আজিকার শিশু – বেগম সুফিয়া কামাল

(কবি সুফিয়া কামাল এর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা পূর্বক......)


আমাদের যুগে আমরা যখন পরীক্ষার সময় পড়িতাম ঘরে,
তোমাদের এ যুগে তোমরা এখন ঘোরাঘুরি করো ইন্টারনেট ধরে।
আমাদের যুগে আমরা যখন থাকতাম প্রাইভেট টিচারের কাছে ,
তোমাদের এ যুগে তোমরা এখন থাকো ফেসবুক ইনবক্স পাছে ।
আমাদের যুগে নকল হলেই খেয়ে যেতাম কেইস,
তোমাদের যুগে তোমরা এখন খুঁজেই বেড়াও প্রশ্ন পত্রের পেইজ।
আমাদের যুগে সাজেশন নিতেই খেয়ে যেতাম বাঁশ,
তোমাদের এ যুগে প্রতিদিন ই – তাহা প্রশ্ন হচ্ছে ফাঁস।
সত্যি ই তোমরা ডিজিটাল হয়েছো জাতিকে দিয়েছো বাঁশ,
বুঝবে একদিন তোমাদের অধঃপতনের গোপন দীর্ঘশ্বাস।
২৫/ ১১/১৪

BY : Merely Nayamul

বাংলাভাষা পরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৩)

আমাদের দেহের মধ্যে নানাপ্রকার শরীরযন্ত্রে মিলে বিচিত্র কর্মপ্রণালীর যোগে শক্তি পাচ্ছে প্রাণ সমগ্রভাবে। আমরা তাদের বহন করে চলেছি কিছুই চিন্তা না করে। তাদের কোনো জায়গায় বিকার ঘটলে তবেই তার দুঃখবোধে দেহব্যবস্থা সম্বন্ধে বিশেষ করে চেতনা জেগে ওঠে।

আমাদের ভাষাকেও আমরা তেমনি দিনরাত্রি বহন করে নিয়ে চলেছি। শব্দপুঞ্জে বিশেষ্যে বিশেষণে সর্বনামে বচনে লিঙ্গে সন্ধিপ্রত্যয়ে এই ভাষা অত্যন্ত বিপুল এবং জটিল। অথচ তার কোনো ভার নেই আমাদের মনে, বিশেষ কোনো চিন্তা নেই। তার নিয়মগুলো কোথাও সংগত কোথাও অসংগত, তা নিয়ে পদে পদে বিচার ক'রে চলতে হয় না।

আমাদের প্রাণশক্তি যেমন প্রতিনিয়ত বর্ণে গন্ধে রূপে রসে বোধের জাল বিস্তার করে চলেছে, আমাদের ভাষাও তেমনি সৃষ্টি করছে কত ছবি, কত রস-- তার ছন্দে, তার শব্দে। কত রকমের তার জাদুশক্তি। মানুষ যখন কালের নেপথ্যে অন্তর্ধান করে তখনো তার বাণীর লীলা সজীব হয়ে থাকে ইতিহাসের রঙ্গভূমিতে। আলোকের রঙ্গশালায় গ্রহতারার নাট্য চলেছে অনাদিকাল থেকে। তা নিয়ে বিজ্ঞানীর বিস্ময়ের অন্ত নেই। দেশকালে মানুষের ভাষারঙ্গের সীমা তার চেয়ে অনেক সংকীর্ণ, কিন্তু বাণীলোকের রহস্যের বিস্ময়করতা এই নক্ষত্রলোকের চেয়ে অনেক গভীর ও অভাবনীয়। নক্ষত্রলোকের তেজ বহুলক্ষ তারা-চলার পথ পেরিয়ে আজ আমাদের চোখে এসে পৌঁছল; কিন্তু তার চেয়ে আরও অনেক বেশি আশ্চর্য যে, আমাদের ভাষা নীহারিকাচক্রে ঘূর্ণ্যমান সেই নক্ষত্রলোককে স্পর্শ করতে পেরেছে।

আমাকে কোনো ভাষাতাত্ত্বিক অনুরোধ করেছিলেন আমার এই প্রকাশোন্মুখ বইখানিতে আমি যেন ভাষাবিজ্ঞানের ভূমিকা করে কাজ আরম্ভ করি। তার যে উত্তর দিয়েছিলুম নিম্নে তা উদ্‌ধৃত করে দিই। সেটা পড়লে পাঠকেরা বুঝবেন আমার বইখানি তত্ত্বের পরিচয় নিয়ে নয়, রূপের পরিচয় নিয়ে।--

আমার পক্ষে যা সবচেয়ে দুঃসাধ্য তাই তুমি আমাকে ফরমাশ করেছ। অর্থাৎ মানুষের মূর্তির ব্যাখ্যা করবার ভার যে নিয়েছে তাকে তুমি মানুষের শরীরবিজ্ঞানের উপদেষ্টার মঞ্চে চড়াতে চাও। অহংকারে মানুষকে নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে অন্ধ করে-- মধুসূদনের কাছে আমার প্রার্থনা এই যে, দর্পহরণ করবার প্রয়োজন ঘটবার পূর্বেই তিনি আমাকে যেন কৃপা করেন। আমার এ গ্রন্থে ব্যাকরণের বন্ধুর পথ একেবারেই এড়াতে পারি নি, প্রতি মুহূর্তে পদস্খলনের আশঙ্কায় কম্পান্বিত আছি। ভয় আছে, পাছে আমার স্পর্ধা দেখে তাত্ত্বিকেরা "হায় কৃষ্টি' "হায় কৃষ্টি' ব'লে বক্ষে করাঘাত করতে থাকেন। কোনো কোনো বিখ্যাত রূপশিল্পী শারীরতত্ত্বের যাথাতথ্যে ভুল করেও চিত্রকলায় প্রশংসিত হয়েছেন, আমার বইখানি যদি সেই সৌভাগ্য লাভ করে তা হলেই ধন্য হব।

১৬|১১|৩৮

৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন

Bangladesh Rising




(Every year Nat Geo honors ten individuals from the world under different categories, and it's an elite group of explorers and adventure seekers in the past who's been included in this prestigious award list, mostly made up of westerners. In their words, they selected our WASFIA "for her activism and commitment to empowering women through her work in the field of adventure."

Hardly anyone from Asia is in the list and of course the first from Bangladesh.

Additionally, there is a second award called the People's Choice Award where one can vote everyday for each of the ten individuals - One can vote everyday from now to January)

--

জীবনে, অনেকক তো ভোট দিলাম

৪৩ বছর থেকেই তো দেশকে পরিচিত করতে চাচ্ছি বিশ্বের কাছে

১ পা আগাই... ২ পা পিছাই

পরিবর্তন ‘আসবে আসবে আসবে আসবে’ করতে করতে মাঝে মাঝে ভুলে যাই যে; "আমরাই হলাম পরিবর্তন, we are THE change"

বিশ্বজুড়ে যারা এডভেঞ্চার এবং এক্সপ্লোর করে আসছে, এরকম বেঁছে বেঁছে ১০ জনকে NAT GEO প্রতি বছর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সম্মাননা দেয়

এবার, পুরো এশিয়া থেকে আমাদের ওয়াসফিয়া তার দুঃসাহসী অভিযানের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে নিজের অঙ্গীকার ও কর্মতৎপরতার জন্য সেলেক্টেড হয়েছে

গর্ব করার মতো ব্যাপার

এখানে একটা People's Choice Award আছে ... আপনারা চাইলে তাকে ভোট দিতে পারবেন এই লিঙ্কে যেয়ে http://on.natgeo.com/1E8oMz3

একটু আগে তার সাথে আলাপ হলো... প্রচন্ড খুশি সে... দেশ বিদেশ থেকে প্রচুর টুইট, ইনবক্স, ম্যাসেজ আসছে তার কাছে... কয়েকজন তো বিদেশ থেকে ফোন করে হাউমাউ করে কেঁদে দিয়েছে খুশিতে

কিন্তু চোখ মুছতে মুছতে টেলিফোন রেখে, তারা ভোট দিতে ভুলে গেছে

... দেশ আগাবে কেমনে?

