমপুরুষের মহলে আছে "সে' আর "তিনি'। রামমোহন রায়ের সময়ে দেখা যায় "তিনি' শব্দের সাধুভাষার প্রয়োগ "তেঁহ'। মেয়েদের মুখে "তেনার' "তেনরা' আজও শোনা যায়, ওটা "তেঁহ' শব্দের কাছাকাছি। প্রাচীন রামায়ণে "তাঁর'। "তাঁহার' শব্দ নেই বললেই হয়, তার বদলে আছে "তান' "তাহান'। ন'কারের অনুনাসিকটা বহুবচনের রূপ। তাই সম্মানের চন্দ্রবিন্দুতিলকধারী বহুবচনরূপী "তেঁহ' ও তিঁহো' (পুরাতন সাহিত্যে) হয়েছে "তিনি'। গৌরবে তার রূপ বহুবচনের বটে, কিন্তু ব্যবহার একবচনের। তাই পুনর্বার বহুবচনের আবশ্যকে রা বিভক্তি জুড়ে "তাঁহা' শব্দের রাস্তা দিয়ে "তাঁহারা' শব্দ সাজানো হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে যে ক্রিয়াপদটি তার দখলে তাতে আছে প্রাচীন ন'কারান্ত বহুবচনরূপ, যেমন "আছেন'। আমাদের সৌভাগ্যক্রমে পরবর্তী বাংলা ভাষায় ক্রিয়াপদে বহুবচনের চিহ্ন থাকলেও তার অর্থ হয়েছে লোপ। সংস্কৃতে বহুবচনে "পতন্তি' শব্দ আছে প্রথমপুরুষের পতন বোঝাতে। বাংলায় সেই অন্তি'র ন রয়েছে "পড়েন' শব্দে, কিন্তু এ ভাষায় "তিনি'ও পড়েন "তাঁরা'ও পড়েন। এই ন'কার-ধারী ক্রিয়াপদ কেবল "আপনি' আর "আপনারা', "তিনি' ও তাঁরা', এঁদের সম্মান রক্ষার কাজেই নিযুক্ত। প্রাচীন রামায়ণে এইরূপ স্থানে প্রায় সর্বত্রই দেখা যায় "পড়েন্ত' "দেখিলেন্ত' প্রভৃতি ন্ত-বিশিষ্ট ক্রিয়াপদ একবচনে এবং বহুবচনে, প্রথমপুরুষে।

সদ্যঅতীত কালের প্রথমপুরুষ ক্রিয়াপদে বিকল্পে ইল এবং ইলে প্রয়োগ হয়, যেমন : সে ফল পাড়ল, সে ফল পাড়লে। এই একার প্রয়োগ প্রাচীন পদাবলীতে দৈবাৎ দেখেছি, যথা : বিঁধিলে বাণ। কিন্তু অনেক দেখা গেছে ময়নামতীর গানে, যেমন : বিকল দেখি হাড়িপা রহিলে। এ সম্বন্ধে একটা সাধারণ নিয়ম এই যে, অচেতনবাচক শব্দের ক্রিয়াপদে "এ' লাগে না। অসমাপিকাতে লাগে, যেমন : পা ফুললে ডাক্তার ডেকো। "তার পা ফুলল' হয়, "পা ফুললে' হয় না। নির্বস্তুক শব্দ সম্বন্ধেও সেই কথা : তাঁর কলকাতায় যাওয়া ঘটল না। "ঘটলে না' হতে পারে না। এ ছাড়া নিম্নলিখিত কয়েকটি ক্রিয়াপদে "এ' খাটে না : এল গেল হল, প'ল (পড়ল), ম'ল (মরল)। দুই অক্ষরের ক্রিয়াপদমাত্রে এই ব্যতিক্রম হয় এমন যেন মনে করা না হয়। তার প্রমাণ : খেল নিল দিল শুল ধুল। ইতে-প্রত্যয়যুক্ত জোড়া ক্রিয়াপদে "এ' লাগে না, যেমন : করতে থাকল, হাসতে লাগল। কিন্তু ইয়া-প্রত্যয়যুক্ত জোড়া ক্রিয়াপদে লাগে, যেমন : সে হেসে ফেললে। এ ছাড়া আরও দুই-এক জায়গায় কানে সন্দেহ ঠেকে, যেমন : "ভোর বেলায় সে মরলে' বলি নে, "মরল'ই ঠিক শোনায়। কিন্তু "তিনি মরলেন' নিত্যব্যবহৃত। "কলকাতায় সে চললে' বলি নে, কিন্তু "তিনি চললেন' ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

প্রাচীন রামায়ণে দেখা গেছে প্রথমপুরুষের সদ্যঅতীত ক্রিয়াপদে প্রায় সর্বত্রই ক-প্রত্যয়-সমেত একার, যেমন : দিলেক লইলেক। আবার একারের সম্পর্ক নেই এমন দৃষ্টান্তও অনেক আছে, যেমন : চলিল সত্বর, পাঠাইল ত্বরিত। আধুনিক বাংলায় এইরূপ ক্রিয়াপদে কোথাও "এ' লাগে কোথাও লাগে না, কিন্তু অন্তস্থিত ক-প্রত্যয়টা খসে গেছে।

প্রথমপুরুষ ইল-প্রত্যয়যুক্ত ক্রিয়াপদে এই-যে একার প্রয়োগ, এরই সঙ্গে সম্ভবত "করলেম' "চললেম' শব্দের একার-উচ্চারণের যোগ আছে। করলেন (করিল তিনি), আর, করলেম (করিল আমি) : এক নিয়মে পাশাপাশি বসতে পারে। আরও একটা কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে, সে হচ্ছে স্বরবিকারের নিয়ম। ই'র পর আ থাকলে দুইয়ে মিলে "এ' হয় তার অনেক দৃষ্টান্ত মেলে। যেমন "ঈশান' থেকে "ঈশেন', "বিলাত' থেকে "বিলেত', "নিশান' থেকে "নিশেন'।

এক কালে "মুই' ভদ্র সমাজে ত্যাজ্য ছিল না। প্রাচীন রামায়ণে পাওয়া যায় "মুঞি নরপতি'। কর্মকারকে "মোকে', কোথাও বা "মোখে'। বহুবচনে "মোরা'। আজ "মোরা' রয়ে গেছে কাব্যলোকে। কবির কলমে "আমরা' শব্দের চেয়ে "মোরা' শব্দের চলন বেশি। প্রাচীন বাংলায় "আমরা' "তোমরা'র পরিবর্তে "আমিসব' "তুমিসব' শব্দের ব্যবহার প্রায়ই দেখা গেছে।

আমি তুমি আপনি তিনি : ব্যক্তিবাচক সর্বনাম, মানুষ সম্বন্ধেই খাটে। "সে' মেলমাত্র মানুষ নয় জন্তু সম্বন্ধেও খাটে, যেমন : কুকুরটাকে মারতেই সে চেঁচিয়ে উঠল। "সে' থেকে বিশেষণ শব্দ হয়েছে "সেই'। এর প্রয়োগ সর্বত্রই : সেই মানুষ, সেই গাছ, সেই গোরু। "এ' থেকে হয়েছে "এই'। "এ' বোঝায় কাছের বর্তমান পদার্থকে, "সে' বোঝায় অবর্তমানকে। সম্মানার্থে "এ' থেকে হয়েছে "ইনি'।

বাংলা ভাষার একটা বিশেষত্ব এই যে, সর্বনামে লিঙ্গভেদ নেই। ইংরেজিতে প্রথমপুরুষে she স্ত্রীলিঙ্গ, it ক্লীবলিঙ্গ। ইংরেজিতে যদি বলতে হয়, সে প'ড়ে গেছে, তবে সেই প্রসঙ্গে sheবা it বলাই চাই। বাংলায় ক্লীবলিঙ্গের নির্দেশ আছে, কিন্তু স্ত্রীলিঙ্গ পুংলিঙ্গের নেই। সে এ ও তিনি ইনি উনি : স্ত্রীও হয়, পুরুষও হয়। ক্লীবলিঙ্গে "সে' "এ' "ও' শব্দে নির্দেশক চিহ্ন যোগ করা চাই, যেমন : সেটা ওটা সেখানা ওখানা। বাংলা কাব্যে এই প্রথমপুরুষ সর্বনামে যখন ইচ্ছাপুর্বক লিঙ্গ নির্দেশ করা হয় না তখন ইংরেজি তর্জমা অসম্ভব হয়। "যে' সর্বনাম পদের সঙ্গে কোনো না কোনো বিশেষ্য ঊহ্য বা ব্যক্ত রূপে থাকেই। "যে গান গাচ্ছে' বলতে বোঝায়, যে মানুষ। অন্যত্র : যে ঘড়ি চলছে না, যে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

"যেই' শব্দের একটি প্রয়োগ আছে, তাতে "মুহূর্তে' বা "ক্ষণে' ঊহ্য থাকে, যথা : যেই এল অমনি চলে গেল, যেই দেখা সেই আর মুখে কথা নেই। এখানে "যেই আর সেই' শব্দের পিছনে ঊহ্য আছে "ক্ষণে'। অন্যত্র "যেই' বা "সেই' শব্দের প্রয়োগে ঊহ্য থাকে "মানুষ', যেমন : যেই আসুক সেই মার খাবে। "যাই' শব্দের সঙ্গে ঊহ্য থাকে দুটি বিশেষণের দ্বন্দ্ব, যেমন : সে যাই বলুক। অর্থাৎ, এটাই বলুক বা ওটাই বলুক, ভালোই বলুক বা মন্দই বলুক। আর-এক প্রকার প্রয়োগ আছে "যেই কথা সেই কাজ', অর্থাৎ কাজে কথায় প্রভেদ নেই--এখানে ই প্রত্যয় নিশ্চয়তা অর্থে ঝোঁক দেবার জন্যে।

"যে' অসম্পূর্ণার্থক সর্বনাম বিশেষণ, মানবার্থে তার পূরণ হয় "ও' এবং "সে' দিয়ে। অন্য জীব বা বস্তুর সম্বন্ধে যখন তার প্রয়োগ হয় তখন সেই বস্তু বা জীবের নাম তার সঙ্গে জুড়তে হয়, যেমন : যে পুকুর, যে ঘটি, যে বেড়াল। নির্বস্তুক শব্দে সেই নিয়ম, যেমন : যে স্নেহ শিশুর অনিষ্ট করে সে স্নেহ নিষ্ঠুরতা।

কখনো কখনো বাক্যকে অসম্পূর্ণ রেখে "যে' শব্দের ব্যবহার হয়, যেমন : যে তোমার বুদ্ধি। বাকিটুকু ঊহ্য আছে বলেই এর দংশনের জোর বেশি। বংলা ভাষায় এইরকম ঘোঁচা-দেওয়া বাঁকা ভঙ্গীর আরও অনেক দৃষ্টান্ত পরে পাওয়া যাবে।

মানুষ ছাড়া আর কিছুকে কিংবা সমূহকে বোঝাতে গেলে "যে' ছেড়ে "যা' ধরতে হবে, যেমন : যা নেই ভারতে (মহাভারতে) তা নেই ভারতে। কিন্তু "যারা' শব্দ "যা' শব্দের বহুবচন নয়, "যে' শব্দেরই বহুবচন, তাই ওর প্রয়োগ মানবার্থে। "তা' বোঝায় অচেতনকে, কিন্তু "তারা' বোঝায় মানুষকে। "সে' শব্দের বহুবচন "তারা'।

শব্দকে দুনো করে দেবার যে ব্যবহার বাংলায় আছে, "কে' এবং "যে' সর্বনাম শব্দে তার দৃষ্টান্ত দেখানো যাক : কে কে এল, যে যে এসেছে। এর পূরণার্থে "সে সে লোক' না বলে বলা হয় "তারা' কিংবা "সেই সেই লোক'। "যেই যেই লোক'এর ব্যবহার নেই। সম্বন্ধপদে "যার যার' "তার তার' মানবার্থে চলে। এইরকম দ্বৈতে বহুকে এক এক ক'রে দেখবার ভাব আছে। ভিন্ন ভিন্ন তুমি'কে নির্দেশ ক'রে "তুমি তুমি' "তোমার তোমার' বললে দোষ ছিল না, কিন্তু বলা হয় না।

যে বাক্যের প্রথম অংশে দ্বৈতে আছে "যে' তার পূরণার্থক শেষ অংশে সমগ্রবাচক বহুবচন-ব্যবহারটাই নিয়ম, যেমন : যে যে লোক, বা যাঁরা যাঁরা এসেছেন তাঁদের পান দিয়ো।

যত এত তত কত কত শব্দ পরিমাণবাচক। এদের মধ্যে "তত' শব্দ ছাড়া আর সবগুলিতে দ্বিত্ব চলে।

এখন তখন যখন কখন কালবাচক। "কখন্‌' শব্দ প্রায়ই প্রশ্নসূচক, সাধারণভাবে "কখন্‌' বলতে অনিশ্চিত বা দূরবর্তী সময় বোঝায় : কখন্‌ যে গেছে। কিন্তু "কখনো' প্রশ্নার্থক হয় না। প্রশ্নের ভাবে যখন বলি "সে কখনো এ কাজ করে' তখন "কি' অব্যয়-শব্দ ঊহ্য থাকে। দ্বিত্বে "কখনো' শব্দের অর্থ "মাঝে মাঝে'। "কখনোই' একটা "না' চায় : কখনোই হবে না।

"কখন্‌' শব্দের "কী খেনে' -ভঙ্গীওয়ালা রূপ কাব্যসাহিত্যে পাওয়া যায়।

"কভু' শব্দের অর্থও "কখনো'। এখন দৈবাৎ পদ্যে ছাড়া আর কোথাও কাজে লাগে না। ওর জুড়ি ছিল "তবু' শব্দটা, কিন্তু ওর সময়বাচক অর্থটা নেই। "তবু' শব্দের দ্বারা এমন কোনো সম্ভাবনা বোঝায় যেটা ঠিক উপযুক্ত বা আকাঙক্ষিত নয় : যদিও রৌদ্র প্রখর তবু সে ছাতা মাথায় দেয় না, আমি তো বারণ করেছি তবু যদি যায় দুঃখ পাবে। কালবাচক ক্রিয়াবিশেষণে বহুবচন বা কর্মকারক নেই। সম্বন্ধপদে : এখনকার তখনকার কখনকার, কোন্‌ সময়কার, কোন্‌ সময়টার। অধিকরণে : কোন্‌ সময়ে, যে সময়ে। পদ্যে "কোন্‌ খনে', গ্রাম্য ভাষায় "কী খেনে' এবং অধিকাংশ স্থলেই শুভ যে সময়ে। পদ্যে "কোন্‌ খনে', গ্রাম্য ভাষায় "কী খেনে' এবং অধিকাংশ স্থলেই শুভ অশুভ লক্ষণ-সূচনায় এর প্রয়োগ হয়। অপাদান : যখন থেকে, কোন্‌ সময় থেকে।

কালবাচক ক্রিয়াবিশেষণ আরও একটা বাকি আছে "কবে'। ওর দুটি জুড়ি ছিল : এবে যবে। তারা পদ্যে আশ্রয় নিয়েছে। "তবে' একদা ওদেরই দলে ছিল, কিন্তু এখন "তবু' শব্দের মতো সেও অর্থ বদলিয়েছে। একটা সম্ভাবনার সঙ্গে আর-একটা সম্ভাবনাকে সে জোড়ে, যেমন : যদি যাও তবে বিপদে পড়বে। তবে এক কাজ করো : "তবে' শব্দের পূর্ববর্তী ঊহ্য ব্যাপারের প্রসঙ্গে কোনো কাজ করার পরামর্শ।

এই প্রসঙ্গে "সবে' শব্দটার উল্লেখ করা যেতে পারে। বলে থাকি : সবে এইমাত্র চলে গেছে, সবে পাঁচটা বেজেছে। এখানে "সবে' অব্যয়, ওতে মাত্রা বোঝায়, সকল ক্ষেত্রেই পরিমাণের সীমা বোঝাতে তার প্রয়োগ : সবে পাঁচজন। সবে ভোর হয়েছে : অর্থাৎ সময়ের মাত্রা ভোরে এসে পৌঁচেছে। সেইরকম : সবে এক পোওয়া দুধ।

যেমন তেমন অমন এমন কেমন তুলনাবাচক। "কেমনে' শব্দের ব্যবহার পদ্যে করণকারকে। "কেমন' শব্দের দ্বৈতে সন্দেহ বোঝায় : কেমন কেমন ঠেকেছে। গা কেমন কেমন করছে : একটা অনির্দিষ্ট অসুস্থ ভাব। "কেমন' শব্দের সঙ্গে "যেন'-যোগে সংশয় ঘনীভূত হয়, আর সে সংশয়টা অপ্রিয়। লোকটাকে কেমন যেন ঠেকছে : অর্থাৎ ভালো ঠেকছে না। ভঙ্গীওয়লা "কেমন' শব্দটা আছে খোঁচা দেবার কাজে : কেমন জব্দ, কেমন মার মেরেছে, কেমন জুতো, কেমন ঠকানটাই ঠকিয়েছে।

অধিকরণের বাহনরূপে "এমনি' শব্দের ব্যবহার আছে : এমনিতেই জায়গা পাই নে। খোঁচা দেবার ভঙ্গীতেও এই শব্দটার যোগ্যতা আছে : এমনিই কী যোগ্যতা।

"যত' শব্দ তার জুড়ি হারালে টিটকারির কাজে লাগে সে কথা পূর্বেই বলেছি। "অত' কথাটারও তীক্ষ্ণতা আছে, যেমন : অত চালাকি কেন, অত বাবুগিরি তোমাকে মানায় না, অত ভালোমানুষি করতে হবে না।

এজাতীয় আরও দৃষ্টান্ত আছে, যথা : "যে' এবং "যেমন'। "সে' এবং "তেমন'এর সঙ্গে যদি বিচ্ছেদ ঘটানো যায় তবে মুখ বাঁকানোর ভঙ্গী আনে, যথা : যে মধুর বাক্য তোমার। "তেমন'এর সঙ্গ-বর্জিত "যেমন' শব্দটাও বদমেজাজি : যেমন তোমার বুদ্ধি।

এই ধরনেরই আর-একটা দৃষ্টান্ত মনে পড়ে : কোথাকার মানুষ হে। এ বাক্যটার চেহারা প্রশ্নেরই মতো, কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা রাখে না। এতে যে সংবাদ ঊহ্য আছে সে নিবাসঘটিত নয়, সে হচ্ছে লোকটার ধৃষ্টতার বা মূর্খতার পরিচয় নিয়ে। কোথাকার সাধুপুরুষ এসে জুটল : লোকটার সাধুতা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ হচ্ছে না।

"যেমতি' "তেমতি' পদ্যে আশ্রয় নিয়েছে। "সেইমতো' "এইমতো' এখনো টিঁকে আছে। কিন্তু "এর মতো' "তার মতো'র ব্যবহারটাই বেশি। করণকারকে রয়ে গেছে "কোনোমতে'। অথচ "কোনোমতো' বা "কোন্‌মতো' শব্দটা নেই।

"কেন' শব্দটা সর্বনাম। এর অর্থ প্রশ্নবাচক, এর রূপটা করণকারকের। ঘটনা ঘটল কেন : অর্থাৎ ঘটল কী কারণের দ্বারা। "কেনে বা' প্রাচীন কাব্যেও পড়েছি, গ্রাম্য লোকের মুখেও শোনা যায়।

কেন, কেন বা, কেনই বা। "লোকটা কেন কাঁদছে' এ একটা সাধারণ প্রশ্ন। "কেন বা কাঁদছে' বললে কান্নাটা যে ব্যর্থ বা অবোধ্য সেইটে বলা হল। কেন বা এলে বিদেশে : অর্থাৎ বিদেশে আসাটা নিষ্ফল। কেনই বা মরতে এখানে এলুম : এ হল পরিতাপের ধিক্কার। এর মধ্যে লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে, এই প্রয়োগগুলির সবগুলোই অপ্রিয়তাব্যঞ্জক। কেন তিনি তিব্বতি পড়ছেন তা নিজেই জানেন না। : এ সহজ কথা। যেই বলা হল "কেনই বা তিনি তিব্বতি পড়তে বসলেন' অমনি বোঝা যায়, কাজটা সুবুদ্ধির মতো হয় না।