আবেগ সাইডে রেখে আসেন এবার বেগের সহিত ভোট দিতে থাকি

চলুক

বিশ্ব চিনুক ... জানুকক ... #BangladeshRising


লেখক ঃ আরিফ আর হোসাইন

এক বছরের রাজা - সুকুমার রায়

এক ছিলেন সওদাগর— তাঁর একটি সামান্য ক্রীতদাস তাঁর একমাত্র ছেলেকে জল থেকে বাঁচায়। সওদাগর খুশি হয়ে তাকে মুক্তি তো দিলেনই, তা ছাড়া জাহাজ বোঝাই ক'রে নানা রকম বাণিজ্যের জিনিস তাকে বকশিশ দিয়ে বললেন, "সমুদ্র পার হয়ে বিদেশে যাও— এই সব জিনিস বেচে যা টাকা পাবে, সবই তোমার।" ক্রীতদাস মনিবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জাহাজে চড়ে রওনা হল বাণিজ্য করতে।

কিন্তু বাণিজ্য করা আর হল না। সমুদ্রের মাঝখানে তুফান উঠে জাহাজটিকে ভেঙ্গে-চুরে জিনিসপত্র লোকজন কোথায় যে ভাসিয়ে নিল, তার আর খোঁজ পাওয়া গেল না।

ক্রীতদাসটি অনেক কষ্টে হাবুডুবু খেয়ে, একটা দ্বীপের চড়ায় এসে ঠেকল। সেখানে ডাঙ্গায় উঠে সে চারিদিকে চেয়ে দেখল, তার জাহাজের চিহ্নমাত্র নাই, তার সঙ্গের লোকজন কেউ নাই। তখন সে হতাশ হয়ে সমুদ্রের ধারে বালির উপর বসে পড়ল। তারপর যখন সন্ধ্যা হয়ে এল, তখন সে উঠে দ্বীপের ভিতর দিকে যেতে লাগল। সেখানে বড় বড় গাছের বন— তারপর প্রকাণ্ড মাঠ, আর তারই ঠিক মাঝখানে চমৎকার শহর। শহরের ফটক দিয়ে মশাল হাতে মেলাই লোক বার হচ্ছে। তাকে দেখতে পেয়েই সেই লোকেরা চীৎকার ক'রে বলল, "মহারাজের শুভাগমন হোক। মহারাজ দীর্ঘজীবী হউন।" তারপর সবাই তাকে খাতির ক'রে জমকালো গাড়িতে চড়িয়ে প্রকাণ্ড এক প্রাসাদে নিয়ে গেল। সেখানের চাকরগুলো তাড়াতাড়ি রাজপোশাক এনে তাকে সাজিয়ে দিল।

সবাই বলছে, 'মহারাজ','মহারাজ', হুকুম মাত্র সবাই চট্‌পট্‌ কাজ করছে, এসব দেখেশুনে সে বেচারা একেবারে অবাক। সে ভাবল সবই বুঝি স্বপ্ন— বুঝি তার নিজেরই মাথা খারাপ হয়েছে তাই এরকম মনে হচ্ছে। কিন্তু ক্রমে সে বুঝতে পারল সে জেগেই আছে আর দিব্যি জ্ঞানও রয়েছে, আর যা যা ঘটছে সব সত্যিই। তখন সে লোকদের বলল, "এ কি রকম হচ্ছে বল তো? আমি তো এর কিছুই বুঝছি না। তোমরা কেনই বা আমায় 'মহারাজ' বলছ আর কেনই বা এমন সম্মান দেখাচ্ছ?"

তখন তাদের মধ্যে থেকে এক বুড়ো উঠে বলল, "মহারাজ, আমরা কেউ মানুষ নই— আমরা সকলেই প্রেতগন্ধর্ব— যদিও আমাদের চেহারা ঠিক মানুষের মতো। অনেক দিন আগে আমরা, 'মানুষ রাজা' পাবার জন্য সবাই মিলে প্রার্থনা করেছিলাম; কারণ মানুষের মতো বুদ্ধিমান আর কে আছে? সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের মানুষ রাজার অভাব হয়নি। প্রতি বৎসরে একটি ক'রে মানুষ এইখানে আসে আর আমরা তাকে এক বৎসরের জন্য রাজা করি। তার রাজত্ব শুধু ঐ এক বৎসরের জন্যই। বৎসর শেষ হলেই তাকে সব ছাড়তে হয়। তাকে জাহাজে ক'রে সেই মরুভূমির দেশে রেখে আসা হয়, সেখানে সামান্য ফল ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না— আর সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বালি না খুঁড়লে এক ঘটি জলও মেলে না। তারপর আবার নূতন রাজা আসে— এই রকমে বৎসরের পর বৎসর আমাদের চলে আসছে।"

তখন দাসরাজা বললেন, "আচ্ছা বল তো— এর আগে তোমাদের রাজারা কি রকম স্বভাবের লোক ছিলেন?" বুড়ো বলল, "তাঁরা সবাই ছিলেন অসাবধান আর খামখেয়ালি। সারাটি বছর সবাই শুধু জাঁকজমক আমোদে আহ্লাদে দিন কাটাতেন— বছর শেষে কি হবে সে কথা ভাবতেন না।"

নতুন রাজা মন দিয়ে সব শুনলেন, বছরের শেষে তাঁর কি হবে এই কথা ভেবে ক'দিন তাঁর ঘুম হল না।

তারপর সে দেশের সকলের চেয়ে জ্ঞানী আর পণ্ডিত যারা, তাদের ডেকে আনা হল, আর রাজা তাদের কাছে মিনতি ক'রে বললেন, "আপনারা আমাকে উপদেশ দিন— যাতে বছর শেষে এই সর্বনেশে দিনের জন্য প্রস্তুত হতে পারি।"

তখন সবচেয়ে প্রবীণ বৃদ্ধ যে, সে বলল, "মহারাজ, শূন্য হাতে আপনি এসেছিলেন, শূন্য হাতেই আবার সে দেশে যেতে হবে— কিন্তু এই এক বছর আপনি আমাদের যা ইচ্ছা তাই করাতে পারেন। আমি বলি— এই বেলা রাজ্যের ওস্তাদ লোকদের সে দেশে পাঠিয়ে, সেখানে বাড়ি ক'রে, বাগান ক'রে, চাষবাসের ব্যবস্থা ক'রে চারিদিক সুন্দর করে রাখুন। ততদিনে ফলে ফুলে দেশ ভরে উঠবে, সেখানে লোকের যাতায়াত হবে। আপনার এখানকার রাজত্ব শেষ হতেই সেখানে আপনি সুখে রাজত্ব করবেন। বৎসর তো দেখতে দেখতে চলে যাবে, অথচ কাজ আপনার ঢের; কাজেই বলি, এই বেলা খেটে-খুটে সব ঠিক ক'রে নিন।" রাজা তখনই হুকুম দিয়ে লোকলস্কর, জিনিসপত্র, গাছে চারা, ফলের বীজ, আর বড় বড় কলকব্জা পাঠিয়ে, আগে থেকে সেই মরুভূমিকে সুন্দর ক'রে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলেন।

তারপর বছর যখন ফুরিয়ে এল, তখন প্রজারা তাঁর ছত্র মুকুট রাজদণ্ড সব ফিরিয়ে নিল, তাঁর রাজার পোশাক ছাড়িয়ে এক বছর আগেকার সেই সামান্য কাপড় পরিয়ে, তাঁকে জাহাজে তুলে সেই মরুভূমির দেশে রেখে এল। কিন্তু সে দেশ আর এখন মরুভূমি নেই— চারিদিকে ঘর বাড়ি, পথ ঘাট, পুকুর বাগান। সে দেশ এখন লোকে লোকারণ্য। তারা সবাই এসে ফুর্তি ক'রে শঙ্খ ঘণ্টা বাজিয়ে তাঁকে নিয়ে সিংহাসনে বসিয়ে দিল। এক বছরের রাজা সেখানে জন্ম ভরে রাজত্ব করতে লাগলেন।

(শিশু সাহিত্য)

বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা

বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা জিনিস টাই এমন, যে এটা কখনো কোনো অবস্থাতেই কিনতে পাওয়া যায়না, শেখা যায়না বা অধিকারে আনা যায়না। এটা বহুদিনের অধ্যাবসায়ে ধীরে ধীরে অর্জন করা যায়।
দুদিনের পরিচয়েই কারো কাছ থেকে শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস আশা করাটা ভুল এবং বোকামীর পরিচয়। এগুলো রেডিমেড জিনিস নয় যে বাজারে গেলাম আর কিনে নিয়ে এলাম। সম্পর্ক কে নিয়মিত পরিচর্যা এবং ব্যক্তির কর্ম, মুল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রকাশভঙ্গীর মাধ্যমে বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা অর্জিত হয়।

প্রতিটি সমস্যাই আবর্জনার মতো

এক কৃষকের একটা গাধা ছিল। গাধাটা একদিন অগভীর কুয়ায় পড়লো। কিন্তু কুয়াটার গভীরতা গাধার উচ্চতা থেকে বেশি হওয়াতে অবলা প্রাণীটি উঠে আসতে পারছিল না। গাধার ত্রাহি চিৎকারে কৃষক এবং আশপাশের মানুষ ছুটে আসল। কিন্তু ওরাও বুঝে উঠতে পারল না কী করবে।

ঘণ্টাখানেক নানাভাবে চেষ্টা করার পরও যখন গাধাকে উপরে তুলে আনা গেল না, কৃষক তখন চিন্তা করল, কুয়াটা আগে থেকেই বিপজ্জনক। বেশ কয়েকটি বাচ্চা কুয়াতে পড়ে বারবার আহত হয়েছে। কুয়াটা এমনিতেই ভরাট করতে হবে, তার উপর গাধাটা অনেক বুড়ো এবং দুর্বল হয়ে গেছে। তাই কৃষক সিদ্ধান্ত নিল গাধাসহ কুয়াটি ভরাট করে ফেলবে।

কৃষক সবাইকে ডাক দিয়ে হেল্প করতে বলল। সবাই হাতে বেলচা এবং কোদাল নিয়ে পাশ থেকে মাটি কেটে কুয়াতে ফেলতে লাগল। কিছু মাটির দলা গিয়ে গাধাটির উপরেও পড়ল। ওদের মাটি ফেলা দেখে গাধাটি বুঝতে পারল কি ঘটতে চলেছে, প্রাণী টি ভয়ে-দুঃখে নিরবে কাঁদতে লাগল।

কিছুক্ষণ মাটি ফেলার পরে সবাই হঠাৎ চমকে গেল, কারণ গাধাটি অদ্ভুত একটা কাণ্ড করে বসেছে। সবাই যখন গাধার উপরে মাটি ফেলছে, গাধাটি তখন গা-ঝাড়া দিয়ে মাটি নিচে ফেলে দিচ্ছে এবং এক-পা, এক-পা করে ভরাট হওয়া জায়গাতে অবস্থান নিচ্ছে। সবাই এবার দ্রুত গাধার উপরে মাটি ফেলতে শুরু করল, গাধাটিও তত দ্রুত মাটি গায়ের ওপর থেকে ঝেড়ে ফেলে ভরাট হওয়া জায়গাতে এসে দাঁড়ায়।

এভাবে কিছুক্ষণ মাটি ফেলার পর সবাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করল কুয়াটি প্রায় ভর্তি হয়ে গেছে, অবশেষে গাধা কুয়া থেকে বেরিয়ে আসলো।

…জীবনে চলার পথে এমন অসংখ্য কুয়াতে আপনি পড়বেন, যা থেকে উঠে আসার মতো সক্ষমতা হয়তো আপনার থাকবে না। আশপাশের মানুষগুলো আপনাকে টেনে তোলার পরিবর্তে আপনাকে আরো ডুবিয়ে দিতে চাইবে।

কিন্তু এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আপনাকে ওই গাধা টির মতই গা-থেকে আবর্জনাগুলো একটু একটু করে ঝাড়া দিয়ে ফেলতে হবে যতক্ষণ না ওই আবর্জনাতে কুয়াটা পূর্ণ হয়ে যায়। যখনই সমস্যা এসে আপনার শরীর এবং মনের উপরে চেপে বসবে, প্রতিবার একটু একটু করে ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিবেন। তারপর মাথা উঁচু করে একটু আগে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া সমস্যার উপরে গিয়ে দাঁড়াবেন।

প্রতিটি সমস্যা-ই আবর্জনার মতো। আপনি থেমে থাকলে আবর্জনার পাহাড় এসে আপনাকে জীবন্ত কবর দিয়ে দেবে। তাই কখনোই হাল ছাড়বেন না। থেমে থাকবেন না।

রাগ নিয়ন্ত্রণ - একটি শিক্ষামূলক গল্প

→খুব ছোট্ট এক ছেলে প্রচন্ড রাগী ছিলো।সে খুব সামান্য কারণেই রেগে যেত । তার বাবা তাকে একটা পেরেক ভর্তি ব্যাগ দিল এবং বললো যে,যতবার তুমি রেগে যাবে ততবার একটা করে পেরেক আমাদের বাগানের কাঠের বেড়াতে লাগিয়ে আসবে।

→প্রথম দিনেই ছেলেটিকে বাগানে গিয়ে ৩৭ টি পেরেক মারতে হলো।পরের কয়েক সপ্তাহে ছেলেটি তার রাগকে কিছুটা নিয়ন্ত্রনে আনতে পারলো তাই প্রতিদিন কাঠে নতুন পেরেকের সংখ্যাও ধীরে ধীরে কমে এলো।
সে বুঝতে পারলো হাতুড়ী দিয়ে কাঠের বেড়ায় পেরেক বসানোর চেয়ে তার রাগকে নিয়ন্ত্রন করা অনেক বেশি সহজ।শেষ পর্যন্ত সেই দিনটি এলো যেদিন তাকে একটি পেরেকও মারতে হলো না।সে তার বাবাকে এই কথা জানালো।তারা বাবা তাকে বললো,এখন তুমি যেসব দিনে তোমার রাগকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রন করতে পারবে সেসব দিনে একটি একটি করে পেরেক খুলে ফেলো।অনেক দিন চলে গেল এবং ছেলেটি একদিন তার বাবাকে জানালো যে সব পেরেকই খুলে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।

→তার বাবা এবার তাকে নিয়ে বাগানে গেল এবং কাঠের বেড়াটি দেখিয়ে বললো,
‘তুমি খুব ভালভাবে তোমার কাজসম্পন্ন করেছো,এখন তুমি তোমার রাগকে নিয়ন্ত্রন করতে পারো কিন্তু দেখো,প্রতিটা কাঠে পেরেকের গর্তগুলোএখনো রয়ে গিয়েছে।কাঠের বেড়াটিকখনো আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না।যখন তুমি কাউকে রেগে গিয়ে কিছু বলো তখন তার মনে তুমি যেন একটি পেরেক ঠুকলে পরবর্তিতে যদি তুমি তোমার কথা ফিরিয়েও নাও তখনও তার মনে ঠিক এমন একটা আচড় থেকে যায়।

→তাই নিজের রাগতে নিয়ন্ত্রন করতে শেখো।মানসিক ক্ষত অনেক সময় শারীরিক ক্ষতেরচেয়েও অনেক বেশি ভয়ংকর।

বাংলাভাষা পরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২২)

চলতি বাংলার আর-একটি বিশেষত্ব জানিয়ে দিয়ে এ বই শেষ করি। যাঁরা সাধু ভাষায় গদ্যসাহিত্যকে রূপ দিয়েছিলেন স্বভাবতই তাঁদের হাতে বাক্যবিন্যাসের একটা ধারা বাঁধা হয়েছিল।

তার প্রয়োজন নিয়ে তর্ক নেই। আমার বক্তব্য এই যে, এ বাঁধাবাঁধি বাংলা চলতি ভাষায় নয়।

কোথায় গেলেন তোমার দাদা, তোমার দাদা কোথায় গেলেন, গেলেন কেথায় তোমার দাদা, দাদা তোমার গেলেন কোথায়, কোথায় গেলেন দাদা তোমার : প্রথম পাঁচটি বাক্যে "গেলেন' ক্রিয়াপদের উপর এবং শেষের বাক্যটিতে "কোথায়' শব্দের উপর ঝোঁক দিয়ে এই সবকটা প্রয়োগই চলে। আশ্চর্য তোমার সাহস, কিংবা, রেখে দাও তোমার চালাকি, একেবারে ভাসিয়ে দিলে কেঁদে : সাধু ভাষার ছাঁদের চেয়ে এতে আরও বেশি জোর পৌঁছয়। যা থাকে অদৃষ্টে, যা করেন ভগবান, সে প'ড়ে আছে পিছনে : এ আমরা কেবল-যে বলি তা নয়, এইটেই বলি সহজে।

বাংলা ভাষার একটা বিপদ তার ক্রিয়াপদ নিয়ে; "ইল' "তেছে' "ছিল'-যোগে বিশেষ বিশেষ কালবাচক ক্রিয়ার সমাপ্তি। ক্রিয়াপদের এই একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি এড়াবার জন্যে লেখকদের সতর্ক থাকতে হয়। বাংলা বাক্যবিন্যাসে যদি স্বাধীনতা না থাকত তা হলে উপায় থাকত না। এই স্বাধীনতা আছে বটে, কিন্তু তাই বলে স্বৈরাচার নেই। "ভাসিয়ে একেবারে দিলে কেঁদে' কিংবা "ভাসিয়ে দিলে একেবারে কেঁদে' বলি নে। "সে প'ড়ে সবার আছে পিছনে' কিংবা "রেখে চালাকি দাও তোমার' হবার জো নেই। তার কারণ জোড়া ক্রিয়ার জোড় ভাঙা অবৈধ।

চলতি গদ্যের একটা নমুনা দেওয়া যাক। এতে সাধু গদ্যভাষার বাক্যপদ্ধতি অনেকটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে--