"কেন' শব্দের এক বর্গের শব্দ "যেন' "হেন'। "যেন' সাদৃশ্য বোঝাতে। "হেন' শব্দের প্রয়োগ বিশেষণে, যথা : হেন রূপ দেখি নাই কভু, হেন কাজ নেই যা সে করতে পারে না, সে-হেন লোকও তেড়ে এল। হেন কাজ = এমন কাজ। সে-হেন = তার মতো।

"যেন' শব্দটাতে বিদ্রূপের ভঙ্গী লাগানো চলে : যেন নবাব খাঞ্জে খাঁ, যেন আহ্লাদে পুতুল, যেন কাত্তিকটি, যেন ডানাকাটা পরী। বাংলায় বিদ্রূপের ভঙ্গীরীতি অত্যন্ত সুলভ।

"তেন' শব্দের ব্যবহার লোপ পেয়েছে। "হেন' শব্দের অর্থ "মতো' কিংবা "এই-মতো'। এর সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যায় "তেন' শব্দের অর্থ "সেইমতো'। "হেন-তেন' জোড়া শব্দ এখনো চলিত আছে। হেন-তেন কত কী ব'কে গেল : অর্থাৎ, ব'কল কখনো এরকম কখনো সেরকম, অসংলগ্ন বকুনি। প্রাচীন বাংলায় দেখেছি "যেন কন্যা তেন বর'। এখানে "যেন' শব্দের "যে-হেন' অর্থ।

"যেন' শব্দটা "হেন' শব্দের জুড়ি। পদাবলীতে পাওয়া গেছে, "যেহ্ন' (যে-হেন)। বোঝা যায় এই "হেন' শব্দের যোগেই "যেন' শব্দ চেহারা পেয়েছে। আধুনিক বাংলায় "যেন' শব্দটা তুলনা-উপমার কাজেই লাগে, কিন্তু পুরাতন বাংলায় তার অর্থের বিকৃতি হয় নি। তখন তার অর্থ ছিল "যেমন' : যেন যায় তেন আইসে, যেন রাজা তেন দেশ।

"হেন' শব্দটা রয়ে গেছে ভাষার মহদাশ্রয় পদ্যে। কিন্তু "সে' কিংবা "এ' শব্দের যোগে এখনো চলে, যেমন : সে-হেন লোক। এই "হেন' শব্দের যোগে ঐ "সে' শব্দে অক্ষমতা বা অসম্মানের আভাস দেয়। যেমন : সে-হেন লোক দৌড় মারলে। "হেন' শব্দের যোগে "এ' শব্দে অসামান্যতা বোঝায়, যেমন : এ-হেন লোক দেখা যায় না, এ-হেন দুর্দশাতেও মানুষ পড়ে।

"কেন'র সঙ্গে "যে' যোগ করলে পরিতাপ বা ভর্ৎসনার ভঙ্গী আসে, যেমন : কেন যে মরতে আসা, কেন যে এতগুলো পাস করলে। "কী করতে' শব্দটারও ঐ-রকম ঝোঁক, অর্থাৎ তাতে আছে ব্যর্থতার ক্ষোভ।

শুধু "কী' শব্দের মধ্যেও এই রকমের ভঙ্গী। এই কাজে ওর সঙ্গে যোগ দেয় ই অব্যয় : কী চেহারাই করেছ, কী কবিতাই লিখেছেন, কী সাধুগিরিই শিখেছ। ঐ "কী' এর সঙ্গে "বা' যোগ করলে ঝাঁজ আরও বাড়ে। "কী বা'কে বাঁকিয়ে "কীবে' করলে ভঙ্গীতে আরও বিদ্রূপ পৌঁছয়। ই'র সহযোগিতা বাদ দিলে "কী' বিশুদ্ধ বিস্ময় প্রকাশের কাজে লাগে : কী সুন্দর তার মুখ।

সম্মান খর্ব করবার বিশেষ প্রত্যয় বাংলা ভাষায় যথেষ্ট পাওয়া গেল, সর্বনামের প্রয়োগেও বক্রোক্তি দেখা গেছে। কিন্তু শ্রদ্ধা বা প্রশংসা-প্রকাশের প্রয়োজনে ভাষায় কেবল একটা বিশেষ ভঙ্গী আছে "আহা' অব্যয় শব্দটার যোগে, যেমন : আহা মানুষটি বড়ো ভালো। করুণা প্রকাশেও এর ব্যবহার আছে। অথচ "আহামরি' শব্দের পরিণামটা ভালো হয় নি। গোড়ায় এর উদ্দেশ্য ভালোই ছিল, এখন এ শব্দটার যে প্রকৃত স্বভাব সেইটাই গেছে বিপরীত হয়ে। এটা হয়েছে বিদ্রূপের বাহন। ওটাকে আরও একটু প্রশস্ত ক'রে হল "আহা ম'রে যাই'; এর ঝাঁজ আরও বেশি। পদে পদে বাংলায় এই বাঁকা ভঙ্গীটা এসে পড়ে : ভা-রি তো পণ্ডিত, ম-স্ত নবাব। এদের কণ্ঠস্বর উৎসাহে দীর্ঘকৃত হয়ে গাল পাড়ে যথার্থ মানেটাকে ডিঙিয়ে। হাঁদারাম ভোঁদারাম বোকারাম ভ্যাবাগঙ্গারাম শব্দগুলোর ব্যবহার চূড়ান্ত মূঢ়তা প্রকাশের জন্যে। কিন্তু "সুবুদ্ধিরাম' "সুপটুরাম' বলবার প্রয়োজনমাত্র ভাষা অনুভব করে না। সবচেয়ে অদ্ভুত এই যে "রাম' শব্দের সঙ্গেই যত বোকা বিশেষণের যোগ, "বোকা লক্ষ্ণণ' বলতে কারও রুচিই হয় না।

"কি' যেখানে অব্যয় সেখানে প্রশ্নের সংকেত। ঊহ্য বিশেষ্যের সহযোগে বিশেষণে ওর প্রয়োগ আছে। তুমি কী করছ : অর্থাৎ "কী কাজ' করছ। আর-একটা প্রয়োগ বিস্ময় বোঝাতে, যেমন : কী সুন্দর। পূর্বেই বলেছি তীক্ষ্ণধার স্বরবর্ণ ই সঙ্গে না থাকলে এর সৌজন্য বজায় থাকে। বিশেষণ-প্রয়োগে "কী', যথা : কী কাজে লাগবে জানি নে। "কী' বিশেষণ শব্দে অচেতন বা নির্বস্তুক বা অনির্দিষ্ট বোঝায় : ওর কী দশা হবে, কী হ'তে কী হল। বিকল্প বোঝাতে ওর প্রয়োগ আছে, যেমন : কী রাম কী শ্যাম কাউকেই বাদ দেওয়া যায় না। "কোন্‌' বিশেষণ জড় চেতন দুইয়েই লাগে।

সর্বনামের কর্মকারকে সাধারণত কে বিভক্তি : আমাকে তোমাকে। "সে'র বেলায় "তাকে' কিংবা "সেটিকে' "সেটাকে'।

বাংলা সর্বনাম করণকারকে একটা বিভক্তির উপরে আর-একটি চিহ্ন জোড়া হয়। বিভক্তিটা সম্বন্ধপদের, যেমন "আমার', ওতে জোড়া হয় "দ্বারা' শব্দ : আমার দ্বারা। আর-একটা শব্দচিহ্ন আছে "দিয়ে'। তার বেলায় মূলশব্দে লাগে কর্মকারকের বিভক্তি : আমাকে দিয়ে।

"কী' শব্দের কারণকারকের রূপ : কিসে, কিসে ক'রে, কী দিয়ে, কিসের দ্বারা। অধিকরণণেরও রূপ "কিসে', যথা : এ লেখাটা কিসে আছে। এ-সমস্তই একবচনের ও অজীববাচকের দৃষ্টান্ত, এরা বহুবচনে হবে : এগুলোকে দিয়ে, সেগুলোকে দিয়ে, কোন্‌গুলোকে দিয়ে। অসম্মানে মানুষের বেলা হয়, নচেৎ হয় : এদের দিয়ে, তাদের দিয়ে, ওদের দিয়ে।

সাধারণত বাংলায় বিশেষণপদের বহুবচনরূপ নেই। ওদের অধিকৃত বিশেষ্য শব্দগুলিতে বহুবচনের ব্যবস্থা করতে হয়, যথা : বুনো পশুদের, পিতলের ঘটিগুলোর। বলা বাহুল্য "ঘটিদের' হয় না, "পশুদের' হয়। রা এবং দের বিভক্তি জড়বাচক শব্দের অধিকারে নেই। তার পক্ষে গুলো শব্দই বৈধ। অথচ গুলো অপর পক্ষের ব্যবহারেও লাগে। কিন্তু পরিমাণবাচক "এত' "তত' "যত' "কত' বিশেষণের সঙ্গে বহুবচন-বিভক্তি গুলো যুক্ত হয়। তা ছাড়া "এ" "সে' "যে" "ও' "ঐ' "সেই' "কোন্‌' শব্দের সঙ্গে বহুবচনে কর্তৃপদে গুলো ও কর্মকারকে বা সম্বন্ধে দের যোগ করা হয়।

বাংলা সর্বনামশব্দ-প্রয়োগে একটা খটকার জায়গা আছে।

"আমাকে তোমাকে খাওয়াতে হবে' এমন কথা শোনা যায়। কে কাকে খাওয়াবে তর্কটা পরিষ্কার হয় না। এমন স্থলে যিনি খাওয়াবার কর্তা তাঁকে সম্বন্ধ-আসনে বসালে কথাটা পাকা হয়। আর সেটা যদি ক্রিয়াপদের পূর্বেই থাকে তা হলে দ্বিধা মেটে। "আমাকে তোমার খাওয়াতে হবে' বাক্যটা স্পষ্ট। গোল বাধে বহুবচনের বেলায়। কেননা বহুবচনে সম্বন্ধপদের দের আর কর্মকারকের দের একই চেহারার। এর একমাত্র উপায় কে বিভক্তি দ্বারা কর্মকারককে নিঃসংশয় করা। "আমাদেরকে তোমাদের খাওয়াতে হবে' বললে নিশ্চিন্ত মনে নিমন্ত্রণে যাওয়া যায়। সম্বন্ধকারকের চিহ্নে কর্মকারকের কাজ চালিয়ে নেওয়া ভাষার অমার্জনীয় ঢিলেমি।

৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন

শিক্ষামন্ত্রী হারুন।


আমার স্কুলে, হারুন নামের এক বন্ধু ছিল... ওকে ক্লাসের সবাই মজা করে শিক্ষামন্ত্রী ডাকতো... কারণ সে সবাইকে উচিত শিক্ষা দিত
ওমুক জুনিয়র ছেলে বেয়াদপি করেছে? খালি হারুনরে বললেই হতো... থাপ্রায়ে থুপ্রায়ে সাইজ করে আসতো
অমুক মামু, ঝালমুড়ি কম দিয়েছে? হারুনরে বললেই হতো... যেয়ে তারেও শিক্ষা দিয়ে আসতো
মজার ব্যাপার তার মোবাইল নম্বর আমার কাছে “শিক্ষামন্ত্রী হারুন” নামে এখনও সেইভ করা আছে
মাঝে মাঝে কেউ চাঁদা চেয়ে ফোন করলে, হারুনকে এখনও ফোন দিয়ে বলি; ‘দোস্ত এরে একটু শিক্ষা দিয়ে দে’
...আমাদের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী সম্ভবত এরকম কিছু একটাই ভেবেছে নিজেকে
গতকাল সকালে এবং বিকালে, তার ২টা পৃথক পৃথক ডায়লগ দেখলাম;
(১) শিক্ষার মান আগে ছিলই না, এখন মানসম্পন্ন শিক্ষা হচ্ছে
(২) কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে “সেকেন্ড টাইম” পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগটা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে
... বুঝলাম না; ১ম পয়েন্ট সত্যি হলে তো আপনি নিজেই ধরা খেয়ে যাচ্ছেন। তারমানে আপনার মানসম্মত শিক্ষা নেই?
এখন এই পয়েন্ট কাউন্টার দেয়ার জন্য যদি বলেন, ‘হ্যা আমার সময় শিক্ষার মান ছিলো না কিন্তু আমি নিজ চেষ্টায় মানসম্মত শিক্ষা শিখে এসেছি’
... তাহলে তো ভাই আরো বড় প্রবলেম... কারণ, আপনি ২য় পয়েন্টে অন্য শিক্ষার্থীদের চেস্টা করার স্কোপটাও বন্ধ করে দিচ্ছেন
কেমন হলো না ব্যাপারটা?
শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে, এমন কোনও ‘উচিত সিদ্ধান্ত’ নিয়েন না যেন এই আগামী প্রজন্মকে বলতে হয়; I was born intelligent but the education system ruined me.

লেখক ঃ আরিফ আর হোসাইন

হাই আপেল, আর ইউ ভার্জিন?

ফেসবুকে প্রশ্ন প্রশ্ন খেলা চলতেসে। লাইক দিলেই প্রশ্ন। ভালো কথা। নতুন একটা প্রশ্নই নতুন দিগন্তের সূচনা করে। আমারেও কয়েকজন প্রশ্ন করেছে। প্রশ্নের ধরণ দেখেন
ফার্স্ট ক্রাশ কখন , ফেসবুকে কোন মেয়ের উপর ক্রাশ খাইছেন , লাইফে প্রথম কিস করছেন ইত্যাদি ইত্যাদি
বেশ মজার খেলা তাই না। হেল ইয়াহ। ক্রাশ মাশ কিস। এটা আরেকটা জিনিসও প্রকাশ করে। মানুষের পার্সোনাল আর সেক্স লাইফ নিয়ে বাঙ্গালীর অপার আগ্রহ। অমুকের ঘরে কি হইছে , অমুকের বৌ নাকি বন্ধ্যা , ওই মেয়ে ওইদিন রুম ডেট করছে, কার পর্দা ছেড়া ফাটা।

আমাদের ছেলে মেয়েদের সমস্ত আগ্রহ ওই ক্রাশ লাভ লাইফ
সেক্স লাইফ এইসব নিয়ে। জানিস শিউলি নাকি ভার্জিন না , তপু ইজ আ গ্রেট ফাকার , আল্লাহ জানিস না। সব আগ্রহ ঘুরে ফিরে ওই ভালোবাসা জি এফ ক্রাশ এইসবে আইসা থামে। ছেলে মেয়ে কেউ কারো চেয়ে কম বেহায়া না
প্রশ্ন আসলে দুই রকমের আছে। কামের প্রশ্ন আকামের প্রশ্ন। একদিন স্টিভ জবস নিজেকে প্রশ্ন করেন, এমন কোন মোবাইল কি বানানো যায়না , যেটা একদম বাটনলেস হবে। যার ফলাফল আজকের টাচস্ক্রিন স্মার্টফোন। যদিও জবস পুরোপুরি বাটনলেস করতে পারেননি। একটা বাটন রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে জবস একটাই আক্ষেপ করেন, আমার ব্যার্থতা আমি আইফোন কে পুরোপুরি বাটনলেস করতে পারেননি।

এইগুলারে বলে কামের প্রশ্ন। একটা প্রশ্ন একটা সৃষ্টির সূচনা করে। জাকারবার্গ প্রশ্ন করে , এমন কোন সেন্ট্রালাইজড কমিউনিকেশন বেজড ডাটাবেস তৈরি করা কি সম্ভব না যার মাধ্যমে একদল মানুষ ইন্টারনেটেই সোশাল যোগাযোগ করতে পারবে ?
যার ফলাফল আজকের ফেসবুক।

আর আমাদের প্রশ্ন হইল ক্রাশ কে, কিস কারে ,বেডে কে? ভারত আমেরিকার ছেলে মেয়েরা আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে , কেন মিল্কিওয়ে ,এর বাইরে কেন নয়? আমরা তখন মানুষের বাড়ির জানালায় কান পেতে প্রশ্ন করি ,এই শুনতো খাট নড়তেসে কিনা?

ভাগ্যিস আপেলটা নিউটনের সামনে পড়েছিল বলে আজ আমরা জানি গ্র্যাভিটি কি। আমাদের সামনে পড়লে প্রশ্ন করতাম ...হাই আপেল ,আর ইউ ভার্জিন?

লেখক ঃ ওয়ারিশ আজাদ নাফি

বাংলাভাষা পরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৩)


আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্র যতই বেড়ে চলেছে ততই দেখতে পাচ্ছি, আমাদের চলতি ভাষার কারখানায় জোড়তোড়ের কৌশলগুলো অত্যন্ত দুর্বল। বিশেষ্যকে বিশেষণ বা ক্রিয়াপদে পরিণত করবার সহজ উপায় আমাদের ভাষায় নেই বললেই হয়। তাই বাংলা ভাষার আপন রীতিতে নতুন শব্দ বানানো প্রায় অসাধ্য। সংস্কৃত ভাষায় কতকগুলো টুকরো শব্দ আছে যেগুলোর স্বতন্ত্র কাজ নেই, তারা বাক্যের লাইন বদলিয়ে দেয়। রেলের রাস্তায় যেমন সিগ্‌ন্যাল, ভিন্ন দিকে ভিন্ন রঙের আলোয় তাদর ভিন্ন রকমের সংকেত, সংস্কৃত ব্যাকরণের উপসর্গগুলো শব্দের মাথায় চড়া সেইরকম সিগ্‌ন্যাল। কোনোটাতে আছে নিষেধ, কোনোটা দেখায় এগোবার পথ, কোনোটা বাইরের পথ, কোনোটা নীচের দিকে, কোনোটা উপরের দিকে, কোনোটা চার দিকে, কোনোটা ডাকে ফিরে আসতে। "গত' শব্দে আ উপসর্গ জুড়ে দিলে হয় "আগত', সেটা লক্ষ্য করায় কাছের দিক; নির্‌ জুড়ে দিলে হয় "নির্গত', দেখিয়ে দেয় বাইরের দিক; অনু জুড়ে দিলে হয় "অনুগত', দেখিয়ে দেয় পিছনের দিক; তেমনি "সংগত' "দুর্গত' "অপগত' প্রভৃতি শব্দে নানা দিকে তর্জনী চালানো। উপসর্গ থাকে সামনে, প্রত্যয় থাকে পিছনে। তারা আছে একই শব্দের নানা অর্থ বানাবার কাজে। নতুবা শব্দ তৈরি করবার বেলায় তাদের নইলে চলে না।

শব্দগড়নের কাজে বাংলাতেও কতকগুলো প্রত্যয় পাওয়া যায়। তার একটার দৃষ্টান্ত অন, যার থেকে হয়েছে : চলন বলন গড়ন ভাঙন। এরই সহকারী আ প্রত্যয়, যার থেকে পাওয়া যায় বিশেষ্য পদে : চলা বলা গড়া ভাঙা। এই প্রত্যয়টা বাংলায় সবচেয়ে সাধারণ, প্রায় সব ক্রিয়াতেই এদের জোড়া যায়। এই আ প্রত্যয় বিশেষণেও লাগে, যেমন : ঠেলা গাড়ি, ভাঙা রাস্তা। কিন্তু তি দিয়ে একটা প্রত্যয় আছে যেটা বিশেষভাবে বিশেষণেরই, যেমন : চলতি গাড়ি, কাটতি মাল, ঘাটতি ওজন। মুশকিল এই যে, সব জায়গাতেই কাজে লাগাতে পারি নে, কেন পারি নে তারও স্পষ্ট কৈফিয়ত পাওয়া যায় না। "গড়তি টেবিল' কিংবা "কথা-কইতি খোকা' বলতে মুখে বাধে, এর কোনো সংগত কারণ ছিল না। কাজ চালাবার জন্যে অন্য কোনো প্রত্যয় খুঁজতে হয়, সব সময়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। যে টেবিল গড়া চলছে তাকে সংস্কৃতে বোধ হয় "সংঘটমান' বলা চলে, কিন্তু বাংলায় কিছু হাৎড়ে পাই নে। যে খোকা কথা কয় ইএ প্রত্যয়ের সাহায্যে তাকে "কথা-কইয়ে' বলা যেতে পারে। অথচ ঐ প্রত্যয় দিয়ে "হাসিয়ে' "কাঁদিয়ে' বলা নিষিদ্ধ। কাঁদার বেলায় আর-এক প্রত্যয় খুঁজে পাওয়া যায় উনে, "কাঁদুনে'। কিন্তু "হাসুনে' বললে হাসির উদ্রেক হবে। অথচ "নাচুনে' চলতে পারে। "দৌড়ুনে' কথার দরকার আছে কিন্তু বলা হয় না, কেউ যদি সাহস ক'রে বলে খুশি হব। "দ্রুতধাবনশীল ঘোড়া'র চেয়ে "জোরে-দৌড়ুনে ঘোড়া' কানে ভালোই শোনায়। এই শব্দগুলোর প্রত্যয়টাকে ঠিক উনে বলা চলবে না; "নাচুনে' শব্দের গোড়া হচ্ছে : নাচন + ইয়া = নাচনিয়া। বাংলা ভাষার প্রকৃতি ই এবং আ'কে উ এবং এ কার দিয়েছে, হয়ে উঠেছে "নাচুনে'। এই কথাটা মনে ক'রে কৌতুক লাগে যে, দুটো অসদৃশ স্বরবর্ণকে ঠেলে দিয়ে কোথা থেকে উ এবং এ যায় জুটে।

সংস্কৃতে প্রত্যয় নিয়ম মেনে চলে, বাংলায় প্রায়ই ফাঁকি দেয়। বেসুর-বিশিষ্টকে বলি "বেসুরা' (চলতি উচ্চারণ "বেসুরো'); সুর-বিশিষ্টকে বলি নে "সুরা' বা "সুরো', আর কী বলি তাও তো ভেবে পাই নে। "সুরেলা গলা' হয়তো বলে থাকি জানি নে, অন্তত বলতে দোষ নেই। বালি-বিশিষ্টকে বলি "বালিয়া', অপভ্রংশে "বেলে'; কিন্তু চিনি-বিশিষ্টকে বলব না "চিনিয়া' বা "চিনে', চিনদেশজ বাদামকে "চিনে বাদাম' বলতে আপত্তি করি নে।

অনা প্রত্যয়-যোগে হয় "পাও' থেকে "পাওনা', "গাও' থেকে "গাওনা'। কিন্তু "ধাও' থেকে "ধাওনা' হয় না। অন্য প্রত্যয় যোগে হতে পারে "ধাওয়াই'। "কুট' থেকে হয় "কোটনা'; "ফুট' থেকে "ফুটকি', হয়, "ফোটনা' হয় না। "বাঁটা থেকে "বাঁটনা' হয়; "ছাঁটা' থেকে "ছাঁটাই' হবে, "ছাঁটনা' হবে না।

সংস্কৃতে মৎ প্রত্যয় কোথাও "মান' কোথাও "বান' হয়, কিন্তু তার নিয়ম পাকা। সেই নিয়ম মেনে যেখানে দরকার "মান' বা "বান' লাগিয়ে দেওয়া যায়। সংস্কৃতে "শক্তিমান' বলব, "ধনবান' বলব; বাংলায় একটাকে বলব "জোরালো' আর-একটাকে "টাকাওয়ালা'। অন্য ভাষাতেও ভাষার খেয়াল ক্ষণে ক্ষণে দেখা দেয়, কিন্তু এতটা বাড়াবাড়ি কম। যেমন ইংরেজিতে আছে : হেল্‌থি ওয়েল্‌থি প্লাকি লাকি ওয়েটি স্টিকি মিস্টি ফগি। কিন্তু "কারেজি' নয়, "কারেজিয়স'। তবু একটা নিয়ম পাওয়া যায়। এক সিলেব্‌ল্‌'এর হালকা কথায় প্রায় সর্বত্রই বিশিষ্ট অর্থে y লাগে, বড়ো মাত্রার কথায় এই প্রত্যয় খাটে না।

পূর্বেই বলেছি বাংলা ভাষাতেও প্রত্যয় আছে, কিন্তু তাদের প্রয়োগ সংকীর্ণ, আর তাদের নিয়ম ও ব্যতিক্রমে পাল্লা চলেছে, কে হারে কে জেতে।

সংস্কৃতে আছে ত প্রত্যয়-যুক্ত "বিকশিত পুষ্প', বাংলায় "ফোঁটা ফুল'। বুক-ফাটা কান্না, চলু-চেরা তর্ক, মন-মাতানো গান, নুয়ে-পড়া ডাল, কুলি-খাটানো ব্যবসা : এই দৃষ্টান্তগুলোতে পাওয়া যায় আ প্রত্যয়, আনো প্রত্যয়। কাজ চলে, কিন্তু এর চেয়ে আর-একটু জটিল হলে মুশকিল বাধে। "অচিন্তিতপূর্ব ঘটনা' খাস বাংলায় সহজে বলবার জো নেই।

কিন্তু এ কথাও জেনে রাখা ভালো, খাস বাংলায় এমন-সব বলবার ভঙ্গী আছে যা আর কোথাও পাওয়া যায় না। শব্দকে দ্বিগুণ করবার একটা কৌশল কথ্য বাংলায় চলতি, কোনো অর্থবান শব্দে তার ইশারা দেওয়া যায় না। মাঠ ধূধূ করছে, রৌদ্র করছে ঝাঁঝাঁ : মানেওয়ালা কথায় এর ব্যাখ্যা অসম্ভব। তার কারণ, অর্থের চেয়ে ধ্বনি সহজে মনে প্রবেশ করে : উস্‌খুস্‌ নিস্‌পিস্‌ ফ্যাল্‌ফ্যাল্‌ কাচুমাচু শব্দের ধরাবাঁধা অর্থ নেই। তাদের কাছ থেকে যেন উপরিপাওনা আদায় হয়, তাতে ব্যাকরণী টাঁকশালের ছাপ নেই।

বাংলার আর-একরকম শব্দদ্বৈত আছে তাদের মধ্যে অর্থের আভাস পাই, কিন্তু তারা যতটা বলে তার চেয়ে আঙুল দেখিয়ে দেয় বেশি। সংস্কৃতে আছে "পতনোন্মুখ', বাংলায় বলে "পড়ো-পড়ো'। সংস্কৃতে যা "আসন্ন' বাংলায় তা "হব-হব'। সেইরকম : গেল-গেল যায়-যায়। সংস্কৃতে যা "বাষ্পাকুল' বাংলায় তা "কাঁদো-কাঁদো। সংস্কৃতে বলে "অবরুদ্ধস্বরে', বাংলায় বলে "বাধো-বাধো গলায়'। বাংলায় ঐ কথাগুলোতে কেবল যে একটা ভাব পাওয়া যায় তা নয়, যেন ছবি পাই। একটা শ্লোক বলা যাক--

যাব-যাব করে, চরণ না সরে,
ফিরে-ফিরে চায় পিছে,
পড়ো-পড়ো জলে ভরো-ভরো চোখ
শুধু চেয়ে থাকে নীচে।

ঠিক এরকম একটুকরো রেখালেখ্য এই বাধো-বাধো ভাষাতেই বানানো চলে। বাংলায় বর্ণনার ছবিকে স্পষ্ট করবার জন্যেই এই-যে অস্পষ্ট ভাষার কায়দা, এর কথা বাংলা শব্দতত্ত্ব গ্রন্থে ধ্বন্যাত্মক শব্দের আলোচনায় আরও বিস্তারিত করে বলেছি।

বাংলায় কোনো কোনো প্রত্যয় অর্থগত ব্যবহার অতিক্রম ক'রে এইরকম ইঙ্গিতের দিকে পৌঁচেছে, তার উল্লেখ করা যাক : কিপ্‌টেমো ছিব্‌লেমো ছেলেমো জ্যাঠামো ঠ্যাঁটামো ফাজ্‌লেমো বিট্‌লেমো পেজোমো হ্যাংলামো বোকামো বাঁদ্‌রামো গোঁড়ামো মাৎলামো গুণ্ডামো।

সংস্কৃতের কোন্‌ প্রত্যয়ের সঙ্গে এর তুলনা করব? ত্ব প্রত্যয় দিয়ে "কিপ্‌টেমো'কে কিপ্‌টেত্ব' বলা যেতে পারে। কিন্তু ত্ব প্রত্যয় নির্বিকার, ভালো-মন্দ প্রিয়-অপ্রিয় জড়-অজড়ে ভেদ করে না। অথচ উপরের ফর্দটা দেখলেই বোঝা যাবে, শব্দগুলো একেবারেই ভদ্রজাতের নয়। গাল-বর্ষণের জন্যেই যেন পাঁকের পিণ্ড জমা করা হয়েচে। ঐ মো বা আমো প্রত্যয়ের যোগে "বাঁদরামো' বলি, কিন্তু "সিংহমো' বলি নে। কিপ্‌টেমো' হল, "দাতামো' হল না। "পেজোমো' বলা চলে অনায়াসে, কিন্তু "সেধোমো' (সাধুত্ব) বলতে বাধে। একটা প্রত্যয় দিয়ে বিশেষ ক'রে মনের ঝাল মেটাবার উপায় বোধ করি আর-কোনো ভাষাতেই নেই।

আর-একটা প্রত্যয় দেখো, পনা: বুড়োপনা ন্যাকাপনা ছিব্‌লেপনা আদুরেপনা গিন্নিপনা। সবগুলোর মধ্যেই কটাক্ষপাত। ব্যাকরণের প্রত্যয়ের যেরকম ভেদনির্বিচার হওয়া উচিত, এ একেবারেই তা নয়। চণ্ডীমণ্ডপে বসে বিরুদ্ধ দলকে খোঁচা দেবার জন্যই এগুলো যেন বিশেষ করে শান-দেওয়া।

আনা প্রত্যয়টা দেখো : বাবুআনা বিবিআনা সাহেবিআনা নবাবিআনা মুরুব্বিআনা গরিবিআনা। বলা বাহুল্য, এর ভাবখানা একেবারেই ভালো নয়। ঐ যে "গরিবিআনা' শব্দটা বলা হয়েছে, ওর মধ্যেও কপট অহংকারের ভাণ আছে। যদি বলা যায় "সাধুআনা' তা হলে বুঝতে হবে সেটা সত্যিকার সাধুত্ব নয়।

এই জাতের আর-একটা প্রত্যয় আছে, গিরি। তার সঙ্গে প্রায় "ফলাতে' কথার যোগ হয় : বাবুগিরি গুরুগিরি সাধুগিরি দাতাগিরি। এতে ভাণ করা, মিথ্যে অহংকার করা বোঝায়।

আরও একটা প্রত্যয় দেখা যাক, অনি বা আনি : বকুনি ধমকানি ছিঁচ্‌কাঁদুনি শাসানি হাঁপানি নাকানি-চোপানি-চোবানি জ্বলুনি কাঁপুনি মুখ-বাঁকানি খ্যাঁকানি লোক-হাসানি ফোঁপানি গ্যাঙানি ভ্যাঙানি ঘ্যাঙানি খিঁচুনি ছট্‌ফটানি কুট্‌কুটুনি ফোস্‌ফোঁসানি। এর সবগুলিই গাল-দেওয়া শব্দ নয়, কিন্তু অপ্রিয়। হাসটা তো ভালো জিনিস, কিন্তু, আনি প্রত্য দিয়ে হল "লোকহাসানি', হাসির গুণটা গেল বিগড়িয়ে। ছাঁকুনি নিড়ুনি বিনুনি চাটনি শব্দ বস্তুবাচক, সেইজন্যে তাদের মধ্যে নিন্দার ঝাঁজ প্রবেশ করতে পারে নি।

ইয়া [ বিকারে "এ' ] প্রত্যয়টা যখন বস্তুসূচক না হয়ে ভাবসূচক হয়, তখন তার ইঙ্গিতে কোথাও সুখের বা শ্রদ্ধার আভাস পাব না। যেমন : নড়্‌বড়ে নিড়্‌বিড়ে খিট্‌খিটে কট্‌মটে টন্‌টনে কন্‌কনে মিন্‌মিনে প্যান্‌পেনে ঘ্যান্‌ঘেনে ভ্যাজ্‌ভেজে ভ্যাদ্‌ভেদে ম্যাজ্‌মেজে ম্যাড়্‌মেড়ে জব্‌জবে খস্‌খসে জ্যাল্‌জেলে। সামান্য কয়েকটা ব্যতিক্রম আছে, "জ্বল্‌জ্বলে' "টুক্‌টুকে'; সংখ্যা বেশি নয়।

এবার দেখা যাক উআ'র বিকারে "ও' প্রত্যয় : ঘেয়ো বেতো জ্বোরো নুলো টেকো জেঁকো গুঁফো কুনো বুনো পেঁকো, ফোতো (বাবু), রোথো খেলো ভেতো, খেগো (পোকায়)। এগুলোও সুবিধের নয়; হয় তুচ্ছ নয় পীড়াকর। ভাত যে খায় সে নিন্দনীয় নয়, কিন্তু কাউকে যদি বলি "ভেতো' তবে তাকে সম্মান করা হয় না। জীবমাত্রই খাদ্যপদার্থ ব্যবহার করে, সেটা দোষের নয়; কিন্তু কোনো-একটা খাদ্যের সম্পর্কে কাউকে যদি বলা হয় "খেগো' তা হলে বুঝতে হবে সেই খাদ্য সম্বন্ধে অবজ্ঞার কারণ আছে। যথাস্থানে যথাপরিমাণে জল উপাদেয়, কিন্তু যাকে বলি "জোলো' তার মূল্য বা স্বাদের সম্বন্ধে অপবাদ দেওয়া হয়।

মন্দত্ব বোঝাতে সংস্কৃতে দুঃ ব'লে একটা উপসর্গ আছে, কু'ও যোগ করা যায়। কিন্তু বাংলায় এই প্রত্যয়গুলোতে যে কুৎসাবিশিষ্ট অবমাননা আছে অন্য কোনো ভাষায় বোধ হয় তা পাওয়া যায় না।

এবার স্ত্রীলিঙ্গ প্রত্যয়ের আলোচনা ক'রে প্রত্যয়ের পালা শেষ করা যাক।

খাপছাড়াভাবে সংস্কৃতের অনুসরণে নী ও ঈ প্রত্যয়ের যোগে স্ত্রীলিঙ্গ বোঝাবার রীতি বাংলায় আছে, কিন্তু তাকে নিয়ম বলা চলে না। সংস্কৃত ব্যাকরণকেও মেনে চলবার অভ্যেস তার নেই। সংস্কৃতে ব্যাঘ্রের স্ত্রী "ব্যাঘ্রী', বাংলায় সে "বাঘিনী'। সংস্কৃতে "সিংহী'ই স্ত্রীজাতীয় সিংহ, বাংলায় সে "সিংহিনী'। আকারযুক্ত স্ত্রীবাচক শব্দ সংস্কৃত থেকে বাংলা ধার নিয়েছে, যেমন "লতা'; কিন্তু স্ত্রীলিঙ্গে আ প্রত্যয় বাংলায় নেই; সংস্কৃতে আছে জানি, এত বেশি জানি যে, আকারান্ত শব্দ দেখবামাত্র তাকে নারীশ্রেণীয় বলে সন্দেহ করি। বাংলাদেশের মেয়েদের "সবিতা' নাম দেখে প্রায়ই আশঙ্কা হয় "পিতা'কে পাছে কেউ এই নিয়মে মাতা ব'লে গণ্য করে। মেয়েদের নামে "চন্দ্রমা' শব্দেরও ব্যবহার দেখেছি, আর মনে পড়ছে কোনো দুর্যোগে ভগবান চন্দ্রমা স্ত্রীছদ্মবেশে বাঙালির ঘরেও দেখা দিয়েছেন, বাঙালির কাব্যেও অবতীর্ণ হয়েছেন। এ দিকে "নীলিমা' "তনিমা' প্রভৃতি পুংলিঙ্গ শব্দ আকারের টানে মেয়েদের নামের সঙ্গে এক মালায় গাঁথা পড়ে। "নিভা' নামক একটা ছিন্নমুণ্ড শব্দ "শরচ্চন্দ্রনিভাননা' থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যুক্ত হয়েছে বাঙালি মেয়েদের নামমালায় আকারের টিকিট দেখিয়ে।

স্ত্রীলিঙ্গের কোনো একটি বা একাধিক প্রত্যয় যদি নির্বিশেষে বা বাঁধা নিয়মে ভাষায় খাটত তা হলে একটা শৃঙ্খলা থাকত, কিন্তু সে সুযোগ ঘটে নি। বাংলায় "উট' হয়েতো "উটী', কিন্তু "মোষ' হয় না "মোষী', এমন-কি "মোষীনী'ও না--কী হয় বলতে পারি নে, বোধ করি "মাদী মোষ'। "হাতি' সম্বন্ধেও ঐ এক কথা, "নাতনী' বলি কিন্তু "হাতিনী' বলি নে। উট-হাতির চেয়ে কুকুর-বিড়াল পরিচিত জীব, "কুকুরী' "বিড়ালী' বললেই চলত, কিংবা "কুকুরনী' "বিড়ালনী'। বলা হয় না। মানুষ সম্বন্ধেও কেমন একটা ইতস্তত আছে-- "খোট্টানি' "উড়েনি' ব'লে থাকি, কিন্তু "পাঞ্জাবিনী' "শিখিনী' "মগিনী' বলি নে; "মাদ্রাজিনী'ও তদ্রূপ; "বাঙালিনী' বলি নে, "কাঙালিনী' বলে থাকি।

আত্মীয়তা সম্বন্ধেও নামগুলিতে স্ত্রী প্রত্যয়ের ছাপ আছে : দিদি মাসি পিসি শ্যালী শাশুড়ি ভাইঝি বোনঝি। "ননদ' শব্দে ইনী যোগ না করলেও তার প্রভাব সম্পূর্ণ থেকে যায়। জা শ্যালাজ প্রভৃতি শব্দে দীর্ঘ ঈকারের সমাগম নেই।

জাতঘটিত ব্যাবসাঘটিত নামে নী ইনী যথেষ্ট চলে : বাম্‌নী কায়েতনী। অন্য জাত সম্বন্ধে সন্দেহ আছে। "বদ্দিনী' কখনো শুনি নি। "বাগদিনী' চলে, "ডোমনী' "হাড়িনী'ও শুনেছি, "সাঁওতালনী' বললে খটকা লাগে না। পুরুতনী ধোবানী নাপতিনী কামারনী কুমোরনী তাঁতিনী : সর্বদাই ব্যবহার হয়। অথচ শেলাই ব্যাবসা ধরলেও মেয়েরা "দর্জিনী' উপাধি পাবে কি না সন্দেহ। যা হোক মোটের উপর বাংলায় স্ত্রীলিঙ্গে নী ইনী প্রত্যয়টারই চল বেশি।

একটা বিষয়ে বাংলাকে বাহাদুরি দিতে হবে। য়ুরোপীয় অনেক ভাষায়, তা ছাড়া হিন্দি হিন্দুস্থানি গুজরাটি মারাঠিতে, কাল্পনিক খেয়ালে বা স্বরবর্ণের বিশেষত্ব নিয়ে লিঙ্গভেদপ্রথা চলেছে। ভাষার এই অসংগত ব্যবহার বিদেশীদের পক্ষে বিষম সংকটের। বাংলা এ সম্বন্ধে বাস্তবকে মানে। বাংলায় কোনোদিন ঘুড়ি উড্ডীয়মানা হবে না, কিংবা বিজ্ঞাপনে নির্মলা চিনির পাকে সুমধুরা রসগোল্লার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করবে না। কিংবা শুশ্রূষার কাজে দারুণা মাথাধরায় বরফশীতলা জলপটির প্রয়োগ-সম্ভাবনা নেই।

এইখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি। সংস্কৃত ভাষার নিয়মে বাংলার স্ত্রীলিঙ্গ প্রত্যয়ে এবং অন্যত্র দীর্ঘ ঈকার বা ন'এ দীর্ঘ ঈকার মানবার যোগ্য নয়। খাঁটি বাংলাকে বাংলা বলেই স্বীকার করতে যেন লজ্জা না করি, প্রাচীন প্রাকৃত ভাষা যেমন আপন সত্য পরিচয় দিতে লজ্জা করে নি। অভ্যাসের দোষে সম্পূর্ণ পারব না, কিন্তু লিঙ্গভেদসূচক প্রত্যয়ে সংস্কৃত ব্যাকরণ কতকটা স্বীকার করার দ্বারা তার ব্যাভিচারটাকেই পদে পদে ঘোষণা করা হয়। তার চেয়ে ব্যাকরণের এই-সকল স্বেচ্ছাচার বাংলা ভাষারই প্রকৃতিগত এই কথাটা স্বীকার করে নিয়ে যেখানে পারি সেখানে খাঁটি বাংলা উচ্চারণের একমাত্র হ্রস্ব ইকারকে মানব। "ইংরেজি' বা "মুসলমানি' শব্দে যে ই-প্রত্যয় আছে সেটা যে সংস্কৃত নয়, তা জানাবার জন্যই অসংকোচ হ্রস্ব ইকার ব্যবহার করা উচিত। ওটাকে ইন্‌-ভাগান্ত গণ্য করলে কোন্‌ দিন কোনো পণ্ডিতাভিমানী লেখক "মুসলমানিনী' কায়দা বা "ইংরেজিনী' রাষ্ট্রনীতি বলতে গৌরব বোধ করবেন এমন আশঙ্কা থেকে যায়।

৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন

বাংলাভাষা পরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১২)

সাধু ভাষার সঙ্গে চলতি ভাষার প্রধান প্রভেদ ক্রিয়াপদের চেহারায়। যেমন সাধু ভাষার "করিতেছি' হয়েছে চলতি ভাষায় "করছি'।

এরও মূল কথাটা হচ্ছে আমাদের ভাষাটা হসন্তবর্ণের শক্ত মুঠোয় আঁটবাঁধা। "করিতেছি' এলানো শব্দ, পিণ্ড পাকিয়ে হয়েছে "করছি'।

এই ভাষার একটা অভ্যেস দেখা যায়, তিন বা ততোধিক অক্ষরব্যাপী শব্দের দ্বিতীয় বর্ণে হসন্ত লাগিয়ে শেষ অক্ষরে একটা স্বরবর্ণ জুড়ে শব্দটাকে তাল পাকিয়ে দেওয়া। যথা ক্রিয়াপদে : ছিট্‌কে পড়া, কাৎরে ওঠা, বাৎলে দেওয়া, সাঁৎরে যাওয়া, হন্‌হনিয়ে চলা, বদ্‌লিয়ে দেওয়া, বিগ্‌ড়িয়ে যাওয়া।

বিশেষ্যপদে : কাৎলা ভেট্‌কি কাঁক্‌ড়া শাম্‌লা ন্যাক্‌ড়া চাম্‌চে নিম্‌কি চিম্‌টে টুক্‌রি কুন্‌কে আধ্‌লা কাঁচ্‌কলা সক্‌ড়ি দেশ্‌লাই চাম্‌ড়া মাট্‌কোঠা পাগ্‌লা পল্‌তা চাল্‌তে গাম্‌লা আম্‌লা।

বিশেষণ, যেমন : পুঁচ্‌কে বোট্‌কা আল্‌গা ছুট্‌কো হাল্‌কা বিধ্‌কুটে পাৎলা ডান্‌পিটে শুট্‌কো পান্‌সা চিম্‌সে।

এই হসন্তবর্ণের প্রভাবে আমাদের চলতি ভাষায় যুক্তবর্ণের ধ্বনিরই প্রাধান্য ঘটেছে।

আরও গোড়ায় গেলে দেখতে পাই, এটা ঘটতে পেরেছে অকারের প্রতি ভাষার উপেক্ষাবশত।

সংস্কৃত ভাষার উচ্চারণের সঙ্গে বাংলা উচ্চারণ মিলিয়ে দেখলে প্রথমেই কানে ঠেকে অ স্বরবর্ণ নিয়ে। সংস্কৃত আ স্বরের হ্রস্বরূপ সংস্কৃত অ। বাংলায় এই হ্রস্ব আ অর্থাৎ অ আমাদের উচ্চারণে আ নাম নিয়েই আছে। যেমন : চালা কাঁচা রাজা। এ-সব আ এক মাত্রার চেয়ে প্রশস্ত নয়। সংস্কৃত আ'কারযুক্ত শব্দ আমরা হ্রস্বমাত্রাতেই উচ্চারণ করি, যেমন "কামনা'।

বাংলা বর্ণমালার অ সংস্কৃত স্বরবর্ণের কোঠায় নেই। ইংরেজি starশব্দের aসংস্কৃত আ, ইংরেজি stir শব্দের iসংস্কৃত অ। ইংরেজি ball শব্দের a বাংলা অ। বাংলায় "অল্পসল্প'র বানান যাই হোক, ওর চারটে বর্ণেই সংস্কৃত অ নেই। হিন্দিতে সংস্কৃত অ আছে, বাংলা অ নেই। এই নিয়েই হিন্দুস্থানি ওস্তাদের বাঙালি শাকরেদরা উচ্চ অঙ্গের সংগীতে বাংলা ভাষাকে অস্পৃশ্য বলে গণ্য করেন।

বাংলা অ যদিও বাংলাভাষার বিশেষ সম্পত্তি তবু এ ভাষায় তার অধিকার খুবই সংকীণ। শব্দের আরম্ভে যখন সে স্থান পায় তখনি সে টিঁকে থাকতে পারে। "কলম' শব্দের প্রথম বর্ণে অ আছে, দ্বিতীয় বর্ণে সে "ও' হয়ে গেছে, তৃতীয় বর্ণে সে একেবারে লুপ্ত। ঐ আদিবর্ণের মর্যাদা যদি সে অব্যাঘাতে পেত তা হলেও চলত, কিন্তু পদে পদে আক্রমণ সইতে হয়, আর তখনি পরাস্ত হয়ে থাকে। "কলম' যেই হল "কল্‌মি', অমনি প্রথম বর্ণের আকার বিগড়িয়ে হল ও। শব্দের প্রথমস্থিত অকারের এই ক্ষতি বারে বার নানা রূপেই ঘটছে, যথা : মন বন ধন্য যক্ষ হরি মধু মসৃণ। এই শব্দগুলিতে আদ্য অকার "ও' স্বরকে জয়গা ছেড়ে দিয়েছে। দেখা গেছে, ন বর্ণের পূর্বে তার এই দুর্গতি, ক্ষ বা ঋ ফলার পূর্বেও তাই। তা ছাড়া দুটি স্বরবর্ণ আছে ওর শত্রু, ই আর উ। তারা পিছনে থেকে ঐ আদ্য অ'কে করে দেয় ও, যেমন : গতি ফণী বধূ যদু। য ফলার পূর্বেও অকারের এই দশা, যেমন : কল্য মদ্য পণ্য বন্য। যদি বলা যায় এইটেই স্বাভাবিক তা হলে আবার বলতে হয়, এ স্বভাবটা সর্বজনীন নয়। পূর্ববঙ্গের রসনায় অকারের এ বিপদ ঘটে না। তা হলেই দেখা যাচ্ছে, অকারকে বাংলা বর্ণমালায় স্বীকার করে নিয়ে পদে পদে তাকে অশ্রদ্ধা করা হয়েছে বাংলাদেশের বিশেষ অংশে। শব্দের শেষে হসন্ত তাকে খেদিয়েছে, শব্দের আরম্ভে সে কেবলই তাড়া খেতে থাকে। শব্দের মাঝখানেও অকারের মুখোষ প'রে ওকারের একাধিপত্য, যথা : খড়ম বালক আদর বাঁদর কিরণ টোপর চাকর বাসন বাদল বছর শিকড় আসল মঙ্গল সহজ। বিপদে ওর একমাত্র রক্ষা সংস্কৃত ভাষার করক্ষেপে, যেমন : অ-মল বি-জন নী-রস কু-রঙ্গ স-বল দুর্‌-বল অন্‌-উপম প্রতি-পদ। এই আশ্রয়ের জোরও সর্বত্র খাটে নি, যথা : বিপদ বিষম সকল।

মধ্যবর্ণের অকার রক্ষা পায় য় বর্ণের পূর্বে, যথা : সময় মলয় আশয় বিষয়।

মধ্যবর্ণের অকার ওকার হয়, সে-যে কেবল হসন্ত শব্দে তা নয়। আকারান্ত এবং যুক্তবর্ণের পূর্বেও এই নিয়ম, যথা : বসন্ত আলস্য লবঙ্গ সহস্র বিলম্ব স্বতন্ত্র রচনা রটনা যোজনা কল্পনা বঞ্চনা।

ইকার আর উকার পদে পদে অকারকে অপদস্থ করে থাকে তার আরও প্রমাণ আছে। সংস্কৃত ভাষায় ঈয় প্রত্যয়ের যোগে "জল' হয় "জলীয়'। চলতি বাংলায় ওখানে আসে উআ প্রত্যয় : জল + উআ = জলুআ। এইটে হল প্রথম রূপ।

কিন্তু উ স্বরবর্ণ শব্দটাকে স্থির থাকতে দেয় না। তা বাঁ দিকে আছে বাংলা অ, ডান দিকে আছে আ, এই দুটোর সঙ্গে মিশে দুই দিকে দুই ওকার লাগিয়ে দিল, হয়ে দাঁড়ালো "জোলো'।

অকারে বা অযুক্ত বর্ণে যে-সব শব্দের শেষ সেই-সব শব্দের প্রান্তে অ বাসা পায় না, তার দৃষ্টান্ত পূর্বে দিয়েছি। ব্যতিক্রম আছে ত প্রত্যয়-ওয়ালা শব্দে, যেমন : গত হত ক্ষত। আর কতকগুলি সর্বনাম ও অব্যয় শব্দে, যেমন : যত তত কত যেন কেন হেন। আর "এক শো' অর্থের "শত' শব্দে। কিন্তু এ কথাটাও ভুল হল। বানানের ছলনা দেখে মনে হয় অন্তত ঐ কটা জায়গায় অ বুঝি টিঁকে আছে। কিন্তু সে ছাপার অক্ষরে আপনার মান বাঁচিয়ে মুখের উচ্চারণে ওকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, হয়েছে : নতো শতো গতো ক্যানো।

অকারের অত্যন্ত অনাদর ঘটেছে বাংলার বিশেষণ শব্দে। বাংলাভাষায় দুই অক্ষরের বিশেষণ শব্দ প্রায়ই অকারন্ত হয় না। তাদের শেষে থাকে আকার একার বা ওকার। এর ব্যতিক্রম অতি অল্পই। প্রথমে সেই ব্যতিক্রমের দৃষ্টান্ত যতগুলি মনে পড়ে দেওয়া যাক। রঙ বোঝায় যে শব্দে,

যেমন : লাল নীল শ্যাম। স্বাদ বোঝায় যে শব্দে, যেমন : টক ঝাল। সংখ্যাবাচক শব্দ : এক থেকে দশ; তার পরে, বিশ ত্রিশ ও ষাট। এইখানে একটি কথা বলা আবশ্যক। এইরকম সংখ্যাবাচক শব্দ কেবলমাত্র সমাসে খাটে, যেমন : একজন দশঘর দুইমুখো তিনহপ্তা। কিন্তু বিশেষ্য পদের সঙ্গে জোড়া না লাগিয়ে ব্যবহার করতে গেলেই ওদের সঙ্গে "টি' বা "টা', "খানা' বা "খানি' যোগ করা যায়, এর অন্যথা হয় না। কখনো কখনো বা বিশেষ অর্থেই প্রত্যয় জোড়া হয়, যেমন : একই লোক, দুইই বোকা। কিন্তু এই প্রত্যয় আর বেশি দূর চালাতে গেলে "জন' শব্দের সহায়তা দরকার হয়, যেমন : পাঁচজনই দশজনেই। "জন' ছাড়া অন্য বিশেষ্য চলে না; "পাঁচ গোরুই' "দশ চৌকিই' অবৈধ, ওদের ব্যবহার করা দরকার হলে সংখ্যাশব্দের পরে টি টা খানি খানা জুড়তে হবে, যথা : দশটা গোরুই, পাঁচখানি তক্তাই। এক দুই-এর বর্গ ছাড়া আরও দুটি দুই অক্ষরের সংখ্যাবাচক শব্দ আছে, যেমন : আধ এবং দেড়। কিন্তু এরাও বিশেষ্যশব্দ-সহযোগে সমাসে চলে, যেমন : আধমোন দেড়পোওয়া। সমাস ছাড়া বিশেষণ রূপ : দেড় আধা। সমাসসংশ্লিষ্ট একটা শব্দের দৃষ্টান্ত দেখাই : জোড়হাত। সমাস ছাড়ালে হবে "জোড়া হাত'। "হেঁট' বিশেষণ শব্দটি ক্রিয়াপদের যোগে অথবা সমাসে চলে : হেঁটমুণ্ড, কিংবা হেঁট করা, হেঁট হওয়া। সাধারণ বিশেষণ অর্থে ওকে ব্যবহার করি নে, বলি নে "হেঁট মানুষ'। বস্তুত "হেঁট হওয়া' "হেঁট করা' জোড়া ক্রিয়াপদ, জুড়ে লেখাই উচিত। "মাঝ' শব্দটাও এই জাতের, বলি : মাঝখানে মাঝদরিয়া। এ হল সমাস। আর বলি : মাঝ থেকে। এখানে "থেকে অপাদানের চিহ্ন, অতএব "মাঝ-থেকে' শব্দটা জোড়া শব্দ। বলি নে : মাঝ গোরু, মাঝ ঘর। এই মাঝ শব্দটা খাঁটি বিশেষণ রূপ নিলে হয় "মেঝো'।

দুই অক্ষরের হসন্ত বাংলা বিশেষণের দৃষ্টান্ত ভেবে ভেবে আরও কিছু মনে আনা যেতে পারে, কিন্তু অনেকটা ভাবতে হয়। অপর পক্ষে বেশি খুঁজতে হয় না, যেমন : বড়ো ছোটো মেঝো সেজো ভালো কালো ধলো রাঙা সাদা ফিকে খাটো রোগা মোটা বেঁটে কুঁজো বাঁকা সিধে কানা খোঁড়া বোঁচা নুলো ন্যাকা খাঁদা ট্যারা কটা গোটা ন্যাড়া খ্যাপা মিঠে ডাঁসা কষা খাসা তোফা কাঁচা পাকা খাঁটি মেকি কড়া চোখা রোখা ভিজে হাজা শুকো গুঁড়ো বুড়ো ওঁচা খেলো ছ্যাঁদা ঝুঁটো ভীতু আগা গোড়া উঁচু নিচু কালা হাবা বোকা ঢ্যাঙা বেঁটে ঠুঁটো ঘনো।

বাংলা বর্ণমালায় ই আর উ সবচেয়ে উদ্যমশীল স্বরবর্ণ। রাসায়নিক মহলে অক্সিজেন গ্যাস নানা পদার্থের সঙ্গে নানা বিকার ঘটিয়ে দিয়ে নিজেকে রূপান্তরিত করে, ই স্বরবর্ণটা সেইরকম। অন্তত আ'কে বিগড়িয়ে দেবার জন্যে তার খুব উদ্যম, যেমন : থলি + আ = থ'লে, করি + আ = ক'রে। ইআ প্রত্যয়ের ই পূর্ববর্তী একটা বর্ণকে ডিঙিয়ে শব্দের আদি ও অন্তে বিকার ঘটায়, তার দৃষ্টান্ত : জাল + ইআ = জেলে, বালি + ইআ = বেলে, মাটি + ইআ = মেটে, লাঠি + ইআল = লেঠেল।

পরে যখন আকার আছে ই সেখানে আ'এ হাত না দিয়ে নিজেকেই বদলে ফেলেছে, তার দৃষ্টান্ত যথা : মিঠাই = মেঠাই, বিড়াল = বেড়াল, শিয়াল = শেয়াল, কিতাব = কেতাব, খিতাব = খেতাব।

আবার নিজেকে বজায় রেখে আকারটাকে বিগড়িয়ে দিয়েছে, তার দৃষ্টান্ত দেখো : হিসাব = হিসেব, নিশান = নিশেন, বিকাল = বিকেল, বিলাত = বিলেত। ই কোনো উৎপাত করে নি এমন দৃষ্টান্তও আছে, সে বেশি নয়, অল্পই, যেমন : বিচার নিবাস কৃষাণ পিশাচ।

একদা বাংলা ক্রিয়াপদে আ স্বরবর্ণের যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল। করিলা চলিলা করিবা যাইবা : এইটেই নিয়ম ছিল। ইতিমধ্যে ই উপদ্রব বাধিয়ে দিলে। নিরীহ আকারকে সে শান্তিতে থাকতে দেয় না; "দিলা'কে করে তুলল "দিলে', "করিবা' হল "করবে'।

বাংলা ক্রিয়াপদের সদ্য অতীতে ইল প্রত্যয়ে বিকল্পে ও এবং এ লাগে, যেমন : করলো করলে। "করিল' হয়েছে "করলো', ইকারের সঙ্গে সম্বন্ধ ছিন্ন ক'রে। "করিলা' থেকে "করলে' হয়েছে ইকারের শাসন মেনেই, অর্থাৎ আ'কে নিকটে পেয়ে ই তার যোগে একটা এ ঘটিয়েছে। মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, দক্ষিণবঙ্গের কথ্য বাংলার কথা বলছি। এই ভাষায় "করিলাম' যদি "করলেম' হয়ে থাকে সে তার স্বরবর্ণের প্রবৃত্তিবশত। এই কারণেই "হইয়া' হয়েছে "হয়ে'।

বাংলায় উ স্বরবর্ণও খুব চঞ্চল। ইকার টেনে আনে এ স্বরকে, আর ও স্বরকে টানে উকার : পট + উআ = পোটো। মাঝের উ ডাইনে বাঁয়ে দিলে স্বর বদলিয়ে। শব্দের আদ্যক্ষরে যদি থাকে আ, তা হলে এই সব্যসাচী বাঁ দিকে লাগায় এ, ডান দিকে ও। "মাঠ' শব্দে উআ প্রত্যয় যোগে "মাঠুআ', হ'য়ে গেল "মেঠো'; "কাঠুআ' থেকে "কেঠো'। উকারের আত্মবিসর্জনের যেমন দৃষ্টান্ত দেখলুম, তার আত্মপ্রতিষ্ঠারও দৃষ্টান্ত আছে, যেমন : কুড়াল = কুড়ুল, উনান = উনুন। কোথাও বা আদ্যক্ষরের উকার পরবর্তী আকারকে ও ক'রে দিয়ে নিজে খাঁটি থাকে, যেমন : জুতা = জুতো, গুঁড়া = গুঁড়ো, পূজা = পুজো, সূতা = সুতো, ছুতার = ছুতোর, কুমার = কুমোর, উজাড় = উজোড়। উকারের পরবর্তী অকারকে অনেক স্থলেই উকার করে দেওয়া হয়, যেমন : পুতল = পুতুল, পুখর = পুখুর, হুকম = হুকুম, উপড় = উপুড়।

একটা কথা বলে রাখি, ইকারের সঙ্গে উকারের একটা যোগসাজোস আছে। তিন অক্ষরের কোনো শব্দের তৃতীয় বর্ণে যদি ই থাকে তা হলে সে মধ্যবর্ণের আ'কে তাড়িয়ে সেখানে বিনা বিচারে উ'এর আসন করে দেয়। কিন্তু প্রথমবর্ণে উ কিংবা ই থাকা চাই, যেমন : উড়ানি = উড়ুনি, নিড়ানি = নিড়ুনি, পিটানি = পিটুনি। কিন্তু "পেটানি'র বেলায় খাটে না; কারণ ওটা একার, ইকার নয়। "মাতানি'র বেলায়ও এইরূপ। "খাটুনি' হয়, যেহেতু ট'এ আকারের সংস্রব নেই। গাঁথুনি মাতুনি রাঁধুনি'রও উকার এসেছে অকারকে সরিয়ে দিয়ে। সেই নিয়মে : এখুনি চিরুনি। "চালানি' শব্দে আকারকে মেরে উকার দখল পেলে না, কিন্তু "চালনি' শব্দে আকারকে ঠেলে ফেলে অনায়াসে হল "চালুনি'।

উকারের ব্যবহার দেখলে মনে পড়ে কোকিলকে, সে যেখানে সেখানে পরের বাসায় ডিম পেড়ে যায়।

এও দেখা গেছে ইআ প্রত্যয়-ওয়ালা শব্দে ই'কে ঠেলে উ অনধিকারে নিজে আসন জুড়ে বসে, যেমন : জঙ্গল = জঙ্গলিয়া = জঙ্গুলে, বাদল = বাদলিয়া = বাদুলে। এমনিতরো : নাটুকে মাতুনে।