কুঞ্জবাবু চললেন মথুরায়। তাঁর ভাই মুকুন্দ যাবে স্টেশন পর্যন্ত। বৈজু দারোয়ান চলেছে মাঠাকরুনের পাল্কির পাশে পাশে, লম্বা বাঁশের লাঠি হাতে, ছিটের মের্‌জাই গায়ে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। ঘর সামলাবার জন্যে রয়ে গেছে ভরু সর্দার। টেমি কুকরটা ঘুমোচ্ছিল সিমেন্টের বস্তার উপর ল্যাজে মাথা গুঁজে, গোলমাল শুনে ছুটে এল এক লাফে। যত ওরা বারণ করে ততই কেঁই কেঁই ঘেউ-ঘেউ রবে মিনতি জানায়, ঘন ঘন নাড়ে বোঁচা ল্যাজটা। রেল লাইন থেকে শোনা যাচ্ছে মালগাড়ি আসার শব্দ। ডাকগাড়ি আসতে বাকি আছে বিশ মিনিট মাত্র। বিষম ব্যস্ত হয়ে পড়ল মুকুন্দ; সে যাবে কলকাতার দিকে, আজ সেখানে মোহনবাগানের ম্যাচ। ঐ বুঝি দেখা গেল সিগ্ন্যাল-ডাউন। এ দিকে নামল ঝমাঝম্‌ বৃষ্টি, তার সঙ্গে জোর হাওয়া। বেহারাগুলো পাল্কি নামালো অশথতলায়। হঠাৎ একটি ভিখিরি মেয়ে ছুটে এসে বললে, "দরজা খোলো মা, একবার মুখখানি দেখে নিই।' দরজা খুলে চমকে উঠলেন গিন্নিঠাকরুন, "ওমা, ও কে গো! আমাদের বিনোদিনী যে! কে করলে ওর এ দশা!" কুকুরটা ওকে দেখেই লাফিয়ে উঠল, ওর বুকে দুই পা তুলে কাঁই-কাঁই করতে লাগল আনন্দে। বিনোদিনী একবার তার গলা জড়িয়ে ধরল দুই হাতে, তার পরেই ওকে সরিয়ে দিল, জোরে ঠেলা দিয়ে। গোলেমালে কোথায় মেয়েটি পালালো ঝড়ের আড়ালে, দেখা গেল না। চারি দিকে সন্ধানে ছুটল লোকজন। বড়োবাবু স্বয়ং হাঁকতে থাকলেন "বিনু বিনু', মিলল না কোনো সাড়া। মুকুন্দ রইল তার সেকেণ্ড ক্লাসের গাড়িতে, রুমালে মুখ লুকিয়ে একেবারে চুপ। মেলগাড়ি কখন্‌ গেল বেরিয়ে। বৃষ্টির বিরাম নেই।

৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন

তাজউদ্দীন আহমেদ

তাজউদ্দীন আহমেদ কে নিয়ে কিছু জানার ছিল, কিছু লেখার ছিল। ১৯৭১ সালের ২০ শে ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের বিখ্যাত “টাইম ম্যাগাজিন” খুব ছোট করে তাঁকে বর্ননা করেছিল এরকমঃ
“Tajuddin Ahmed, 46. Prime Minister, a lawyer who has been a chief organizer in the Awami League since its founding in 1949. He is an expert in economics and is considered one of the party's leading intellectuals.”
বঙ্গবন্ধুর পরে এই বাঙালি ছিলেন স্বয়ংসম্পূর্ণ, বিচক্ষণ এবং মেধার দিক দিয়ে সুদূর প্রসারী চিন্তাবিদ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যিনি তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলে তাজউদ্দীন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহন করেন।
অর্থমন্ত্রী হবার পর, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতায় আগুনে পোড়া নিজের পৈত্রিক ভিটার সামনে এসে দাঁড়ালে সমবেত জনতা বলে ওঠেন, আর চিন্তা কি,
তাজউদ্দীন ভাইসাবের পোড়া ভিটায় নতুন বাড়ি উঠবে।
তিনি বলেছিলেন- “যতদিন পর্যন্ত এই বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই না হবে, ততদিন এই ভিটায় বাড়ি উঠবে না”।
-“মনে রেখ, আমি শুধু এই এলাকার মন্ত্রী না, আমি সমস্ত বাংলাদেশের মন্ত্রী। এখন তোমাদের দায়িত্ব আগের চাইতে অনেক বেশি। কারণ সমস্ত দেশের মানুষ তোমাদের কাপাসিয়ার এই মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকবে। আমি স্বার্থপরের মতো আমার এলাকার উন্নয়নের কাজে হাত দিতে পারি না। আমাকে সমস্ত দেশে সব কিছু সমান ভাগ করে দিতে হবে”
-“বাড়িতে যখন অতিথি-মেহমান আসে তখন আমরা কি করি। তাকে ভালো করে আদর যত্ন করি, তার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করি। তাকে সবচাইতে ভালো জিনিসটা খেতে দেই। তারপর যা থাকে নিজেরা ভাগ করে খাই। তোমরাও সমস্ত বাংলাদেশকে তেমনিভাবে দেখ। এসো আগে আমরা সবাই মিলে দেশ গড়ি। তখন এই এলাকা এমনিতেই আর পিছিয়ে থাকবে না”।
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে তার শিশুপুত্র সোহেল অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাকে দেখতে যেতে তিনি চাননি। এ নিয়ে তার ভারতীয় নিরাপত্তা অফিসার ও বাংলাদেশের অনেক সহকর্মী বেশ পীড়াপীড়ি করলে এক বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন:
-“প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ছেলেমেয়ে স্ত্রী তো নিরাপদেই আছে কলকাতা শহরে। এদের কথা চিন্তা করার জন্যে তো সবাই রয়েছে। যেমন আপনারা, মিস্টার চ্যাটার্জি সবাই তো আমার ছেলেমেয়েদের ও স্ত্রীর সুখ-দুঃখের চিন্তার জন্যে রয়েছেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা শত্রুবাহিনীর হামলায় পা হারিয়েছে, হাত হারিয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। কেউ গুলির আঘাতের যন্ত্রণা চেপে ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে বনে-বাদাড়ে লুকিয়ে লুকিয়ে। এদের তো অনুভূতি আছে। তাদের মা-বোন-স্ত্রী-ছেলেমেয়ে স্বজন রয়েছেন। কিন্তু তাদের কথা চিন্তা করার সময় কোথায়? মাইন বা গুলির আঘাতে যন্ত্রণাকাতর ওই মুক্তিযোদ্ধা তার ব্যথা-বেদনা চেপে ধরে সকল অনুভূতি, চিন্তা, চেতনা, দেশমুক্ত করার অগ্নিশপথে সমর্পণ করেছে। শেষ সম্বল নিজ প্রাণটিও দেয়ার জন্যে প্রস্তুত। শত্রুর হাতে মৃত্যুর পর গোর-কাফন হবে কি হবে না, কিংবা কোথায় গোর-কাফন হবে; আত্মীয়-স্বজন স্ত্রী-পুত্র-পরিবার মৃত্যুর খবরটুকু জানতে পারবে কি না এই ভাবনাটুকু কি তার মনে একবার উদয় হয়? কোথায় তার অনুভূতি? যদি প্রশ্ন করেন, তার কি কোনো অনুভূতি আছে? এ পরিস্থিতিতে এর কী জবাব আছে? পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে যদি আমার মৃত্যু হতো তাহলে আমার পরিবার-ছেলেমেয়েদের অবস্থা কি হতো? কে ভাবত তাদের কথা? যারা এরই মধ্যে নিহত হয়েছেন তাদের রেখে যাওয়া আত্মীয়-স্বজনদের কথা এ মুহূর্তে আমিও কি একটিবার ভাবছি? আপনার মনকে জিজ্ঞাসা করুন আপনিও কি ভাবছেন”?
ড. আনিসুজ্জামান তার অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণনা করেছিলেন- তিনি একদিন সকালে অফিসে এসে দেখেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের চোখ লাল হয়ে আছে, কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেন যে, -“রাতে ঝড়ো বাতাসের শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। জানালা বন্ধ করতে গিয়ে বৈরী আবহাওয়া লক্ষ করে শরণার্থী শিবিরের মানুষের কথা মনে পড়ে যায়। তারপর আর ঘুমাতে পারেননি”।
লেখক শুভ কিবরিয়ার লেখায় আরো জানা যায়- এ.আর. মল্লিক তার বইয়ে লিখেছেন:
-“একই ভবনে তাজউদ্দীনের স্ত্রী, সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরিবার বাস করতেন। কিন্তু তাজউদ্দীন সেখানে থাকতেন না। আমাকে বলেছিলেন, ‘ভাই দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমার পরিবারের সঙ্গে এক বাসাতে থাকতে চাই না। কাজেরও সুবিধা হয়, সাংসারিক ঝামেলা আমি নিতে চাই না। তার গায়ে একটি শার্টই প্রায় দেখতাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, ‘শার্ট বদলান না কেন?’ বললেন ওটাও হাঙ্গামা হবে। ‘এই শার্টটি ময়লা কম হয়, গোসল করার সময় মাঝে মাঝে ধুয়ে নিই।’
-দ্যাট ওয়াজ তাজউদ্দীন।
বঙ্গবন্ধু যখন ৭৪ সালে পাকিস্থান সফর করেন তখন তাজউদ্দীন সেই সফরের বিরোধিতা করে বলেন -“ভুট্টোর সঙ্গে যেচে মাখামাখি করার ফলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে যে অমীমাংসিত বিরোধ রয়েছে তার সমাধান বিলম্বিত হবে, এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আবার সক্রিয় হবার সাহস পাবে”।
বঙ্গবন্ধু যদিও তাঁর খুব কাছের মানুষ তাজউদ্দীনের সেই মতামত কে আগ্রাহ্য করে ইসলামী দেশগুলোর ডাকা লাহোরের সম্মেলনে যোগ দেন, বঙ্গবন্ধুর সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে ক্রমাগত, পরবর্তীতে ৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর জাতীয় স্বার্থে আবার বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গীকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন।
অথচ, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অন্যতম ঘাতক বজলুল হুদা তাজউদ্দীন কে ব্যবহার করতে এসেছিল, তাজউদ্দীন তাঁর স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন –“শেখ মুজিবের রক্তের উপর দিয়ে হেঁটে আমি প্রধানমন্ত্রি-প্রেসিডেন্ট হতে চাইনা”।
সমগ্র জাতিকে নিজ চেতনায় ধারণ করেছিলেন বলেই তার পক্ষে সম্ভব হয় শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা।
আজ আমাদের সেই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুবার্ষিকী। নাহ, তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেননি তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছিল ইতিহাসের জঘন্যতম ভাবে, নৃশংসভাবে। ৭৫ এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু খুন হবার পর প্রথমে গৃহবন্ধী, পরে সামরিক আইনে ২২ আগস্ট গ্রেফতার করে ৩রা নভেম্বর জেলেই খুন করে সেই ঘাতকেরা। তারা জানতো তাজউদ্দীন বেঁচে থাকলে আরেক বঙ্গবন্ধু রয়ে যাবে বাংলাদেশে।

আরাফাত তানিম

শিক্ষার উদ্দেশ্য বই পড়া কিংবা ডিগ্রি অর্জন নয়

যদিও জানেন তবু মানেন কিনা দেখে নিনঃ

১।কারও বিপদে হাসবেন না! আপনি জানেন না, একটু পর আপনার জন্য কী অপেক্ষা করছে। সুতরাং নিজের ভালোর জন্য হলেও পরের ব্যাপারে সদয় হোন।

২। অহংকার করেন? মনে রাখা ভালো, গাছের উঁচু শাখাটির উপরও বিস্তীর্ণ আকাশের অবস্থান। আবার সেই নীল আকাশও ঢাকা পড়ে বিশাল কালো মেঘে! কাউকেই ছোট করার অধিকার আপনাকে দেওয়া হয়নি, সুতরাং বড়াই করার অভ্যাস থাকলে আজই ত্যাগ করুন।

৩।এটা-সেটা হাজার কিছু করে বেড়ান? ভাবছেন সাহস আছে- তাই ছাড়া পেয়ে যায়? কিংবা ভাবেন, আমি তো মুক্ত পাখি। আমাকে রুখবে সে সাধ্য কার? মনে রাখা ভালো, সাগরে বিশাল আকৃতির যে মাছটি ভরপেটে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে-- সেই মাছটিও মুক্ত অবস্থায় থাকে। কিন্তু একসময় জালে ধরা পড়ে তার জীবনেরও অবসান হয়! আজ আপনি মুক্ত, ভাবুন না কাল কী হতে পারে?

৪।অবহেলা করেন যে কোনও কিছুকে? বলেন নাকি এমন-“একটুতেই উতলা হবার প্রয়োজন নেই”?
জেনে রাখুন- বিপদের সূত্রপাত হয় ছোট ছোট সব অবহেলা থেকেই। এ ক্ষেত্রেও উপরের সূত্রটি কার্যকর- “আজ না হয় কিছু হয়নি, জানেন না কাল কী হতে চলেছে”!

৫।সফল হতে চাই! নিশ্চয় বালিশের উপর মাথা দিয়ে এমনটা ভেবে থাকেন?
বালিশটা সরিয়ে রেখে কাজে নেমে পড়ুন। বালিশে মাথা রেখে ভালো ঘুম হয়, কিন্তু বাস্তব কোনও স্বপ্নপূরণের স্থান ঐ বালিশ নয়!

বাস্তববাদী হতে শিখুন! শিক্ষার উদ্দেশ্য বই পড়া কিংবা ডিগ্রি অর্জন নয়, বরং আপনাকে রক্ষা করা, আপনাকে এগিয়ে নেওয়া। নীতি বাক্যগুলোকে স্রেফ বইয়ের কথা বলে ফেলে রাখবেন না। সেগুলিকে কাজে রূপান্তর করুন- দেখবেন জীবনটাই বদলে গেছে!

শিক্ষা সংস্কার - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যাঁহারা খবরের কাগজ পড়েন তাঁহারা জানেন, ইংলণ্ডে ফ্রান্সে শিক্ষা সম্বন্ধে খুব একটা গোলমাল চলিতেছে। শিক্ষা লইয়া আমরাও নিশ্চিন্ত নাই, তাহাও কাহারো অবিদিত নাই।

এক সময়ে "স্পীকার' নামক বিখ্যাত ইংরেজি সাপ্তাহিক-পত্রে আইরিশ শিক্ষা-সংস্কার সম্বন্ধে যে প্রস্তাব আলোচিত হইয়াছে, তাহা আমাদের মনোযোগপূর্বক চিন্তা করিয়া দেখিবার বিষয়।

য়ুরোপের যে-যুগকে অন্ধকার যুগ বলে, যখন বর্বর আক্রমণের ঝড়ে রোমের বাতি নিবিয়া গেল, সেই সময়ে যুরোপের সকল দেশের মধ্যে কেবলমাত্র আয়রলণ্ডেই বিদ্যার চর্চা জাগিয়াছিল। তখন য়ুরোপের ছাত্রগণ আয়রলণ্ডের বিদ্যালয়ে আসিয়া পড়াশুনা করিত। সপ্তম শতাব্দীতে যখন বহুতর বিদ্যার্থী এখানে আসিয়া জুটিয়াছিল, তখন তাহারা আহার বাসা পুঁথি এবং শিক্ষা বিনামূল্যেই পাইত। কতকটা আমাদের দেশের টোলের মতো আর কি।

য়ুরোপের অধিকাংশ দেশেই আইরিশ বৈরাগিগণ বিদ্যা এবং খৃস্টধর্মের নির্বাণপ্রায় শিখা আবার উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছেন। ফ্রান্সের রাজা শার্লমান অষ্টম শতাব্দীতে পারিস-য়ুনিভরসিটির প্রতিষ্ঠাভার বিখ্যাত আইরিশ পণ্ডিত ক্লেমেন্সের হাতে দিয়াছিলেন। এরূপ আরো অনেক দৃষ্টান্ত আছে।

প্রাচীন আইরিশ বিদ্যালয়ে যদিচ লাটিন, গ্রীক এবং হিব্রু শেখানো হইত, তবু সেখানে শিখাইবার ভাষা ছিল আইরিশ। গণিতজ্যোতিষ, ফলিতজ্যোতিষ এবং তখনকার কালে যে-সকল বিজ্ঞান প্রচলিত ছিল তাহা আইরিশ ভাষা দ্বারাই শেখানো হইত, সুতরাং এ ভাষার পারিভাষিক শব্দের দৈন্য ছিল না।

যখন দিনেমার এবং ইংরেজরা আয়রলণ্ড আক্রমণ করে, তখন এই-সকল বিদ্যালয়ে আগুন লাগাইয়া বিপুলসঞ্চিত পুঁথিপত্র জ্বালাইয়া দেওয়া হয় এবং অধ্যাপক ও ছাত্রগণ হত ও বিক্ষিপ্ত হইতে থাকে। কিন্তু আয়রলণ্ডের যে যে স্থান এই-সকল উৎপাত হইতে দূরে থাকিয়া ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত দেশীয় রাজাদের অধীন ছিল, সে-সকল স্থানের বড়ো বড়ো বিদ্যাগারে শিক্ষাকার্য সম্পূর্ণ আইরিশ প্রণালীতেই নির্বাহিত হইত। অবশেষে এলিজাবেথের কালে লড়াই হইয়া যখন সমস্ত সম্পত্তি অপহৃত হইল, তখন আয়রলণ্ডের স্বায়ত্তবিদ্যা ও বিদ্যালয় একেবারে নষ্ট করিয়া দেওয়া হইল।

এইরূপে আয়রলণ্ডবাসীরা জ্ঞানচর্চা হইতে বঞ্চিত হইয়া রহিল, তাহাদের ভাষা নিকৃষ্টসমাজের ভাষা বলিয়া অবজ্ঞা প্রাপ্ত হইতে থাকিল। অবশেষে ঊনবিংশ শতাব্দীতে "ন্যাশনাল ইস্কুল' প্রণালীর সূত্রপাত হইল। জ্ঞানপিপাসু আইরিশগণ এই প্রণালীর দোষগুলি বিচারমাত্র না করিয়া ব্যগ্রভাবে ইহাকে অভ্যর্থনা করিয়া লইল। কেবল একজন বড়োলোক-- টুয়ামের আর্চবিশপ জন ম্যাকহেল-- এই প্রণালীর বিরুদ্ধে আপত্তি প্রকাশ করেন এবং ইহার দ্বারা ভবিষ্যতে যে অমঙ্গল হইবে তাহা ব্যক্ত করেন।