হাতুড়ে কাঠুরে সাপুড়ে হাটুরে ঘেসুড়ে : এদের মধ্যে কোনো-একটা প্রত্যয় যোগে র বা ড় এসে জুটেছে। লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে, "ঘেসুড়ে'র ঘাসে লাগল একার, "সাপুড়ে'র সাপ রইল নির্বিকার। ভাষাকে প্রশ্ন করলে এক-এক সময়ে ভালো জবাব পাই, এক-এক সময় পাইও নে। চাষ যে করে সে "চাষুড়ে' হল না কেন।

আমার হিন্দিভাষী বন্ধু বলেন, বাংলায় "সাপুড়ে'। হিন্দিতে : সঁপেরা = সাঁপ + হারা। বাংলা "কাঠুরে' হিন্দিতে "লকড়হারা', হিন্দিতে "কাঠহারা' কথা নেই। হিন্দির এই "হারা' তদ্ধিত প্রত্যয়; অধিকার অর্থে এর প্রয়োগ, ক্রিয়া অর্থে নয়। বোধ করি সেই কারণে "চাষুড়ে' শব্দটা সম্ভব হয় নি।

স্বরবিকারের আর-একটা অদ্ভুত দৃষ্টান্ত দেখো। ইআ প্রত্যয়-যোগে একটা ওকার খামখা হয়ে গেল উ : গোবোর + ইয়া = গুব্‌রে, কোঁদোল + ইয়া = কুঁদুলে। "কুঁদ্‌লে' হল না কেন সেও একটা প্রশ্ন। "গোবোর' থেকে ওকারটাকে হসন্তের ঘায়ে তাড়িয়ে দিলে, "কোঁদোল' শব্দে ও হসন্তকে জায়গা না দিয়ে নিজে বসল জমিয়ে।

অকারের প্রতি উপেক্ষা সম্বন্ধে আরও প্রমাণ দেওয়া যায়। হাত বুলিয়ে সন্ধান করাকে বলে "হাৎড়ানো', অসমাপিকার "হাৎড়িয়ে'। এখানে "হাত'এর ত থেকে ছেঁটে দেওয়া হল অকার। অথচ "হাতুড়ে' শব্দের বেলায় নাহক একটা উকার এনে জুড়ে দিলে, তবু অকারকে কিছুতে আমল দিল না। "বাদল' শব্দের উত্তর ইআ প্রত্যয় যোগ ক'রে "বাদ্‌লে' করলে না বটে, কিন্তু দিলে "বাদুলে' করে।

এই-সব দৃষ্টান্ত থেকে বুঝতে পারি, অন্তত পশ্চিম ও দক্ষিণ বঙ্গের রসনার টান আছে উকারের দিকে। "হাতড়ি' শব্দ তাই সহজেই হয়েছে "হাতুড়ি'। তা ছাড়া দেখো : বাছুর তেঁতুল বামুন মিশুক হিংসুক বিষ্যুৎবার।

এই প্রসঙ্গে আর-একটা দৃষ্টান্ত দেবার আছে। "চিবোতে' "ঘুমোতে' শব্দের স্থলে আজকাল "চিবুতে' "ঘুমুতে' উচ্চারণ ও বানান চলেছে। আজকাল বলছি এইজন্যে যে, আমার নিজের কাছে এই উচ্চারণ ছিল অপরিচিত ও অব্যবহৃত। "চিবোতে' "ঘুমোতে' শব্দের মূলরূপ : চিবাইতে ঘুমাইতে। আ += ই'কে ঠেলে ফেলে নিঃসম্পর্কীয় উ এসে বসল। অবশ্য এর অন্য নজির আছে। বিনানি = বিনুনি, ঝিমানি = ঝিমুনি, পিটানি = পিটুনি শব্দে দেখা যাচ্ছে প্রথম বর্ণের ইকার তার সবর্ণ তৃতীয় বর্ণের 'পরে হস্তক্ষেপ করলে না, অথচ মধ্যবর্ণের আ'কে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় বসিয়ে দিলে উ। মনে রাখতে হবে, প্রথম বর্ণের ইকার তার এই বন্ধু উ'কে নিমন্ত্রণের জন্যে দায়ী। গোড়ায় যেখানে ইকারের ইঙ্গিত নেই সেখানে উ পথ পায় না ঢুকতে। পূর্বেই তার দৃষ্টান্ত দিয়েছি। "ঠ্যাঙানি' হয় না "ঠেঙুনি', "ঠকানি' হয় না "ঠকুনি', "বাঁকানি' হয় না "বাঁকুনি'। "চিবুতে' "ঘুমুতে' উচ্চারণ আমার কানে ঠিক ব'লে ঠেকে না, সে যে নিতান্ত কেবল অভ্যাসের জন্যে তা আমি মানতে পারি নে। বাংলা ভাষায় এ উচ্চারণ অনিবার্য নয়। আমার বিশ্বাস "চিনাইতে' শব্দকে কেউ "চিনুতে' বলে না, অন্তত আমার তাই ধারণা। "দুলাইতে' কেউ কি "দুলুতে', কিংবা "ছুটাইতে' "ছুটুতে' বলে? "বুঝাইতে' বলতে "বুঝুতে' কেউ বলে কিনা নিশ্চিত জানি নে, আশা করি বলে না। "পুরাইতে' বলতে "পুরুতে' কিংবা "ঠকাইতে' বলতে "ঠকুতে' শুনি নি। আমার নিশ্চিত বোধ হয় "কান জুড়ুল' কেউ বলে না, অথচ "ঘুমাইল' ও "জুড়াইল' একই ছাঁদের কথা। "আমাকে দিয়ে তার ঘোড়াটা কিনাইল' বাক্যটাকে চলতি ভাষায় যদি বলে "আমাকে দিয়ে তার ঘোড়াটা কিনুল', আমার বোধ হয় সেটা বেআড়া শোনাবে। এই "শোনাবে' শব্দটা "শুনুবে' হয়ে উঠতে বোধ হয় এখনো দেরি আছে। আমরা এক কালে যে-সব উচ্চারণে অভ্যস্ত ছিলুম এখন তার অন্যথা দেখি, যেমন : পেতোল (পিতোল), ভেতোর (ভিতোর), তেতো (তিতো), সোন্দোর (সুন্দোর), ডাল দে (দিয়ে) মেখে খাওয়া, তার বে (বিয়ে) হয়ে গেল।

উকারের ধ্বনি তার পরবর্তী অক্ষরেও প্রতিধ্বনিত হতে পারে, এতে আশ্চর্যের কথা নেই, যেমন : মুণ্ডু কুণ্ডু শুদ্দুর রুদ্দুর পুত্তুর মুগুর। তবু "কুণ্ডল' ঠিক আছে, কিন্তু "কুণ্ডুলি'তে লাগল উকার। "সুন্দর' "সুন্দরী'তে কোনো উৎপাত ঘটে নি। অথচ "গণনা' শব্দে অনাহূত উকার এসে বানিয়ে দিলে "গুনে'। "শয়ন' থেকে হল "শুয়ে', "বয়ন' থেকে "বুনে', "চয়ন' থেকে "চুনে'।

বাংলা অকারের প্রতি বাংলা ভাষার অনাদরের কথা পূর্বেই বলেছি। ইকার-উকারের পূর্বে তার স্বরূপ লোপ হয়ে ও হয়। ঐ নিরীহ স্বরের প্রতি একারের উপদ্রবও কম নয়। উচ্চারণে তার একটা অকার-তাড়ানো ঝোঁক আছে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় সাধারণ লোকের মুখের উচ্চারণে। বাল্যকালে প্রলয়-ব্যাপারকে "পেল্লায়' ব্যাপার বলতে শুনেছি মেয়েদের মুখে। সমাজের বিশেষ স্তরে আজও এর চলন আছে, এবং আছে : পেল্লাদ (প্রহ্লাদ), পেরনাম (প্রণাম), পেরথম (প্রথম), পেরধান (প্রধান), পেরজা (প্রজা), পেসোন্নো (প্রসন্ন), পেসাদ অথবা পেরসাদ (প্রসাদ)। "প্রত্যাশা' ও "প্রত্যয়' শব্দের অপভ্রংশে প্রথম বর্ণে হস্তক্ষেপ না ক'রে দ্বিতীয় বর্ণে বিনা কৈফিয়তে একার নিয়েছে বাসা, হয়েছে "পিত্তেস', "পিত্তেয়', কখনো হয় "পেত্তয়'। একারকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে ইকার এবং ঋকার, তারও দৃষ্টান্ত আছে, যেমন : সেদ্ধো (সিদ্ধ), নেত্তো (নিত্য বা নৃত্য), কেষ্টো (কিষ্টো), শেকোল (শিকল), বেরোদ (বৃহৎ), খেস্টান (খৃস্টান)। প্রথম বর্ণকে ডিঙিয়ে মাঝখানের বর্ণে একার লাফ দিয়েছে সেও লক্ষ্য করবার বিষয়, যেমন : নিশ্বেস বিশ্বেস, সরসে (সরস), নীরেস ঈশেন বিলেত বিকেল অদেষ্ট।

স্বরবর্ণের খেয়ালের আর-একটা দৃষ্টান্ত দেখানো যাক।--

"পিটানো' শব্দের প্রথম বর্ণের ইকার যদি অবিকৃত থাকে তা হলে দ্বিতীয় বর্ণের আকারকে দেয় ওকার করে, হয় "পিটোনো'। ইকার যদি বিগড়ে গিয়ে একার হয় তা হলে আকার থাকে নিরাপদে, হয় "পেটানো'। তেমনি : মিটোনো = মেটানো, বিলোনো = বেলানো, কিলোনো = কেলানো। ইকারে একারে যেমন অদল-বদলের সম্বন্ধ তেমনি উকারে ওকারে। শব্দের প্রথম বর্ণে উ যদি খাঁটি থাকে তা হলে দ্বিতীয় বর্ণের অকারকে পরাস্ত ক'রে করবে ওকার। যেমন "ভুলানো' হয়ে থাকে "ভুলোনো'। কিন্তু যদি ঐ উকারের স্খলন হয়ে হয় ওকার তা হলে আকারের ক্ষতি হয় না, তখন হয় "ভোলানো'। তেমনি : ডুবোনো = ডোবানো, ছুটোনো = ছোটানো। কিন্তু "ঘুমোনো' কখনোই হয় না "ঘোমানো', "কুলোনো' হয় না "কোলানো' কেন। অকর্মক বলে কি ওর স্বতন্ত্র বিধান।

দেখা যাচ্ছে বাংলা উচ্চারণে ইকার এবং উকার খুব কর্মিষ্ঠ, একার এবং ওকার ওদের শরণাগত, বাংলা অকার এবং আকার উৎপাত সইতেই আছে।

স্বরবর্ণের কোঠায় আমরা ঋ'কে ঋণস্বরূপে নিয়েছি বর্ণমালায়, কিন্তু উচ্চারণ করি ব্যঞ্জনবর্ণের রি। সেইজন্যে অনেক বাঙালি "মাতৃভূমি'কে বলেন "মাত্রিভূমি'। যে কবি তাঁর ছন্দে ঋকারকে স্বরবর্ণরূপে ব্যবহার করেন তাঁর ছন্দে ঐ বর্ণে অনেকের রসনা ঠোকর খায়।

সাধারণত বাংলায় স্বরের দীর্ঘ উচ্চারণ নেই। তবু কোনো কোনো স্থলে স্বরের উচ্চারণ কিছু পরিমাণে বা সম্পূর্ণ পরিমাণে দীর্ঘ হয়ে থাকে। হসন্ত বর্ণের পূর্ববর্তী স্বরবর্ণের নিকে কান দিলে সেটা ধরা পড়ে, যেমন "জল'। এখানে জ'এ যে অকার আছে তার দীর্ঘতা প্রমাণ হয় "জলা' শব্দের জ'এর সঙ্গে তুলনা করে দেখলে। "হাত' আর "হাতা'য় প্রথমটির হা দীর্ঘ, দ্বিতীয়টির হ্রস্ব। "পিঠ' আর "পিঠে', "ভুত' আর "ভুতো', "ঘোল' আর "ঘোলা'-- তুলনা করে দেখলে কথাটা স্পষ্ট হবে। সংস্কৃতে দীর্ঘস্বরের দীর্ঘতা সর্বত্রই, বাংলায় স্থানবিশেষে। কথায় ঝোঁক দেবার সময় বাংলা স্বরের উচ্চারণ সব জায়গাতেই দীর্ঘ হয়, যেমন : ভা--রি তো পণ্ডিত, কে--বা কার খোঁজ রাখে, আ--জই যাব, হল--ই বা, অবা--ক করলে, হাজা--রো লোক, কী-- যে বকো, এক ধা--র থেকে লাগা--ও মার। যুক্তবর্ণের পূর্বে সংস্কৃতে স্বর দীর্ঘ হয়। বাংলায় তা হয় না।

বাংলায় একটা অতিরিক্ত স্বরবর্ণ আছে যা সংস্কৃত ভাষায় নেই। বর্ণমালায় সে ঢুকেছে একারের নামের ছাড়পত্র নিয়ে, তার জন্যে স্বতন্ত্র আসন পাতা হয় নি। ইংরেজি bad শব্দের a তার সমজাতীয়। বাংলায় তার বিশেষ বানান করবার সময় আমরা য ফলার আকার দিয়ে থাকি। বাংলায় আমরা যেটাকে বলি অন্ত্যস্থ য, চ বর্গের জ’এর সঙ্গে তার উচ্চারণের ভেদ নেই। য’এর নীচে ফোঁটা দিয়ে আমরা আর-একটা অক্ষর বানিয়েছি তাকে বলি ইয়। সেটাই সংস্কৃত অন্ত্যস্থ য। সংস্কৃত উচ্চারণ-মতে ‘যম’ শব্দ ‘য়ম’। কিন্তু ওটাতে ‘জম’ উচ্চারণের অজুহাতে য়’র ফোঁটা দিয়েছি সরিয়ে। ‘নিয়ম’ শব্দের বেলায় য়’র ফোঁটা রক্ষে করেছি, তার উচ্চারণেও সংস্কৃত বজায় আছে। কিন্তু যফলা-আকারে (‌্যা) য়’কে দিয়েছি খেদিয়ে আর আ’টাকে দিয়েছি বাঁকা করে। সংস্কৃতে ‘ন্যাস’ শব্দের উচ্চারণ ‘নিয়াস’, বাংলায় হল nas। তার পর থেকে দরকার পড়লে য ফলার চিহ্নটাকে ব্যবহার করি আকারটাকে বাঁকিয়ে দেবার জন্যে। Paris শব্দকে বাংলায় লিখি "প্যারিস', সংস্কৃত বানানের নিয়ম অনুসারে এর উচ্চারণ হওয়া উচিত ছিল "পিয়ারিস'। একদা "ন্যায়' শব্দটাকে বাংলায় "নেয়ায়' লেখা হয়েছে দেখেছি।

অথচ "ন্যায়' শব্দকে বানানের ছলনায় আমরা তৎসম শব্দ বলে চালাই। "যম'কেও আমরা ভয়ে ভয়ে বলে থাকি বিশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দ, অথচ রসনায় ওটা হয়ে দাঁড়ায় তদ্ভব বাংলা।

সংস্কৃত শব্দের একার বাংলায় অনেক স্থলেই স্বভাব পরিবর্তন করেছে, যেমন "খেলা', যেমন "এক'। জেলাভেদে এই একারের উচ্চারণ একেবারে বিপরীত হয়। তেল মেঘ পেট লেজ-- শব্দে তার প্রমাণ আছে।

পূর্বেই দেখিয়েছি আ এবং অ স্বরবর্ণ সম্বন্ধে ইকার এবং উকারের ব্যবহার আধুনিক খবরের কাগজের ভাষায় যাকে বলে চাঞ্চল্যজনক, অর্থাৎ এরা সর্বদা অপঘাত ঘটিয়ে থাকে। কিন্তু এদের অনুগত একারের প্রতি এরা সদয়। "এক' কিংবা "একটা' শব্দের এ গেছে বেঁকে, কিন্তু উ তাকে রক্ষা করেছে "একুশ' শব্দে। রক্ষা করবার শক্তি আকারের নেই, তার প্রমাণ "এগারো' শব্দে। আমরা দেখিয়েছি ন'এর পূর্বে অ হয়ে যায় ও, যেমন "ধন' "মন' শব্দে। ঐ ন একারের বিকৃতি ঘটায় : ফেন সেন কেন যেন। ইকারের পক্ষপাত আছে একারের প্রতি, তার প্রমাণ দিতে পারি। "লিখন' থেকে হয়েছে "লেখা'-- বিশুদ্ধ এ-- "গিলন' থেকে "গেলা'। অথচ "দেখন ' থেকে "দ্যাখা,' "বেচন' থেকে "ব্যাচা', "হেলন' থেকে "হ্যালা'। অসমাপিকা ক্রিয়ার মধ্যে এদের বিশেষ রূপগ্রহণের মূল পাওয়া যায়, যেমন : লিখিয়া = লেখা (পূর্ববঙ্গে "ল্যাখা'), গিলিয়া = গেলা। কিন্তু : খেলিয়া = খ্যালা, বেচিয়া = ব্যাচা। মিলন অর্থে আর-একটা শব্দ আছে "মেলন', তার থেকে হয়েছে "ম্যালা', আর "মিলন' থেকে হয়েছে "মেলা' (মিলিত হওয়া)।

য ফলার আকার না থাকলেও বাংলায় তার উচ্চারণ অ্যাকার, যেমন "ব্যয়' শব্দে। এটা হল আদ্যক্ষরে। অন্যত্র ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব ঘটায়, যেমন "সভ্য'। পূর্বে বলেছি ইকারের প্রতি একারের টান। "ব্যক্তি' শব্দের ইকার প্রথম বর্ণে দেয় একার বসিয়ে, "ব্যক্তি' শব্দ হয়ে যায় "বেক্তি'। হ'এর সঙ্গে য ফলা যুক্ত হলে কোথা থেকে জ'এ-ঝ'এ জটলা করে হয়ে দাঁড়ায় "সোজ্‌ঝো'। অথচ "সহ্য' শব্দটাকে বাঙালি তৎসম বলতে কুণ্ঠিত হয় না। বানানের ছদ্মবেশ ঘুচিয়ে দিলেই দেখা যাবে, বাংলায় তৎসম শব্দ নেই বললেই হয়। এমন-কি কোনো নতুন সংস্কৃত শব্দ আমদানি করলে বাংলার নিয়মে তখনি প্রাকৃত রূপ ধরবে। ফলে হয়েছে, আমরা লিখি এক আর পড়ি আর। অর্থাৎ আমরা লিখি সংস্কৃত ভাষায়, ঠিক সেইটেই পড়ি প্রাকৃত বাংলা ভাষায়।

য ফলার উচ্চারণ বাংলায় কোথাও সম্মানিত হয় নি, কিন্তু এক কালে বাংলার ক্রিয়াপদে পথ হারিয়ে সে স্থান পেয়েছিল। "খাইল' "আইল' শব্দের "খাল্য' "আল্য' রূপ প্রাচীন বাংলায় দেখা গিয়েছে। ইকারটা শব্দের মাঝখান থেকে ভ্রষ্ট হয়ে শেষকালে গিয়ে পড়াতে এই ইঅ'র সৃষ্টি হয়েছিল।

বাংলার অন্য প্রদেশে এই যফলা-আকারের অভাব নেই, যেমন "মায়্যা মানুষ'। বাংলা সাধু ভাষার অসমাপিকা ক্রিয়াপদে যফলা-আকার ছদ্মবেশে আছে, যেমন : হইয়া খাইয়া। প্রাচীন পুঁথিতে অনেক স্থলে তার বানান দেখা যায় : হয়্যা খায়্যা।

সম্প্রতি একটা প্রশ্ন আমার কাছে এসেছে। "যাওয়া খাওয়া পাওয়া দেওয়া নেওয়া' ধাতু "যেতে খেতে পেতে দিতে নিতে' আকার নিয়ে থাকে, কিন্তু "গাওয়া বাওয়া চাওয়া কওয়া বওয়া' কেন তেমনভাবে হয় না "গেতে বেতে চেতে ক'তে ব'তে'। এর যে উত্তর আমার মনে এসেছে সে হচ্ছে এই যে, যে ধাতুতে হ'এর প্রভাব আছে তার ই লোপ হয় না। "গাওয়া'র হিন্দি প্রতিশব্দ "গাহনা', চাওয়া'র চাহনা, কওয়া'র কহনা। কিন্তু "খানা দেনা লেনা'র মধ্যে হ নেই। "বাহন' থেকে "বাওয়া', সুতরাং তার সঙ্গে হ'এর সম্বন্ধ আছে। "ছাদন' ও ছাওয়া'র মধ্যপথে বোধকরি "ছাহন' ছিল, তাই "ছাইতে'র জায়গায় "ছেতে' হয় না।