আইরিশদিগকে জোর করিয়া স্যাকসনের ছাঁচে ঢালা এবং ইংরেজ করিয়া তোলাই ন্যাশনাল ইস্কুল-প্রণালীর মতলব ছিল। ফলে এই চেষ্টার ব্যর্থতা প্রমাণ হইল। ভালোই বলো আর মন্দই বলো, প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন জাতিকে এমন ভিন্ন রকম করিয়া গড়িয়াছেন যে, এক জাতকে ভিন্ন জাতের কাঠামোর মধ্যে পুরিতে গেলে সমস্ত খাপছাড়া হইয়া যায়।

যে-সময়ে এই শিক্ষাপ্রণালীর প্রবর্তন করা হয়, তখন আয়রলণ্ডের শতকরা আশিজন লোক আইরিশ ভাষায় কথা কহিত। যদি শিক্ষা দেওয়াই ন্যাশনাল বোর্ডের উদ্দেশ্য হইত, তবে আইরিশ ছাত্রদিগকে আগে নিজের ভাষায় পড়িতে শুনিতে শিখাইয়া তাহার পরে সেই মাতৃভাষার সাহায্যে তাহাদিগকে বিদেশী ভাষা শিক্ষা দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তাহা না করিয়া নানাপ্রকার কঠিন শাস্তিদ্বারা বালকদিগকে তাহাদের মাতৃভাষা ব্যবহার করিতে একেবারে নিরস্ত করিয়া দেওয়া হইল।

শুধু ভাষা নয়, আইরিশ ইতিহাস পড়ানো বন্ধ হইল; আইরিশ ভূবৃত্তান্তও ভালো করিয়া শেখানো হইত না। ছেলেরা বিদেশের ইতিহাস ও ভূবৃত্তান্ত শিখিয়া নিজের দেশের সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকিত।

ইহার ফল যেমন হওয়া উচিত, তাহাই হইল। মানসিক জড়তা সমস্ত দেশে ব্যাপ্ত হইয়া গেল। আইরিশ-ভাষী ছেলেরা বুদ্ধি এবং জিজ্ঞাসা লইয়া বিদ্যালয়ে প্রবেশ করিল আর বাহির হইল পঙ্গু মন এবং জ্ঞানের প্রতি বিতৃষ্ণা লইয়া।

ইহার কারণ, এ শিক্ষাপ্রণালী কলের প্রণালী, ইহাতে মন খাটে না, ছেলেরা তোতাপাখি বনিয়া যায়।

এই প্রাথমিক শিক্ষার পর মাধ্যমিক শিক্ষা (Intermediate Education)। আটাশ বৎসর ধরিয়া আয়রলণ্ডে সেই মাধ্যমিক শিক্ষার পরখ করা হইয়াছে। তাহার ফলস্বরূপ বিদ্যাশিক্ষা সেখানে একেবারে দলিত হইয়া গেল। পরীক্ষাফলের প্রতি অতিমাত্র লোভ করিয়া করিয়া কলেজে শেখাইবার চেষ্টা হয় না, কেবল গেলাইবার আয়োজন হয়। ইহাতে হাজার হাজার আইরিশ ছাত্রের স্বাস্থ্য নষ্ট হয় এবং বুদ্ধি বন্ধ্যা হইয়া যাইতেছে। অতিশ্রমের দ্বারা অকালে তাহাদের মন জীর্ণ হইয়া যায় এবং বিদ্যার প্রতি তাহাদের অনুরাগ থাকে না।

এই বিদ্যাবিভ্রাটের প্রতিকারস্বরূপ আইরিশ জাতি কি প্রার্থনা করিতেছে। তাহারা বিপ্লব বাধাইতে চায় না, দেশের বিদ্যাশিক্ষার ভার তাহারা নিজের হাতে চালাইতে চায়। ব্যয়ের জন্যও কর্তৃপক্ষকে বেশি ভাবিতে হইবে না। শিক্ষাব্যয়ের জন্য আয়রলণ্ডের যে বরাদ্দ নির্দিষ্ট হইতেছে, তাহা অতি যৎসামান্য। ইংলণ্ডে পুলিস এবং আদালতে যে খরচ হয় তাহার প্রত্যেক পাউণ্ডের হারে বিদ্যাশিক্ষায় আট পাউণ্ড খরচ হইয়া থাকে। আর আয়রলণ্ডে যেখানে অপরাধের সংখ্যা তুলনায় অত্যন্ত কম, সেখানে প্রত্যেক পুলিস ও আদালতের বরাদ্দের প্রত্যেক পাউণ্ডের অনুপাতে বিদ্যাশিক্ষায় তেরো শিলিং চার পেন্স মাত্র ব্যয় ধরা হইয়াছে।

ঠিক একটা দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সকল অংশে তুলনা হইতেই পারে না। আয়রলণ্ডের শিক্ষারীতি যে-ভাবে চলিয়াছিল, ভারতবর্ষেও যে ঠিক সেই ভাবেই চলিয়াছে তাহা বলা যায় না, কিন্তু আয়রলণ্ডের শিক্ষাসংকটের কথা আলোচনা করিয়া দেখিলে একটা গভীর জায়গায় আমাদের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।

বিদ্যাশিক্ষায় আমাদেরও মন খাটিতেছে না-- আমাদেরও শিক্ষাপ্রণালীতে কলের অংশ বেশি। যে-ভাষায় আমাদের শিক্ষা সমাধা হয়, সে-ভাষায় প্রবেশ করিতে আমাদের অনেক দিন লাগে। ততদিন পর্যন্ত কেবল দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া হাতুড়ি পেটা এবং কুলুপ-খোলার তত্ত্ব অভ্যাস করিতেই প্রাণান্ত হইতে হয়। আমাদের মন তেরো-চোদ্দো বছর বয়স হইতেই জ্ঞানের আলোক এবং ভাবের রস গ্রহণ করিবার জন্য ফুটিবার উপক্রম করিতে থাকে, সেই সময়েই অহরহ যদি তাহার উপর বিদেশী ভাষার ব্যাকরণ এবং মুখস্থবিদ্যার শিলাবৃষ্টিবর্ষণ হইতে থাকে, তবে তাহা পুষ্টিলাভ করিবে কী করিয়া। প্রায় বছর কুড়ি বয়স পর্যন্ত মারামারির পর ইংরেজি ভাষায় আমাদের স্বাধীন অধিকার জন্মে, কিন্তু ততদিন আমাদের মন কী খোরাকে বাঁচিয়াছে। আমরা কী ভাবিতে পাইয়াছি, আমাদের হৃদয় কী রস আকর্ষণ করিয়াছে, আমাদের কল্পনাবৃত্তি সৃষ্টিকার্য চর্চার জন্য কী উপকরণ লাভ করিয়াছে। যাহা গ্রহণ করি, তাহা সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ করিতে থাকিলে তবেই ধারণাটা পাকা হয়। পরের ভাষায় গ্রহণ করাও শক্ত প্রকাশ করাও কঠিন। এইরূপে রচনা করিবার চর্চা না থাকাতে যাহা শিখি তাহাতে আমাদের অধিকার দৃঢ় হইতেই পারে না। ঔনঁ মুখস্থ করিয়া শেখা এবং লেখা, দুয়ের কাজ চালাইয়া দিতে হয়। যে-বয়সে মন অনেকটা পরিমাণে পাকিয়া যায়, সে-বয়সের লাভ পুরালাভ নহে। যে-কাঁচাবয়সে মন অজ্ঞাতসারে আপনার খাদ্য শোষণ করিতে পারে, তখনই সে জ্ঞান ও ভাবকে আপনার রক্তমাংসের সহিত পূর্ণভাবে মিশাইয়া নিজেকে সজীব সবল সক্ষম করিয়া তোলে। সেই সময়টাই আমাদের মাঠে মারা যায়। সে-মাঠ শস্যশূন্য অনুর্বর নীরস মাঠ। সেই মাঠে আমাদের বুদ্ধি ও স্বাস্থ্য কত যে মরিয়াছে তাহার হিসাব কে রাখে।

এইরূপ শিক্ষাপ্রণালীতে আমাদের মন যে অপরিণত থাকিয়া যায়, বুদ্ধি যে সম্পূর্ণ স্ফূর্তি পায় না, সে কথা আমাদিগকে স্বীকার করিতে হইবে। আমাদের পাণ্ডিত্য অল্প কিছু দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়, আমাদের উদ্ভাবনশক্তি শেষ পর্যন্ত পৌঁছে না, আমাদের ধারণাশক্তির বলিষ্ঠতা নাই। আমাদের ভাবাচিন্তা আমাদের লেখাপড়ার মধ্যে সেই ছাত্র-অবস্থার ক্ষীণতাই বরাবর থাকিয়া যায়; আমরা নকল করি, নজির খুঁজি, এবং স্বাধীন মত বলিয়া যাহা প্রচার করি, তাহা হয় কোনো-না কোনো মুখস্থ বিদ্যার প্রতিধ্বনি, নয় একটা ছেলেমানুষি ব্যাপার। হয় মানসিক ভীরুতাবশত আমরা পদচিহ্ন মিলাইয়া চলি, নয় অজ্ঞতার স্পর্ধাবশত বেড়া ডিঙাইয়া চলিতে থাকি। কিন্তু আমাদের বুদ্ধির যে স্বাভাবিক খর্বতা আছে, এ কথা কোনো মতেই স্বীকার্য নহে। আমাদের শিক্ষাপ্রণালীর ত্রুটি সত্ত্বেও আমরা অল্প সময়ের মধ্যে যতটা মাথা তুলিতে পারিয়াছি, সে আমাদের নিজের গুণে।

আর একটি কথা। শিক্ষা দিবার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গে যদি আর-কোনো অবান্তর উদ্দেশ্য ভিতরে ভিতরে থাকিয়া যায় তবে তাহাতে বিকার জন্মায়। আইরিশকে স্যাকসন করিবার চেষ্টায় তাহার শিক্ষাকেই মাটি করা হইয়াছে। কর্তৃপক্ষ আজকাল আমাদের শিক্ষার মধ্যে পোলিটিক্যাল মতলবকে সাঁধ করাইবার চেষ্টা করিতেছেন, তাহা বুঝা কঠিন নহে। সেইজন্য তাঁহারা শিক্ষাব্যাপারে দেশীয় লোকের স্বাধীনতা নানা দিক হইতে খর্ব করিতে উদ্যত হইয়াছেন। শিক্ষাকে তাঁহারা শাসনবিভাগের আপিসভুক্ত করিয়া লইতে চান। এখন হইতে অনভিজ্ঞ ডাইরেক্টরের পরীক্ষিত, অনভিজ্ঞ ম্যাকমিলান কোম্পানির রচিত, অতি সংকীর্ণ, অতি দরিদ্র এবং বিকৃত বাংলার পাঠ্যগ্রন্থ পড়িয়া বাঙালির ছেলেকে মানুষ হইতে হইবে এবং বিদ্যালয়ের বইগুলি এমন ভাবে প্রস্তুত ও নির্বাচিত হইবে যাহাতে নিরপেক্ষ উদার জ্ঞানচর্চা পোলিটিক্যাল প্রয়োজনসিদ্ধির কাছে খণ্ডিত হইয়া যায়।

শুধু তাই নয়। ডিসিপ্লিনের যন্ত্রটাতে যে-পরিমাণ পাক দিলে ছেলেরা সংযত হয়, তাহার চেয়ে পাক বাড়াইবার চেষ্টা দেখা যাইতেছে, ইহাতে তাহাদিগকে নিঃসত্ত্ব করা হইবে। ছেলেদের মধ্যে ছেলেমানুষের চাঞ্চল্য যে স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর তাহা স্বদেশের সম্বন্ধে ইংরেজ ভালোই বোঝে। তাহারা জানে, এই চাঞ্চল্যকে দমন না করিয়া যদি নিয়মিত করিয়া পুষ্ট করা যায়, তবে ইহাই একদিন চরিত্র এবং বুদ্ধির শক্তিরূপে সঞ্চিত হইবে। এই চাঞ্চল্যকে একেবারে দলিত করাই কাপুরুষতাসৃষ্টির প্রধান উপায়। ছেলেদের যাহারা যথার্থ হিতৈষী, তাহারা এই চাঞ্চল্যের মধ্যে প্রকৃতির শুভ উদ্দেশ্য স্বীকার করে, তাহারা ইহাকে উপদ্রব বলিয়া গণ্য করে না। এইজন্য বালোচিত চাপল্যের নানাবিধ উৎপাতকে বিজ্ঞলোকেরা সস্নেহে রক্ষা করেন। ইংলণ্ডে এই ক্ষমাগুণের চর্চা যথেষ্ট দেখা যায়-- এমন-কি, আমাদের কাছে তাহা অতিরিক্ত বলিয়া মনে হয়।

নিজে চিন্তা করিবে, নিজে সন্ধান করিবে, নিজে কাজ করিবে, এমনতরো মানুষ তৈরি করবার প্রণালী এক, আর পরের হুকুম মানিয়া চলিবে, পরের মতের প্রতিবাদ করিবে না, ও পরের কাজে জোগানদার হইয়া থাকিবে মাত্র, এমন মানুষ তৈরির বিধান অন্যরূপ। আমরা স্বভাবত স্বজাতিকে স্বাতন্ত্র্যের জন্য প্রস্তুত করিতে ইচ্ছা করিব, সে কথা বলাই বাহুল্য। ইংলণ্ডের যখন সুদিন ছিল, তখন ইংলণ্ডও কোনো জাতিসম্বন্ধেই এই আদর্শে বাধা দিত না-- ভারতবর্ষে শিক্ষানীতি সম্বন্ধে মেকলের মন্তব্য তাহার প্রমাণ। এখন কালের পরিবর্তন হইয়াছে; এইজন্যই শিক্ষার আদর্শ লইয়া কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে স্বদেশভক্তদের বিরোধ অবশ্যম্ভাবী হইয়া পড়িয়াছে। আমরা বিদ্যালয়ের সাহায্যে এ দেশে তাঁবেদারির চিরস্থায়ী ভিত্তি পত্তন করিতে কিছুতেই রাজি হইতে পারি না। কাজেই, সময় উপস্থিত হইয়াছে, এখন বিদ্যাশিক্ষাকে যেমন করিয়া হউক নিজের হাতে গ্রহণ করিতেই হইবে।

গবর্মেন্ট-প্রতিষ্ঠিত সেনেটে সিণ্ডিকেটে বাঙালি থাকিলেই যে বিদ্যাশিক্ষার ভার আমাদের নিজের হাতে রহিল, তাহা আমি মনে করি না। গবর্মেণ্টের আমাদের কাছে জবাবদিহি না থাকিয়া দেশের লোকের কাছে জবাবদিহি থাকা চাই। আমরা গবর্মেণ্টের সম্মতির অধীনে যখন বাহ্যস্বাতন্ত্র্যের একটা বিড়ম্বনা লাভ করি, তখনই আমাদের বিপদ সব চেয়ে বেশি। তখন প্রসাদলব্ধ সেই মিথ্যা স্বাতন্ত্র্যের মূল্য যাহা দিতে হয়, তাহাতে মাথা বিকাইয়া যায়। বিশেষত দেশীলোককে দিয়াই দেশের মঙ্গল দলন করা গবর্মেণ্টের পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন নহে, নইলে এ দেশের দুর্গতি কিসের। অতএব, চাকরির অধিকার নহে, মনুষত্বের অধিকারের যোগ্য হইবার প্রতি যদি লক্ষ রাখি, তবে শিক্ষা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য-চেষ্টার দিন আসিয়াছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। দেশের লোককে শিশুকাল হইতে মানুষ করিবার সদুপায় যদি নিজে উদ্ভাবন এবং তাহার উদ্যোগ যদি নিজে না করি, তবে আমরা সর্বপ্রকারে বিনাশপ্রাপ্ত হইব-- অন্নে মরিব, স্বাস্থ্যে মরিব, বুদ্ধিতে মরিব, চরিত্রে মরিব-- ইহা নিশ্চয়। বস্তুত আমরা প্রত্যহই মরিতেছি অথচ তাহার প্রতিকারের উপযুক্ত চেষ্টামাত্র করিতেছি না,তাহার চিন্তামাত্র যথার্থরূপে আমাদের মনেও উদয় হইতেছে না, এই যে নিবিড় মোহাবৃত নিরুদ্যম ও চরিত্রবিকার-- বাল্যকাল হইতে প্রকৃত শিক্ষা ব্যতীত কোনো অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের দ্বারা ইহা নিবারণের কোনো উপায় নাই

বর্তমানকালে যে একটিমাত্র সাধক য়ুরোপে গুরুর আসনে বসিয়া নিরন্তর অরণ্যে রোদন করিয়া মরিতেছেন সেই টল্‌স্টয় রুশিয়ার শিক্ষানীতি সম্বন্ধে যে-কথা বলিয়াছেন তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করি।