স্বরবর্ণের অনুরাগ-বিরাগের সূক্ষ্ম নিয়মভেদ এবং তার স্বৈরাচার কৌতুকজনক। সংস্কৃত উচ্চারণে যে নিয়ম চলেছিল প্রাকৃতে তা চলল না, আবার নানা প্রাকৃতে নানা উচ্চারণ। বাংলা ভাষা কয়েক শো বছর আগে যা ছিল এখন তা নেই। এক ভাষা ব'লে চেনাই শক্ত। আগে বলত "পড়ই', এখন বলে "পড়ে'; "হোহু' হয়ে গেছে "হও'; "আমহি' হল "আমি'; "বাম্‌হন' হল "বামুন'। এই বদল হওয়ার ঝোঁক বহু লোককে আশ্রয় ক'রে এমন স্বতোবেগে চলছে যেন এ সজীব পদার্থ। হয়তো এই মুহূর্তেই আমাদের উচ্চারণ তার কক্ষপথ থেকে অতি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। ফ হচ্ছে f, ভ হচ্ছে ব, চ হচ্ছে স, এখনো কানে স্পষ্ট ধরা পড়ছে না।

যে প্রাচীন প্রাকৃতের সঙ্গে বাংলা প্রাকৃতের নিকটসম্বন্ধ তার রঙ্গভূমিতে আমাদের স্বরবর্ণগুলি জন্মান্তরে কী রকম লীলা করে এসেছে তার অনুসরণ করে এলে অপভ্রংশের কতকগুলি বাঁধা রীতি হয়তো পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সে পথের পথিক আমি নই। খবর নিতে হলে যেতে হবে সুনীতিকুমারের দ্বারে।

কিন্তু এ সম্বন্ধে রসনার প্রকৃতিগত কোনো সাধারণ নিয়ম বের করা কঠিন হবে। কেননা দেখা যাচ্ছে, পূর্ব উত্তর বঙ্গে এবং দক্ষিণ পশ্চিম বঙ্গে অনেক স্থলে কেবল যে উচ্চারণের পার্থক্য আছে তা নয়, বৈপরীত্যও লক্ষিত হয়।

বাংলা ভাষায় স্বরবর্ণের উচ্চারণবিকার নিয়ে আরও কিছু আলোচনা করেছি আমরা বংলা শব্দতত্ত্বে।

স্বরবর্ণ সম্বন্ধে পালা শেষ করার পূর্বে একটা কথা বলে নিই। এর পরে প্রত্যয় সম্বন্ধে যেখানে বিস্তারিত করে বলেছি সেখানটা পড়লে পাঠকরা জানতে পারবেন বাংলা ভাষাটা ভঙ্গীওয়ালা ভাষা।

বাংলায় এ ও উ এই তিনটে স্বরবর্ণ কেবল যে অর্থবান শব্দের বানানের কাজে লাগে তা নয়। সেই শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কিছু ভঙ্গী তৈরি করে। "হরি'কে যখন "হরে' বলি কিংবা "কালী'কে বলি "কেলো', তখন সেটা সম্মানের সম্ভাষণ বলে শোনাবে না। কিন্তু "হরু' বা "কালু', "ভুলু' বা "খুকু', এমন-কি "খাঁদু শব্দে স্নেহ বহন করে। পূর্বে দেখানো হয়েছে বাংলা ই এবং উ স্বরটা সম্মানী, এ এবং ও অন্ত্যজ। আ স্বরটা অনাদৃত, ওর ব্যবহার আছে অনাদরে, যেমন : মাখন = মাখ্‌না, মদন = মদ্‌না, বামন = বাম্‌না। ইংরেজিতে "রবর্ট' থেকে "বর্টি', "এলিজাবেথ' থেকে "লিজি', "মার্গারেট' থেকে "ম্যাগি', "উইলিয়ম' থেকে "উইলি', "চার্ল্‌স' থেকে "চার্লি'-- ইকার স্বরে দেয় আত্মীয়তার টান। ইকারে আদর প্রকাশ বাংলাতেও পাওয়া যায়। সেখানে আকারকে ঠেলে দিয়ে ই এসে বসে, যেমন : লতা = লতি, কণা = কনি, ক্ষমা = ক্ষেমি, সরলা = সর্‌লি, মীরা = মীরি। অকারান্ত শব্দেও এ দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, যেমন : স্বর্ণ = স্বর্নি। এগুলি সব মেয়ের নাম। আই যোগেও আদরের সুর লাগে, যেমন : নিমাই নিতাই কানাই বলাই। এ কিংবা ও স্বরের অবজ্ঞা, উ স্বরের স্নেহব্যঞ্জনা সংস্কৃতে পাই নে।

বাংলা বর্ণমালায় কতকগুলো বর্ণ আছে যারা বেকার, আর কতকগুলো আছে যারা বেগার খাটে অর্থাৎ নিজের কর্তব্য ছেড়ে অন্যের কাজে লাগে। ক বর্গের অনুনাসিক ঙ সাধু ভাষায় যুক্তবর্ণে ছাড়া অন্যত্র আপন গৌরবে স্থান পায় নি। যেখানে রসনায় তার উচ্চারণকে স্বীকার করেছে সেখানে লেখায় উপেক্ষা করেছে তার স্বরূপকে। "রক্তবর্ণ' বলতে বোঝায় যে শব্দ তাকে লেখা হয়েছে "রাঙ্গা', অর্থাৎ তখনকার ভদ্রলোকেরা ভুল বানান করতে রাজি ছিলেন কিন্তু ঙ'র বৈধ দাবি কিছুতে মানতে চান নি। বানান-জগতে আমিই বোধ হয় সর্বপ্রথমে ঙ'র প্রতি দৃষ্টি দিয়েছিলেম, সেও বোধ করি ছন্দের প্রতি মমতাবশত। যেখানে "ভাঙ্গা' বানান ছন্দকে ভাঙে সেখানে ভাঙন রক্ষা করবার জন্যে ঙ'র শরণ নিয়ে লিখেছি "ভাঙা'। কিন্তু চ বর্গের ঞ'র যথোচিত সদ্‌গতি করা যায় নি। এই ঞ অন্য ব্যঞ্জনবর্ণকে আঁকড়িয়ে টিঁকে থাকে, একক নিজের জোরে কোথাও ঠাঁই পায় না। ঐ "ঠাঁই' কথাটা মনে করিয়ে দিলে যে, এক কালে ঞ ছিল ঐ শব্দটার অবলম্বন। প্রাচীন সাহিত্যে অনেক শব্দ পাওয়া যায় অন্তিমে যার ঞ'ই ছিল আশ্রয়, যেমন : নাঞি মুঞি খাঞা হঞা। এইজাতীয় অসমাপিকা ক্রিয়া মাত্রেই ঞা'র প্রভুত্ব ছিল। আমার বিশ্বাস, এটা রাঢ়দেশের লেখক ও লিপিকরদের অভ্যস্ত ব্যবহার। অনুনাসিক বর্জনের জন্যেই পূর্ববঙ্গ বিখ্যাত।

বাংলা বর্ণমালায় আর-একটা বিভীষিকা আছে, মূর্ধন্য এবং দন্ত্য ন'এ ভেদাভেদ -তত্ত্ব। বানানে ওদের ভেদ, ব্যবহারে ওরা অভিন্ন। মূর্ধন্য ণ'এর আসল উচ্চারণ বাঙালির জানা নেই। কেউ কেউ বলেন, ওটা মূলত দ্রাবিড়ি। ওড়িয়া ভাষায় এর প্রভাব দেখা যায়। ড়'এ চন্দ্রবিন্দুর মতো ওর উচ্চারণ। খাঁড়া চাঁড়াল ভাঁড়ার প্রভৃতি শব্দে ওর পরিচয় পাওয়া যায়।

ল কলকাতা অঞ্চলে অনেক স্থলে নকার গ্রহণ করে, যেমন নেওয়া : নুন নেবু, নিচু (ফল), নাল (লালা), নাগাল নেপ ন্যাপা, নোয়া (সধবার হাতের), ন্যাজ, নোড়া (লোষ্ট্র) ন্যাংটা (উলঙ্গ)। কাব্যের ভাষায় : করিনু চলিনু। গ্রাম্য ভাষায় : নাটি, ন্যাকা (লেখা), নাল (লাল বর্ণ), নঙ্কা ইত্যাদি।

বাংলা বর্ণমালায় সংস্কৃতের তিনটে বর্ণ আছে, শ স ষ। কিন্তু সবক'টির অস্তিত্বের পরিচয় উচ্চারণে পাই নে। ওরা বাঙালি শিশুদের বর্ণপরিচয়ে বিষম বিভ্রাট ঘটিয়েছে। উচ্চারণ ধ'রে দেখলে আছে এক তালব্য শ। আর বাকি দুটো আসন দখল করেছে সংস্কৃত অভিধানের দোহাই পেড়ে। দন্ত্য স'এর উচ্চারণ অভিধান অনুসারে বাংলায় নেই বটে, কিন্তু ভাষায় তার দুটো-একটা ফাঁক জুটে গেছে। যুক্তবর্ণের যোগে রসনায় সে প্রবেশ করে, যেমন : স্নান হস্ত কাস্তে মাস্তুল। শ্রী মিশ্র অশ্রু : তালব্য শ'এর মুখোষ পরেছে কিন্তু আওয়াজ দিচ্ছে দন্ত্য স'এর। সংস্কৃতে যেখানে র ফলার সংস্রবে এসেছে তালব্য শ, বাংলায় সেখানে এল দন্ত্য স। এ ছাড়া "নাচতে, "মুছতে' প্রভৃতি শব্দে চ-ছ'এর সঙ্গে ত'এর ঘেঁষ লেগে দন্ত্য স' এর ধ্বনি জাগে।

সংস্কৃতে অন্ত্যস্থ, বর্গীয়, দুটো ব আছে। বাংলায় যাকে আমরা বলে থাকি তৎসম শব্দ, তাতেও একমাত্র বর্গীয় ব'এর ব্যবহার। হাওয়া খাওয়া প্রভৃতি ওয়া-ওয়ালা শব্দে অন্ত্যস্ত ব'এর আভাস পাওয়া যায়। আসামি ভাষায় এই ওয়া অন্ত্যস্থ ব দিয়েই লেখে, যেমন : "হওয়া'র পরিবর্তে "হবা'। হ এবং অন্ত্যস্থ ব'এর সংযুক্ত বর্ণেও রসনা অন্ত্যস্থ ব'কে স্পর্শ করে, যেমন : আহ্বান জিহ্বা।

বাংলা বর্ণমালার সবপ্রান্তে একটি যুক্তবর্ণকে স্থান দেওয়া হয়েছে, বর্ণনা করবার সময় তাকে বলা হয় : ক'এ মূর্ধন্য ষ "ক্ষিয়ো'। কিন্তু তাতে না থাকে ক, না থাকে মূর্ধন্য ষ। শব্দের আরম্ভে সে হয় খ; অন্তে মধ্যে দুটো খ'এ জোড়া ধ্বনি, যেমন "বক্ষ'। এই ক্ষ'র একটা বিশেষত্ব দেখা যায়, ইকারের পূর্বে সে একার গ্রহণ করে, যেমন : ক্ষেতি ক্ষেমি ক্ষেপি। তা ছাড়া আকার হয় ' কার, যেমন "ক্ষান্ত' হয় "খ্যান্তো'; কারও কারও মুখে "ক্ষমা' হয় "খ্যামা'।

৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন

বাংলাভাষা পরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১১)

মানুষের উদ্ভাবনী প্রতিভার একটা কীর্তি হল চাকা বানানো। চাকার সঙ্গে একটা নতুন চলৎশক্তি এল তার সংসারে। বস্তুর বোঝা সহজে নড়ে না, তাকে পরস্পরের মধ্যে চালাচালি করতে দুঃখ পেতে হয়। চাকা সেই জড়ত্বের মধ্যে প্রাণ এনে দিলে। আদানপ্রদানের কাজ চলল বেগে।

ভাষার দেশে সেই চাকা এসেছে ছন্দের রূপে। সহজ হল মোট-বাঁধা কথাগুলিকে চালিয়ে দেওয়া। মুখে মুখে চলল ভাষার দেনা-পাওনা।

কবিতার বিশেষত্ব হচ্ছে তার গতিশীলতা। সে শেষ হয়েও শেষ হয় না। গদ্যে যখন বলি "একদিন শ্রাবণের রাত্রে বৃষ্টি পড়েছিল', তখন এই বলার মধ্যে এই খবরটা ফুরিয়ে যায়। কিন্তু কবি যখন বললেন--

রজনী শাঙনঘন ঘন দেয়াগরজন
রিম্‌ ঝিম্‌ শবদে বরিষে--

তখন কথা থেমে গেলেও, বলা থামে না।

এ বৃষ্টি যেন নিত্যকালের বৃষ্টি, পঞ্জিকা-আশ্রিত কোনো দিনক্ষণের মধ্যে বদ্ধ হয়ে এ বৃষ্টি স্তব্ধ হয়ে যায় নি। এই খবরটির উপর ছন্দ যে দোলা সৃষ্টি করে দেয় সে দোলা ঐ খবরটিকে প্রবহমান করে রাখে।

অণু পরমাণু থেকে আরম্ভ করে নক্ষত্রলোক পর্যন্ত সর্বত্রই নিরন্তর গতিবেগের মধ্যে ছন্দ রয়েছে। বস্তুত এই ছন্দই রূপ। উপাদানকে ছন্দের মধ্যে তরঙ্গিত করলেই সৃষ্টি রূপ ধারণ করে। ছন্দের বৈচিত্র্যই রূপের বৈচিত্র্য। বাতাস যখন ছন্দে কাঁপে তখনি সে সুর হয়ে ওঠে। ভাবকে কথাকে ছন্দের মধ্যে জাগিয়ে তুললেই তা কবিতা হয়। সেই ছন্দ থেকে ছাড়িয়ে নিলেই সে হয় সংবাদ; সেই সংবাদে প্রাণ নেই, নিত্যতা নেই।

মেঘদূতের কথা ভেবে দেখো। মনিব একজন চাকরকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে, গদ্যে এই খবরের মতো এমন খবর তো সর্বদা শুনছি। কেবল তফাত এই যে, রামগিরি অলকার বদলে হয়তো আমরা আধুনিক রামপুরহাট, হাটখোলার নাম পাচ্ছি। কিন্তু মেঘদূত কেন লোকে বছর বছর ধরে পড়ছে। কারণ, মেঘদূতের মন্দাক্রান্তা ছন্দের মধ্যে বিশ্বের গতি নৃত্য করছে। তাই এই কাব্য চিরকালের সজীব বস্তু। গতিচাঞ্চল্যের ভিতরকার কথা হচ্ছে, "আমি আছি' এই সত্যটির বিচিত্র অনুভূতি। "আমি আছি' এই অনুভূতিটা তো বদ্ধ নয়, এ-যে সহস্র রূপে চলায় ফেরায় আপনাকে জানা। যতদিন পর্যন্ত আমার সত্তা স্পন্দিত নন্দিত হচ্ছে ততদিন "আমি আছি'র বেগের সঙ্গে সৃষ্টির সকল বস্তু বলছে, "তুমি যেমন আছ আমিও তেমনি আছি।' "আমি আছি' এই সত্যটি কেবলই প্রকাশিত হচ্ছে "আমি চলছি'র দ্বারা। চলাটি যখন বাধাহীন হয়, চার দিকের সঙ্গে যখন সুসংগত হয়, সুন্দর হয়, তখনি আনন্দ। ছন্দোময় চলমানতার মধ্যেই সত্যের আনন্দরূপ। আর্টে কাব্যে গানে প্রকাশের সেই আনন্দমূর্তি ছন্দের দ্বারা ব্যক্ত হয়।

একদা ছিল না ছাপাখানা, অক্ষরের ব্যবহার হয় ছিল না, নয় ছিল অল্প। অথচ মানুষ যে-সব কথা সকলকে জানাবার যোগ্য মনে করেছে দলের প্রতি শ্রদ্ধায়, তাকে বেঁধে রাখতে চেয়েছে এবং চালিয়ে দিতে চেয়েছে পরস্পরের কাছে।

এক শ্রেণীর কথা ছিল যেগুলো সামাজিক উপদেশ। আর ছিল চাষাবাসের পরামর্শ, শুভ-অশুভের লক্ষণ, লগ্নের ভালোমন্দ ফল। এই-সমস্ত পরীক্ষিত এবং কল্পিত কথাগুলোকে সংক্ষেপ করে বলতে হয়েছে, ছন্দে বাঁধতে হয়েছে, স্থায়িত্ব দেবার জন্যে। দেবতার স্তুতি, পৌরাণিক আখ্যান বহন করেছে ছন্দ। ছন্দ তাদের রক্ষা করেছে যেন পেটিকার মধ্যে। সাহিত্যের প্রথম পর্বে ছন্দ মানুষের শুধু খেয়ালের নয়, প্রয়োজনের একটা বড়ো সৃষ্টি; আধুনিক কালে যেমন সৃষ্টি তার ছাপাখানা। ছন্দ তার সংস্কৃতির ধাত্রী, ছন্দ তার স্মৃতির ভাণ্ডারী।

চলতি ভাষার স্বভাব রক্ষা ক'রে বাংলা ছন্দে কবিতা যা লেখা হয়েছে সে আমাদের লোকগাথায়, বাউলের গানে, ছেলে ভোলাবার ও ঘুম পাড়াবার ছড়ায়, ব্রতকথায়। সাধুভাষী সাহিত্যমহলের বাইরে তাদের বস্‌তি। তারা যে সমস্তই প্রাচীন তা নয়। লক্ষণ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, তাদের অনেক আছে যারা আমাদের সমান বয়সেরই আধুনিক, এমন-কি ছন্দে মিলে ভাবে আমাদেরই শাক্‌রেদি সন্দেহ করি। একটা দৃষ্টান্ত দেখাই--

অচিন ডাকে নদীর বাঁকে
ডাক যে শোনা যায়।
অকূল পাড়ি, থামতে নারি,
সদাই ধারা ধায়।
ধারার টানে তরী চলে,
ডাকের চোটে মন যে টলে,
টানাটানি ঘুচাও জগার
হল বিষম দায়।

এর মিল, এর মাজাঘষা ছাঁদ ও শব্দবিন্যাস আধুনিক। তবুও যেটা লক্ষ্য করবার বিষয় সে হচ্ছে এর চলতি ভাষা। চলতি ভাষার কবিতা বাংলা শব্দের স্বাভাবিক হসন্তরূপ মেনে নিয়েছে। হসন্ত শব্দ স্বরবর্ণের বাধা না পাওয়াতে পরস্পর জুড়ে যায়, তাতে যুক্তবর্ণের ধ্বনি কানে লাগে। চলতি ভাষার ছন্দ সেই যুক্তবর্ণের ছন্দ। উপরের ঐ কবিতাকে সাধু ভাষার ছন্দে ঢালাই করলে তার চেহারা হয় নিম্নলিখিত মতো--

অচিনের ডাকে নদীটির বাঁকে
ডাক যেন শোনা যায়।
কূলহীন পাড়ি, থামিতে না পারি,
নিশিদিন ধারা ধায়।
সে-ধারার টানে তরীখানি চলে,
সেই ডাক শুনে মন মোর টলে,
এই টানাটানি ঘুচাও জগার
হয়েছে বিষম দায়।

যদি উচ্চারণ মেনে বানান করা যেত তা হলে বাউলের গানের চেহারা হত--

অচিণ্ডাকে নদীবাঁকে ডাক্‌যে শোনা যায়।

সাধু ভাষার কবিতায় বাংলা শব্দের হসন্তরীতি যে মানা হয় নি তা নয়, কিন্তু তাদের পরস্পরকে ঠোকাঠুকি ঘেঁষাঘেঁষি করতে দেওয়া হয় না। বাউলের গানে আছে "ডাকের চোটে মন যে টলে'। এখানে "ডাকের' আর "চোটে', "মন' আর "যে, এদের মধ্যে উচ্চারণের কোনো ফাঁক থাকে না। কিন্তু সাধু ভাষার গানে "মন' আর "মোর' হসন্ত শব্দ হলেও হসন্ত শব্দের স্বভাব রক্ষা করে না, সন্ধির নিয়মে পরস্পর এঁটে যায় না।

বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরোনো ছন্দ পয়ারের ছাঁদের, অর্থাৎ দুই সংখ্যার ওজনে।

যেমন--

খনা ডেকে ব'লে যান
রোদে ধান ছায়ায় পান।
দিনে রোদ রাতে জল
তাতে বাড়ে ধানের বল।

এমনি ক'রে হতে হতে ছন্দের মধ্যে এসে পড়ে তিনের মাত্রা। যেমন--

আনহি বসত আনহি চাষ,
বলে ডাক তাহার বিনাশ।

কিংবা--

আষাঢ়ে কাড়ান নামকে,
শ্রাবণে কাড়ান ধানকে,
ভাদরে কাড়ান শিষকে,
আশ্বিনে কাড়ান কিসকে।

এর অর্থ বোঝাবার দায়িত্ব নিতে পারব না।

দুই মাত্রার ছড়ার ছন্দ পরিণত রূপ নিয়েছে পয়ারে। বাঙালি বহুকাল ধরে এই ছন্দে গেয়ে এসেছে রামায়ণ- মহাভারত একটানা সুরে। এই ছন্দে প্রবাহিত প্রাদেশিক পুরাণকাহিনী রঙিয়েছে বাঙালির হৃদয়কে। দারিদ্র্য ছিল তার জীবনযাত্রায়, তার ভাগ্যদেবতা ছিল অত্যাচারপরায়ণ, সে এমন নৌকোয় ভাসছিল যার হাল ছিল না তার নিজের হাতে; যখন তার আকাশ থাকত শান্ত তখন গ্রামের এ ঘাটে ও ঘাটে চলত তার আনাগোনা সামান্য কারবার নিয়ে, কখনো বা দিনের পর দিন দুর্যোগ লেগেই থাকত, ভাগ্যের অনিশ্চয়তায় হঠাৎ কে কোথায় পৌঁছয় তার ঠিক ছিল না, হঠাৎ নৌকোসুদ্ধ হত ভরাডুবি। এরা ছড়া বাঁধে নি নিজের কোনো স্মরণীয় ইতিহাস নিয়ে। এরা গান বাঁধে নি ব্যক্তিগত জীবনের সুখদুঃখবেদনায়। এরা নিঃসন্দেহই ভালোবেসেছে, কিন্তু নিজের জবানিতে প্রকাশ করে নি তার হাসিকান্না। দেবতার চরিত-বৃত্তান্তে এরা ঢেলেছে এদের অন্তরের আবেগ; হরপার্বতীর লীলায় এরা নিজের গৃহস্থালির রূপ ফুটিয়েছে, রাধাকৃষ্ণের প্রেমের গানে এরা সেই প্রেমের কল্পনাকে মনের মধ্যে ঢেউ লাগিয়েছে যে প্রেম সমাজবন্ধনে বন্দী নয়, যে প্রেম শ্রেয়োবুদ্ধি-বিচারের বাইরে। একমাত্র কাহিনী ছিল রামায়ণ-মহাভারতকে অবলম্বন করে যা মানবচরিত্রের নতোন্নতকে নিয়ে হিমালয়ের মতো ছিল দিক থেকে দিগন্তরে প্রসারিত। কিন্তু সে হিমালয় বাংলাদেশের উত্তরতম সীমার দূর গিরিমালার মতোই; তার অভ্রভেদী মহত্ত্বের কঠিন মূর্তি সমতল বাংলার রসাতিশয্যের সঙ্গে মেলে না। তা বিশেষভাবে বাংলার নয়, তা সনাতন ভারতের। অন্নদামঙ্গলের সঙ্গে, কবিকঙ্কণের সঙ্গে, রামায়ণ-মহাভারতের তুলনা করলে উভয়ের পার্থক্য বোঝা যাবে। অন্নদামঙ্গল চণ্ডীমঙ্গল বাংলার; তাতে মনুষ্যত্বের বীর্য প্রকাশ পায় নি, প্রকাশ পেয়েছে অকিঞ্চিৎকর প্রাত্যহিকতার অনুজ্জ্বল জীবনযাত্রা।

এই কাব্যের পণ্য ভেসেছিল পয়ার ছন্দে। ভাঙাচোরা ছিল এর পদবিন্যাস। গানের সুর দিয়ে এর অসমানতা মিলিয়ে দেওয়া হত, দরকার হত না অক্ষর সাজাবার কাজে সতর্ক হবার। পুরানো কাব্যের পুঁথি দেখলেই তা টের পাওয়া যায়। অত্যন্ত উঁচুনিচু তার পথ। ভারতচন্দ্রই প্রথম ছন্দকে সৌষম্যের নিয়মে বেঁধেছিলেন। তিনি ছিলেন সংস্কৃত ও পারসিক ভাষায় পণ্ডিত। ভাষাবিন্যাসে ছন্দে প্রাদেশিকতার শৈথিল্য তিনি মানতে পারেন নি।

পয়ার ছন্দের একেশ্বরত্ব ছাড়িয়ে গিয়ে বিচিত্র হয়েছে ছন্দ বৈষ্ণব পদাবলীতে। তার একটা কারণ, এগুলি একটানা গল্প নয়। এই পদগুলিতে বিচিত্র হৃদয়াবেগের সংঘাত লেগেছে। দোলায়িত হয়েছে সেই আবেগ তিনমাত্রার ছন্দে। দ্বৈমাত্রিক এবং ত্রৈমাত্রিক ছন্দে বাংলা কাব্যের আরম্ভ। এখনো পর্যন্ত ঐ দুই জাতের মাত্রাকে নানা প্রকারে সাজিয়ে বাংলায় ছন্দের লীলা চলছে। আর আছে দুই এবং তিনের জোড় বিজোড় সংখ্যা মিলিয়ে পাঁচ কিংবা নয়ের অসম মাত্রার ছন্দ।

মোট কথা বলা যায়, দুই এবং তিন সংখ্যাই বাংলার সকল ছন্দের মূলে। তার রূপের বৈচিত্র্য ঘটে যতিবিভাগের বৈচিত্র্যে, এবং নানা ওজনের পংক্তিবিন্যাসে। এইরকম বিভিন্ন বিভাগের যতি ও পংক্তি নিয়ে বাংলায় ছন্দ কেবলই বেড়ে চলেছে।

এক সময়ে শ্রেণীবদ্ধ মাত্রা গুণে ছন্দ নির্ণয় হত। বালকবয়সে একদিন সেই চোদ্দ অক্ষর মিলিয়ে ছেলেমানুষি পয়ার রচনা ক'রে নিজের কৃতিত্বে বিস্মিত হয়েছিলুম। তার পরে দেখা গেল, কেবল অক্ষর গণনা ক'রে যে ছন্দ তৈরি হয় তার শিল্পকলা আদিম জাতের। পদের নানা ভাগ আর মাত্রার নানা সংখ্যা দিয়ে ছন্দের বিচিত্র অলংকৃতি। অনেক সময়ে ছন্দের নৈপুণ্য কাব্যের মর্যাদা ছাড়িয়ে যায়।

চলতি ভাষার কাব্য, যাকে বলে ছড়া, তাতে বাংলার হসন্তসংঘাতের স্বাভাবিক ধ্বনিকে স্বীকার করেছে। সেটা পয়ার হলেও অক্ষর-গোনা পয়ার হবে না, সে হবে মাত্রা-গোনা পয়ার। কিন্তু কথাটা ঠিক হল না, বস্তুত সাধু ভাষার পয়ারও মাত্রা-গোনা। সাহিত্যিক কবুলতি পত্রে সাধু ভাষায় অক্ষর এবং মাত্রা এক পরিমাণের বলে গণ্য হয়েছে। এইমাত্র রফা হয়েছে যে সাধু ভাষার পদ্য-উচ্চারণকালে হসন্তের টানে শব্দগুলি গায়ে গায়ে লেগে যাবে না; অর্থাৎ বাংলার স্বাভাবিক ধ্বনির নিয়ম এড়িয়ে চলতে হবে।--

সতত হে নদ তুমি পড়ো মোর মনে,
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।

চলতি বাংলায় "নদ' আর "তুমি', "মোর' আর "মনে' হসন্তের বাঁধনে বাঁধা। এই পয়ারে ঐ শব্দগুলিকে হসন্ত বলে যে মানা হয় নি তা নয়, কিন্তু ওর বাঁধন আলগা করে দেওয়া হয়েছে। "কান' আর "আমি', "ভ্রান্তির' আর "ছলনে' হসন্তের রীতিতে হওয়া উচিত ছিল যুক্ত শব্দ। কিন্তু সাধু ছন্দের নিয়মে ওদের জোড় বাঁধতে বাধা দেওয়া হয়েছে।

একটা খাঁটি ছড়ার নমুনা দেখা যাক--

এ পার গঙ্গা ও পার গঙ্গা মধ্যিখানে চর,
তারই মধ্যে বসে আছেন শিবু সদাগর।

এটা পয়ার কিন্তু চোদ্দ অক্ষরের সীমানা পেরিয়ে গেছে। তবু উচ্চারণ মিলিয়ে বানান করলে চোদ্দ অক্ষরের বেশি হবে না--

এপার্গঙ্গা ওপার্গঙ্গা মধ্যিখানে চর,
তারি মধ্যে বসে আছেন্সিবু সদাগর।

ছড়ায় প্রায় দেখা যায় মাত্রার ঘনতা কোথাও কম, কোথাও বেশি; আবৃত্তিকারের উপর ছন্দ মিলিয়ে নেবার বরাত দেওয়া আছে। ছন্দের নিজের মধ্যে যে ঝোঁক আছে তার তাড়ায় কণ্ঠ আপনি প্রয়োজনমতো স্বর বাড়ায় কমায়।--

শিবু ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কন্যে দান।

এখানে "বিয়ে হবে' শব্দে মাত্রা ঢিলে হয়ে গেছে। যদি থাকত "শিবু ঠাকুরের বিয়ের সভায় তিন কন্যে দান', তা হলে মাত্রা পুরো হত। কিন্তু বাংলাদেশে ছেলে বুড়ো এমন কেউ নেই যে আপনিই "বিয়ে-- হবে' স্বরে টান না দেয়।

বক ধলো, বস্ত্র ধলো, ধলো রাজহংস,
তাহার অধিক ধলো কন্যে তোমার হাতের শঙ্খ।

দুটো লাইনের মাত্রার কমি-বেশি স্পষ্ট; কিন্তু ভয়ের কারণ নেই, স্বতই আবৃত্তির টানে দুটো লাইনের ওজন মিলে যায়। ছন্দে চলতি ভাষা আইন জারি না করেও আইন মানিয়ে নিতে পারে।

ছেলে ভোলাবার ছড়া শুনলে একটা কথা স্পষ্ট বোঝা যায়, এতে অর্থের সংগতির দিকে একটুও দৃষ্টি নেই, দৃষ্টি দেবার দরকার বোধ করা হয় নি। যুক্তিবাঁধন-ছেঁড়া ছবিগুলো ছন্দের ঢেউয়ের উপর টগ্‌বগ্‌ করে ভেসে উঠছে, ভেসে যাচ্ছে। স্বপ্নের মতো একটা আকস্মিক ছবি আর-একটা ছবিকে জুটিয়ে আনছে। একটা শব্দের অনুপ্রাসে হোক বা আর-কোনো অনির্দিষ্ট কারণে হোক, আর-একটা শব্দ রবাহূত এসে পড়ছে। আধুনিক য়ুরোপীয় কাব্যে অবচেতন চিত্তের এই- সমস্ত স্বপ্নের লীলাকে স্থান দেবার একটা প্রেরণা দেখা যায়। আধুনিক মনস্তত্ত্বে মানুষের মগ্নচৈতন্যের সক্রিয়তার উপর বিশেষ দৃষ্টি পড়েছে। চৈতন্যের সতর্কতা থেকে মুক্তি দিয়ে স্বপ্নলোকের অসংলগ্ন স্বতঃসৃষ্টিকে কাব্যে উদ্ধার ক'রে আনবার একটা প্রয়াস দেখতে পাই। নীচের ছড়াটির মতো এই জাতের রচনা কোনো আধুনিক কবির হাত দিয়ে বেরিয়েছে কি না জানি নে। খবর যা পেয়েছি তাতে জানা যায়, এর চেয়ে অসংলগ্ন কাব্যের অভ্যুদয় হয়েছে--

নোটন নোটন পায়রাগুলি ঝোটন রেখেছে,
বড়ো সাহেবের বিবিগুলি নাইতে এসেছে।
দু পারে দুই রুই কাৎলা ভেসে উঠেছে,
দাদার হাতে কলম ছিল ছুঁড়ে মেরেছে।
ও পারেতে দুটি মেয়ে নাইতে নেবেছে,
ঝুনু ঝুনু চুলগাছটি ঝাড়তে নেগেছে।
কে দেখেছে ,কে দেখেছে, দাদা দেখেছে।
আজ দাদার ঢেলা ফেলা, কাল দাদার বে।
দাদা যাবে কোন্‌খান দে, বকুলতলা দে।
বকুল ফুল কুড়োতে কুড়োতে পেয়ে গেলুম মালা।
রামধনুকে বাদ্দি বাজে সীতেনাথের খেলা।
সীতেনাথ বলে রে ভাই, চালকড়াই খাব।
চালকড়াই খেতে খেতে গলা হল কাঠ,
হেথা হোথা জল পাব চিৎপুরের মাঠ।
চিৎপুরের মাঠেতে বালি চিক্‌চিক্‌ করে,
চাঁদমুখে রোদ নেগে রক্ত ফেটে পড়ে।

সুদূর কাল থেকে আজ পর্যন্ত এই কাব্য যারা আউড়িয়েছে এবং যারা শুনেছে তারা একটা অর্থের অতীত রস পেয়েছে; ছন্দতে ছবিতে মিলে একটা মোহ এনেছে তাদের মনের মধ্যে। সেইজন্যে অনেক নামজাদা কবিতার চেয়ে এর আয়ু বেড়ে চলেছে। এর ছন্দের চাকা ঘুরে চলেছে বহু শতাব্দীর রাস্তা পেরিয়ে।

আদিম কালের মানুষ তার ভাষাকে ছন্দের দোল লাগিয়ে নিরর্থক নাচাতে কুণ্ঠিত হয় নি। নাচের নেশা আছে তার রক্তে। বুদ্ধি যখন তার চেতনায় একাধিপত্য করতে আরম্ভ করেছে, তখনি সে নেশা কাটিয়ে উঠে মেনেছে শব্দের সঙ্গে অর্থের একান্ত যোগ। আদিম মানুষ মন্ত্র বানিয়েছে, সে মন্ত্রের শব্দে অর্থের শাসন নেই অথবা আছে সামান্য। তার মন ছন্দে দোলায়িত ধ্বনির রহস্যে ছিল অভিভূত। তার মনে ধ্বনির এই-যে সম্মোহনপ্রভাব, দেবতার উপরে, প্রাকৃতিক শক্তির উপরেও তার ক্রিয়া সে কল্পনা করত। তাই সাঁওতাল প্রভৃতি আদিম জাতির অনেক গানের শব্দে অর্থ হয়েছে গৌণ; অর্থের যে আভাস আছে সে কেবল ধ্বনির গুণে মনের মধ্যে মোহ বিস্তার করে, অর্থাৎ কোনো স্পষ্ট বার্তার জন্যে তার আদর নয়, ব্যঞ্জনার অনির্দেশ্যতাই তাকে প্রবলতা দেয়। মা তার ছেলেকে নাচাচ্ছে--

থেনা নাচন থেনা,
বট পাকুড়ের ফেনা।
বলদে খালো চিনা, ছাগলে খালো ধান,
সোনার জাদুর জন্যে যায়ে নাচ্‌না কিনে আন্‌।

এর মধ্যে খানিকটা অর্থহীন ধ্বনি, খানিকটা অর্থবান ছবির টুকরো নিয়ে যে ছড়া বানানো হয়েছে তাতে আছে সেই নাচন যে নাচন স্বপ্নলোকে কিনতে পাওয়া যায়।

এই-যে ধ্বনিতে অর্থে মিলে মনের মধ্যে মোহাবেশ জাগিয়ে তোলা, এটা সকল যুগের কবিতার মধ্য দিয়েই কমবেশি প্রকাশ পায়; তাই অর্থের প্রবলতা বেড়ে উঠলে কবিতার সম্মোহন যায় কমে। ধ্বনির ইশারা দিয়ে যায় নিজেকে অভাবনীয় রূপে সার্থক করে তোলে, শিক্ষকের ব্যাখ্যার দ্বারা তা যখন সমর্থনের অপেক্ষা করে তখন কবিতার মন্ত্রশক্তি হারায় তার গুণ। ছন্দ আছে জাদুর কাজে, খেয়াল গেলে বুদ্ধিকে অগ্রাহ্য করতে সে সাহস করে।

সাহিত্যের মধ্যে কারুকাজ, কাব্যে যার প্রাধান্য, তার একটা দিক হচ্ছে শব্দের বাছাই-সাজাই করা। কালে কালে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ভাষায় শব্দ জমে যায় বিস্তর। তার মধ্যে থেকে বেছে নিতে হয় এমন শব্দ যা কল্পনার ঠিক ফরমাশটি মানতে পারে পুরো পরিমাণে।

রামপ্রসাদ বলেছেন : অমি করি দুখের বড়াই। "বড়াই'-বর্গের অনেক ভারি ভারি কথা ছিল : গর্ব করি, গৌরব করি, মাহাত্ম্য বোধ করি। কিন্তু "দুঃখকেই বড়ো ক'রে নিয়েছি' বলবার জন্যে অমন নিতান্ত সহজ অর্থাৎ ঠিক কথাটি বাংলাভাষায় আর নেই।

যেমন আছে শব্দের বাছাই তেমনি আছে ভাবপ্রকাশের বাছাইয়ের কাজ।

বাউল বলতে চেয়েছে, চার দিকে অচিন্তনীয় অপরিসীম রহস্য, তারই মধ্যে চলেছে জীবনযাত্রা। সে বললে--

পরান আমার স্রোতের দীয়া
(আমায় ভাসাইলা কোন্‌ ঘাটে)।
আগে আন্ধার পাছে আন্ধার, আন্ধার নিসুইৎ-ঢালা।
আন্ধারমাঝে কেবল বাজে লহরেরি মালা।
তার তলেতে কেবল চলে নিসুইৎ রাতের ধারা,
সাথের সাথি চলে বাতি, নাই গো কূলকিনারা।

নানা রহস্যে একলা-জীবনের গতি, যেন চার দিকের নিসুৎ অন্ধকারে স্রোতে-ভাসানো প্রদীপের মতো-- এমন সহজ উপমা মিলবে কোথায়। একটা শব্দ-বাছাই লক্ষ্য করা যাক : লহরেরি মালা। ঊর্মি নয়, তরঙ্গ নয়, ঢেউ নয়, শব্দ জাগাচ্ছে জলে ছোটো ছোটো চাঞ্চল্য, ইংরেজিতে যাকে বলে ripples। অন্ধকারের তলায় তলায় রাত্রির ধারা চলেছে, এ ভাবটা মনে হয় যেন আধুনিক কবির ছোঁয়াচ-লাগা। রাত্রি স্তব্ধ হয়ে আছে, এইটেই সাধারণত মুখে আসে। তার প্রহরগুলি নিঃশব্দ নির্লক্ষ্য স্রোতের মতো বয়ে চলেছে, এ উপমাটায় হালের টাঁকশালের ছাপ লেগেছে বলেই মনে হয়।

শব্দ-বাছাই ভাব-বাছাইয়ের শিল্পকাজ চলেছে পৃথিবীর সাহিত্য জুড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ছন্দে চলেছে ধ্বনির কাজ। সেটা গদ্যে চলে অলক্ষ্যে, পদ্যে চলে প্রত্যক্ষে।

মুখে মুখে, প্রতিদিনের ব্যবহারে, ভাষায় কলাকৌশলের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মানুষ দলবাঁধা জীব। একলার ব্যবহারে সে আটপৌরে, দলের ব্যবহারে সুসজ্জিত। সকলের সঙ্গে আচরণে মানুষের যে সৌজন্য সেই তার ব্যবহারের শিল্পকার্য। তাতে যত্নপূর্বক বাছাই সাজাই আছে। সর্বজনীন ব্যবহারে ব্যক্তিগত খেয়ালের যথেচ্ছাচার নিন্দনীয়। এ ক্ষেত্রে মানুষ নিজেকে ও অন্যকে একটা চিরন্তন আদর্শের দ্বারা সম্মান দেয়। সাহিত্যকে কাদাচিৎ শ্রীভ্রষ্ট সৌজন্যভ্রষ্ট করায় প্রকাশ পায় সমাজের বিকৃতি, প্রকাশ পায় কোনো সাময়িক বা মারাত্মক ব্যাধির লক্ষণ।

ভাষা অবতীর্ণ হয়েছে মানুষকে মানুষের সঙ্গে মেলাবার উদ্দেশ্যে। সাধারণত সে মিলন নিকটের এবং প্রত্যহের। সাহিত্য এসেছে মানুষের মনকে সকল কালের সকল দেশের মনের সঙ্গে মুখোমুখি করাবার কাজে। প্রাকৃত জগৎ সকল কালের সকল স্থানের সকল তথ্য নিয়ে, সাহিত্যজগৎ সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষের কল্পনা-প্রবণ মন নিয়ে। এই জগৎ-সৃষ্টিতে যে-সকল বড়ো বড়ো রূপকার আপন বিশ্বজনীন প্রতিভা খাটিয়েছেন সেই-সব সৃষ্টিকর্তাদেরকে মানুষ চিরস্মরণীয় বলে স্বীকার করেছে। বলেছে তাঁরা অমর। পঞ্জিকার গণনা অনুসারে অমর নয়। মাহেঞ্জোদারোর ভগ্নাবশেষ যখন দেখি তখন বোঝা যায়, তারই মতো এমন অনেক সভ্যতা মাটির তলায় লুপ্ত হয়ে গেছে। সেদিনকার বিলুপ্ত সভ্যতাকে যাঁরা একদিন বাণীরূপ দিয়েছিলেন তাঁদের সেই বাণীও নেই, সেই স্মৃতিও নেই। কিন্তু যখন তাঁরা বর্তমান ছিলেন তখন তাঁদের কীর্তির যে মূল্য ছিল সে কেবল উপস্থিত কালের নয়, সে নিত্যকালের। সকল কালের সকল মানুষের চিত্তমিলনবেদিকায় উৎসর্গ করা তাঁদের দান সেদিন অমরতার স্বাক্ষর পেয়েছিল, আমরা সে সংবাদ জানি আর নাই জানি।

৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন

বাংলা ভাষা - শিবলি আজাদ।

এক,

বাংলা ভাষা দুর্বল, তার চিন্তাশক্তি নেই, তার শব্দসম্ভার কম, তার ফ্ল্যেক্সিবিলিটি নেই, বাংলাতে লিখতে গেলে টেকনিক্যাল বা পরিভাষা পাওয়া যায়না, এমনতর অভিযোগ বহু পুরনো, এবং ক্ষেত্র বিশেষে, এ ধরণের আক্ষেপ সঠিক ও বাস্তব হলেও সামগ্রিক বিচারে এসব অভিযোগ ঠুনকো অজুহাত মাত্র। এসকল অভিযোগ বা বক্তব্যের অর্থ এই নয় যে, বাংলা ভাষাটাই দায়ী; এর অর্থ হল, বর্তমান সময়ে বরং এই ভাষা ব্যাবহারকারীদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও ভাষার প্রায়োগিক বিষয়গুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব কিছু সমস্যা রয়েছে, ভাষার নয়, যে সমস্যা আবার জনগোষ্ঠী হিশেব তাদের সাম্প্রতিক ম্যাটেরিয়াল জীবনের দৈন্য নির্দেশ করে। বাংলা ভাষা নিজে কোন সমস্যা নয়, যদি এমন হত যে বাংলাভাষীরা খুবই প্রতিভাবান, ফুটন্ত মেধার কারণে ছটফট করছে, কিন্ত দুর্বল বাংলা ভাষার জন্য তারা ভাব প্রকাশ করতে পারছে না, সেক্ষেত্রে বাংলাভাষীরা অন্তত ইংরেজিতে লেখে দুনিয়া কাঁপাতে পারতো, যেহেতু, শিক্ষিত সকল বাংলাভাষী কমবেশী ইংরেজি জানেন। কিন্ত, সেটাওতো হচ্ছে না। এ কথা সতঃসিদ্ধ যে, উন্নত জনগোষ্ঠীর ভাষা উন্নত হতে বাধ্য, মানব ইতিহাসের কোন কালপর্বে এমন ঘটনা ঘটেনি যে, ভীষণ উন্নত একটি জাতির ভাষা অনুন্নত ছিল, বা আছে। ইতিহাসের সকল কালপর্বে, বিশ্বকে নেতৃত্বদানকারী সকল জাতির ভাষা ছিল তার সময়ের সবচেয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধতম ভাষা; যে জাতি যখন যত উন্নত, তার ভাষাও তখন তত উন্নত। এর কোন ব্যাত্যয় নেই।

দুই,

মনে রাখতে হবে, ভাষা আপনা আপনি তৈরি হয় না, উন্নত ভাব প্রকাশের বাহন হয় না; একটি ভাষা উন্নত হয় ঐ ভাষা ব্যাবহারকারীদের জন্যে। ইংরেজি বা অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষা আজ উন্নত (যেমন অতীতে ছিল গ্রীক, ল্যাটিন, সংস্কৃত, ম্যান্ডারিন, বা নিকট অতীতে আরবী, ফার্সি, কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে উর্দু), যেহেতু হাজার বছর ধরে এই ভাষাগুলোর ব্যাবহারকারীরা, এবং এসব জনগোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবানেরা এসকল ভাষাকে তাদের ভাব প্রকাশের বাহন হিশেবে ব্যাবহার করেছেন এবং এখনো করছেন। ফলে, বিচিত্র লঘুগুরু ভাব প্রকাশের জন্য এসকল ভাষা যথার্থভাবে বিকশিত হয়েছে। নিজস্ব সামাজিক বিকাশের দুর্বলতার জন্য, বাংলার শিক্ষিত জনগোষ্ঠী শুরু থেকেই ইংরেজি নির্ভর; সবচে বড় কথা, অন্যান্য জাতির মত নিজ জনগোষ্ঠীর এই দুর্বলতাকে ওভরকাম করার কোন সচেতন প্রয়াসও তারমধ্যে নেই; এই প্রচেষ্টাহীনতা, আমার মতে, এই জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য; যা হবার হবে, যেভাবে চলছে চলুক, আমার কী আসে যায়, এমনতর মানসিকতার জনগোষ্ঠী বাঙ্গালীর মত আর দুটি নেই এই দুনিয়াতে।

তিন,

বাংলা দুর্বল ভাষা, এ ধারণা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে বোধশক্তিহীন অর্বাচীনের বক্তব্য; সমস্য হল, গত পঞ্চাশ বছর ধরে বাঙলাভাষী এলিটরা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ও রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বকে ভাষার দোষ বলে বিশ্বাস করা শুরু করেছে। যদি বাঙলা গদ্যের খবর নেই, বিশেষ করে এর বুদ্ধিবৃত্তিক ও তাত্ত্বিক লেখাজোখার, তবে মনে রাখতে হবে, এই ভাষায়, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তরকালে, গত কয়েক দশকে সুকুমারী ভট্টাচার্য, অশীন দাশগুপ্ত, রণজিৎ গুহ, সুমিত সরকার, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ভদ্র, দীপেশ চক্রবর্তী, আদিত্য মুখোপাধ্যায়, অরিন্দম চক্রবর্তী, পল্লব দাশগুপ্ত, অমল বন্দোপাধ্যায়, অমিয় বাগচী, কৌশিক বসু, প্রমুখ গভীর তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন এবং করছেন; এরা সকলেই বিশ্ববিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, সেসকল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন, কিংবা এখনো পড়ান; এবং ইংরেজিতে লিখেই তাত্ত্বিক হিশবেই প্রথমে তারা জগতবিখ্যাত হয়েছেন।

একই কথা বলা চলে এঁদের পূর্বসূরিদের সম্পর্কে; অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্য যে, উনবিংশ শতাব্দী ও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেও বাংলায় প্রবন্ধ ও গবেষণাপত্র লিখেছেন এমন অনেক প্রতিভা ছিলেন বিশ্বমাপের। অনেক অনেক নামের ভিড়ের মধ্যে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, ব্রজেন শীল, বিনয়কুমার সরকার, ক্ষিতিমোহন সেন, হরিদাস ভট্টাচার্য, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন সরকার, শঙ্করী প্রসাদ বসু, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, হুমায়ন কবির, বিমল কৃষ্ণমতিলালের মত আরও কয়েক ডজন নাম নেয়া যায়, যারা সবাই তাদের তীক্ষ্ণ মেধার জন্যে এবং নিজ নিজ বিষয়ে মৌলিক গবেষণামুলক অবদান রাখার জন্যে আন্তরজাতিক ভাবে খ্যাত। অর্থাৎ, ভাষার সমস্যা নেই, বাঙলাতে যেকোনো জটিল তাত্ত্বিক আলোচনা সম্ভব। এখন শুধু প্রয়োজন নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিক ডিসক্যার্সিভ বাংলা গদ্য লেখার ধারাক্রম তৈরি করা ও সেই ধারাকে বলবান করার জন্য বাংলায় বিষয়ভিত্তিক প্রফেশনাল জার্নাল বের করা, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা লিখবেন নিজেদের তাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের জন্য। যত বেশি বেশি লেখা হবে, ভাষা তত বেশি বিকশিত হবে।

চার,

পরিভাষার সমস্য? প্রশ্ন হল, পরিভাষা তৈরির প্রয়োজনীয়তা কী ? আর সেটা করবেই বা কে? তার সার্বজনীন গ্রহনযোগ্যতা দেবে কে ? ফ্রান্সের একাদেমি ঐতিহাসিক ভাবে একাজ করে এসেছে, ফরাসি ভাষার জন্য; ফরাসি ইতিহাসের জগতবিখ্যাত ব্যাক্তিরা এই কাজে ব্যাপৃত ছিলেন বলে ওই অ্যাকাদেমির গ্র্যাহ্যতা ছিল এবং ফরাসি ভাষা রেগুলেট করতে তারা সফল হয়েছিল। অর্থাৎ, যোগ্যতা ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ের কারনে ওই আকাদেমি সফল হলেও, বাংলায় তা ব্যর্থ হয়েছে ঠিক এই দুই গুনের অনুপস্থিথির কারনে। অপদার্থ আর মূর্খের আস্তানা বাংলাদেশের বাংলা একাদেমি। পশ্চিম বঙ্গের বাংলা একাদেমি বিখ্যাত তার রাবীন্দ্রিক গদাইলস্করী চালের জন্য; আর বাংলাদেশেরটা তাদের আকাশচারী গণ্ডমূর্খতার জন্য। এতএব, এদের কাজের কোন সার্বজনীন গ্রহনযোগ্যতা আগে যেমন ছিলনা, আজও তেমনি নেই, এবং ভবিষ্যতেও যে থাকবে না, তা হলফ করে বলা যায়; কেননা, সুশিক্ষিত লোকেরা এসকল সরকারী নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে আসবে না, আসতে পারবে না, বা সহজ করে বললে, তাদের আসতে দেয়া হবে না। সেটাই ভাল, এতে বাংলা ভাষা রেগুলেশনের জঞ্জাল আর আপদ মুক্ত থাকলো।

তো কী করবে বাংলা ভাষা? উত্তর খুবই সোজা—সে চলবে তার আপন স্বভাবে। ইংরেজি ভাষার বৈশিস্ট্য হোল অন্য ভাষার শব্দ দ্রুত আত্তীকরন করা, বাংলা ভাষাও তা করে থাকে, তবে ইংরেজির মত অতো দ্রুত নয়; বেচারার হজম শক্তি একটু দুর্বল, তাই একটু সময় নেয়, তবে সবই হজম করে ফেলে, সর্বভুক এই ভাষা। কে আজ খবর রাখে যে, স্বয়ং “খবর” শব্দের উৎপত্তি আরবী, বা “কলম” কিংবা “বই” আদতে আরবী শব্দ? “দাদা-নানা” তুর্কী ? গরমের দিনে ফালুদা খান? আর শীতে গরম গরম ফিরনী ? তবে জেনে রাখুন, “ফালুদা” ফার্সি আর “ফিরনী” তুর্কী শব্দ; খানাপিনার (কী সুন্দর উর্দু–ফার্সির যুগলবন্দী) কথাই যখন এলো, তখন যেনে নেয়া ভাল যে, আজকাল অনেকই প্রগতির আশায় কিংবা নিরেট আমোদ করার জন্যে ইংরেজির আশ্রয় নিয়ে একটু-আধটু “ড্রিঙ্ক” করে থাকেন, হোক সে দেশী ধেন্যু কিংবা বিলাতী হুইস্কী। আবার দেখুন, ছোট ভাইয়ের সাথে মারামারীতে পারছেন না, আব্বাকে ডাকবেন ? আরে বাবা, “আব্বা” শব্দটাতো হিব্রু!

বলাবাহুল্য, বাংলা ভাষার দশ শতাংশ শব্দ এভাবেই বিদেশী ভাষা থেকে এসেছে, তো আরো আসতে অসুবিধা কী? আসলে সমস্যাটা আমাদের, যে সমস্যাটা আসলে কৃত্তিমঃ দৈনন্দিন জীবনে মুখের কথায় আমরা প্রচুর সমসাময়িক ইংরেজি শব্দ ব্যাবহার করলেও, লেখার সময় থাকি কুণ্ঠিত; যদিও, অনেক পুরনো আত্তীকৃত শব্দ না জেনে ব্যবহারে আমাদের কোনই আপত্তি নেই। ভাষার ছুঁচিবায়ুগ্রস্ততা মুলত গণ্ডমূর্খতা, এটা কুপমন্ডুকতার আরেক নাম। যা করণীয়, তা হোল কাণ্ডজ্ঞান বজায় রাখা, এবং যে শব্দই প্রয়োজন, তা চোখ-কান বুঝে বাংলাতে ব্যাবহার করা, হোক সে যেকোনো ভাষার শব্দ। উচ্চশিক্ষায় এক্ষেত্রে ইংরেজি টেকনিক্যাল টার্ম বা শব্দগুলো যথা সম্ভব আত্তীকরণ করে বাংলা হরফে লিখে নিলেই চলবে; বহুল ব্যবহারে, ধীরে ধীরে সেসকল শব্দের পরিচিতি লাভ ঘটবে; একটু সময় লাগবে, কিন্তু, হবে। আরেকটা কথা, উচ্চশিক্ষার টেকনিক্যাল শব্দ শুধু ঐ বিষয়ের ছাত্রশিক্ষক আর পেশাজীবীদের প্রয়োজন, আমজনতার সেসব শব্দ বোঝার প্রয়োজন নেই (যদি না সে সে বিষয় শিখতে চায়) বলে উচ্চশিক্ষার টেকনিক্যাল শব্দের অতিসরলীকরণ অপ্রয়োজনীয়।

পাচ,

বাঙালীর বাংলা ভাষা ব্যবহার করার প্রবণতার তুলানায় মার্কিনীদের ইংরেজি ভাষার ভাংচুর করার প্রবণতা তফাত করতে গিয়ে বিবেকানন্দ বলেছিলেন যে, জ্যান্ত মানুষের ভাষা হয় জ্যান্ত; বিবেকানন্দের মতে, মার্কিনীরা জ্যান্ত, বাঙালীরা মরা। বিবেকানন্দকে ধার করে আমিও বলি, আজকের দিনে অনেকের আধুনিক গদ্যের বাংলা মৃতবৎ এ জন্য যে, বাংলাভাষী অধিকাংশই আসলে মনের জগতে এক একজন মৃত সত্ত্বা; মড়ার ভাষা তো আড়ষ্ট হবেই।

ছয়,

বাংলা ভাষায় চিন্তাচর্চার বাধ তখনই ভাঙ্গবে যখন ইংরেজি, ফরাসি, বা জার্মানের মত এই ভাষায় চিন্তাচর্চার বানিজ্যিকরন হবে। ঘাবড়াবেন না। চিন্তার বানিজ্যিকরন মানে নোটবইয়ের বন্যা বা কোচিং সেন্টারের প্রাদুর্ভাব না, এর মানে লেখাপড়ায় প্রফেশনালিসমের বিকাশ—ব্যাপক পড়াশোনা, গবেষণা, চিন্তাভাবনা, জর্নলে গবেষণা প্রবন্ধ ছাপানো, আর বই লেখা, যার ইনকাম দিয়ে একজন লেখক জীবন ধারন করে থাকে এবং পাঠক সে লেখা পড়ে জানে, বুঝে, শিখে। ভাবুক, কবি, বা লেখক না খেয়ে কষ্ট করবে, বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে, তার সংসার উচ্ছনে যাবে, তার স্ত্রী-সন্তানরা পথে বসবে, আর আমরা উহু আহা করব, আর আলু-ফালুরা সমাজ চালাবে, এই চিন্তাটা অস্বাভাবিক, অপ্রাকৃতিক, ও মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ। সব উন্নত দেশেই ভাল লেখকরা বই লিখে প্রচুর ইনকাম করেন; প্রকাশক আগাম টাকা দেন, ছয়-সাত ডিজিটে, যা সারা জীবনের জন্য জীবন ধারণের পক্ষে যথেষ্ট; এজন্য, এরা কয়েক বছর ধরে গবেষণা করে তারপর লেখেন এবং এজন্য এদের প্রতিটা লেখাই অসাধারণ । বছরে ১৪/১৫ টি বই লিখতে হলে, আর যাই হোক, মান রক্ষা হয় না, বরং দাউদকান্দীর মলমের মত একটা কিছু হয়, সাময়িক তৃপ্তি হলেও তাতে চূড়ান্ত তৃষ্ণা মেটে না, বা কাজও উদ্ধার হয় না। তেমনি, সকল, বিশেষ করে, বেশী সফল অধ্যাপকেরাও, বই লিখে বিপুল উপার্জন করতে সক্ষম বলেই নিবিষ্টমনে গভীর ও ব্যাপক গবেষণায় তারা জীবন পার করতে পারেন।

এ ব্যাপারে একটু ব্যাক্তিগত প্রসঙ্গের অবতারণা করছি। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সকল শিক্ষকই ইউনিভারসিটির বেতন ছাড়াও যে টাকা রয়্যালটি থেকে পেতেন, তার পরিমাণ শুনলে আক্ষরিক অর্থেই চোখ গাছে উঠবে। আমার সরাসরি দুই শিক্ষক নোবেল প্রাইজ পাবার আগেই বছরে ৫/৭ মিলিয়ন ডলারেরও বেশী করে কামাতেন; এদের একজন, জোসেফ স্টিগল্টীযকে ২০০১ সালে বিশ্বখ্যাত পাবলিশার নর্টন কয়েক মিলিয়ন ডলার আগাম দেয়, গ্লোবালাইজেশন নিয়ে তিন খণ্ডে বই লেখার জন্য। তার তিন খণ্ডের সেই বই (Globalization and Its Discontent, The Roaring Nineties, and Making Globalization Work) আজ ক্ল্যাসিক বলে গন্য। টাকা যেখানে আছে, সেখানে ধীরে হলেও, কোয়ালিটি আসতে বাধ্য; পয়সা দিয়ে কেউ বাজে জিনিষ নেয় না; আর বারবারতো ভুষিমাল দিয়ে সবাইকে বোকা বানানো সম্ভব না। অর্থাৎ, লেখাটাও হতে হবে পুজির নিয়ম মেনে, পুঁজিবাদের নিয়মই হোল প্রতিযোগিতা, শ্রেষ্ঠত্বের সাধনা, কেননা শ্রেষ্ঠরাই টিকে থাকে বাজারে; অতএব, সেটাই কাম্য বাঙলার ক্ষেত্রেও। বাঙলীরা মানবরীতির বাইরে নয়, বাংলাভাষাকেন্দ্রিক সাহিত্য, ফিকশন কী নন-ফিকশন, লঘু কী গুরু, তাই পুজির বাইরে থাকতে পারে না।

সাত,

আবারও বিবেকানন্দঃ জ্যান্ত মানুষের ভাষা হয় জ্যান্ত; বাঙলাভাষী, তুমি কী জ্যান্ত ?

লেখক ঃ শিবলি আজাদ