It seems to me that it is now specially important to do what is right quietly and persistently, not only without asking permission from Government, but consciously avoiding its participation। The strength of the Government lies in the people's ignorance, and the Government knows this, and will therefore always oppose true enlightenment। It is time we realized that fact। And it is most undesirable to let the Government, while it is spreading darkness, pretend to be busy with the enlightenment of the people। It is doing this now by means of all sorts of pseudo educational establishment which it controls ; schools, high schools, universities, academies, and all kinds of committees and congresses। But good is good and enlightenment is enlightenment, only when it is quite good and quite enlightened and not when it is toned down to meet the requirements of Delyanof's or Dournovo's circulars। And I am extremely sorry when I see valuable, disinterested, and self-sacrificing efforts spent unprofitably। It is strange to see good, wise people spending their strength in a struggle against the Government, but carrying on this struggle on the basis of whatever laws the Government itself likes to make।

১৩১৩ বঙ্গাব্দ

এই হলাম আমরা

মাঝরাতে যখন আমার এলাকায় কারেন্ট এসেছে তখন পুরো এলাকা হৈ হৈ করে উঠেছে
রাজাবাজারে শুনলাম খুশিতে মাঝরাতেই আনন্দমিছিল বের হয়ে গিয়েছিল
বাড্ডায় ছেলেপেলে খুশিতে পটকা ফুটিয়েছে... গাজীপুরে এক উত্তেজিত বান্দা খুশিতে তারাবাতি জ্বালাতে যেয়ে তার লুঙ্গি জ্বালিয়ে ফেলেছে
সে এখন গাজীপুর সদর হাসপাতালে উপুত হয়ে হাসিহাসি মুখ করে শুয়ে আছে
পুরো দেশ ১০ ঘন্টা অন্ধকারে ছিলো... এই কাহিনী বাইরের যে কোনও দেশে ঘটলে, নিমিষেই দাঙ্গা লেগে যেত
আমেরিকার মতো দেশে এতক্ষণ কারেন্ট না থাকলে তো দোকানের শাটার ভেঙ্গে লুটপাট শুরু হয়ে যেত
আমাদের কোথাও কিন্তু এরকম হয়নি ... ১/২ টা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ... তারমধ্যে আবার গাজীপুরের ঘটনাটাও আছে
এই হলাম আমরা... এই হলাম সুখি আমরা
গতকাল মোমবাতি কিনতে গিয়েছি; যে মোমবাতির দাম ১০ টাকা, সেটা দোকানদার ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে চাইলো ১০০ টাকা
চোখ গরম করে টাকা দিতে যাব এমন সময় টুসস করে কারেন্ট এসে পড়লো
বেচারা পারলে দৌড় দেয় ভয়ে
নিজের দোকান... নিজের মোমবাতি... তাও সে কাচুমাচু করছে; এক পর্যায়ে বললো, ‘আইচ্ছা পার পিচ ৫০ টাকা কম দিলেও হইবো’
... এই হলাম আমরা
আমাদের দৌড় এততুকুই ... এই মোমবাতির দাম বাড়ানো পর্যন্তই
দেশ যখন অন্ধকারে, তখন বিরোধীদল ভেবেছে, “সাব্বাস পাইলাম একটা ইস্যু... সরকার নাড়ায়ে দেয়ার মতো ইস্যু”
ওদিকে সরকারিদল শিওর জনগণকে ভয় পাওয়ার থেকে বিরোধীদলকেই বেশী ভয় পেয়েছে
দুই দলের কেউই, গাজীপুরের সেই মান্নানদের কথা ভাবেনি
অথচ এরাই, ঘামতে থাকা অবস্থাতেই বিদ্যুৎ আসায় এমনন জোরে চিৎকার দিয়েছে যেন মনে হয় বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতে ফেলেছে
যে দেশে এতো সুন্দর মানুষেরা থাকে, সে দেশের তো এমন অবস্থা হবার কথা না... উহু
একটা ন্যাশনাল ক্রাইসিসে, দল মত নির্বিশেষ সবার ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা
... কিন্তু এটা, ‘কথা’ পর্যন্তই
একটা ন্যাশনাল ইস্যুতে দুইদল এক হতে পারে না... সেটা তিস্তার পানি বন্টন ইস্যু হোক বা রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প হোক
কেন, কাল বিরোধীদল যদি এসে বলতো; “আমাদের দলে যারা জ্বালানী এক্সপার্ট আছে তাদের এখনইই পাঠাচ্ছি আপনাদের সাহায্য করতে” ... তাহলে কি তাদের ভোট নিমিষে বেড়ে যেত না?
কেন, কাল যদি সরকারী দলের একজন পলিসিমেকার এতবড় ঘটনার পর সাথে সাথে পদত্যাগ করতো... তাহলে কি তার দল মানুষের কাছে আরো আস্থাভাজন হতো না?
আমি বুঝি না... যে সিম্পল বিষয়গুলো আমরা বুঝি, আপনারা কেন বুঝেন না
হ্যা আমাদের দেশের জনগন প্রচন্ড সিম্পল... কিন্তু প্লিজ এটাকে আপনারা আমাদের উইকনেস হিসেবে নিবেন না
এখন যতই ড্যাম কেয়ার ভাব নেন; যেদিন মোমবাতিওয়ালার মতো টাইমিং এর মারপ্যাঁচে পড়বেন, সেদিন এই মান্নান্রাই আপনাকে হাসিমুখে হাতে কেরোসিন নিয়ে দৌড়ানি দিবে
১টা ২টা মান্নান না ... লক্ষ লক্ষ মান্নান
যারা আপনার ক্রেডিটে নিজের লুঙ্গি পোড়াতে পারে ... সেই তারাই কিন্তু আবার নিজের লুঙ্গি বাঁচানোর জন্য, আপনাকেও পোড়াতে পারবে।

লেখক ঃ আরিফ আর হোসাইন

বিশ্বসেরা হিমেল

আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বসেরার স্বীকৃতি পেলেন বাংলাদেশের হিমেল দেব। ২০১৪ সালের ‘কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি’ বিভাগে ‘দ্য আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ড’ পেলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সদ্যসাবেক শিক্ষার্থী হিমেল দেব।
(বিস্তারিত তথ্য:www.undergraduateawards.com/winners-2014)
সারা বিশ্বের সব স্নাতকপড়ুয়া শিক্ষার্থীর গবেষণা আর সৃজনশীলতার সম্মানজনক পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত হয় আয়ারল্যান্ডের ‘দ্য আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ড’। প্রতিবছর সাহিত্য, অর্থনীতি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর জমা দেওয়া অভিনব গবেষণা বা প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয় এই পুরস্কার। খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপকেরা বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৪ সালের ‘কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি’ বিভাগে সারাবিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের তাবৎ শিক্ষার্থীর মধ্যে এই পুরস্কার পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সদ্যসাবেক শিক্ষার্থী হিমেল দেব। স্নাতক শেষ বর্ষে করা হিমেলের থিসিসের বিষয় ছিল User Interaction Based Community Detection in Online Social Networks.
সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে ছোট ছোট কমিউনিটি শনাক্তকরণ এবং এর তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের পদ্ধতি নিয়ে। সম্প্রতি তিনি বুয়েটের কম্পিউটার কৌশল বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন।
আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের একমাত্র গবেষণাধর্মী কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচ্য হওয়ায় এমআইটি থেকে শুরু করে স্ট্যানফোর্ড, হার্ভার্ড, প্রিন্সটনের মতো বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়মিত অংশগ্রহণ দেখা যায়। আর সেই সব বিশ্বসেরা শিক্ষার্থীর ভিড়ে বাজিমাত করলেন চট্টগ্রামের পরীক্ষিত দেব ও নীলিমা দেবের সন্তান হিমেল দেব।
কী ছিল তাঁর গবেষণায়? জানতে চাইলে হিমেলের কথায় উঠে আসে, বাস্তবিক সমাজব্যবস্থার মতো অনলাইন সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোও কিছু ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত। উদাহরণ হিসেবে ফেসবুকে মানুষের ব্যক্তিগত বন্ধুতালিকার দিকে যদি আলোকপাত করা হয়, তবে দেখা যাবে সেখানে রয়েছে স্কুল-কলেজের বন্ধু থেকে শুরু করে পরিবার কিংবা অফিস সহকর্মীদের মতো ছোট ছোট গোষ্ঠী। অনলাইন সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারী মানুষগুলোর পারস্পরিক যোগাযোগের বিভিন্ন তথ্য ব্যবহার করে এ ধরনের গোষ্ঠীগুলোকে খুঁজে বের করাকে বলা হয় কমিউনিটি ডিটেকশন, যার প্রয়োগ রয়েছে ব্যবহারকারীদের তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। আর এই কমিউনিটি ডিটেকশনের একটি নতুন পদ্ধতি বাতলে দিয়ে প্রায় ১২ হাজার শব্দের একটি বিস্তারিত পেপার জমা দেওয়ার মাধ্যমে এই খেতাব জিতে নেন হিমেল।
তবে এই গবেষণার পুরস্কার এবারই প্রথম পেলেন না হিমেল। তাঁর কমিউনিটি ডিটেকশন-সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল প্রথম প্রকাশিত হয় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের বিখ্যাত ডেটাবেইস কনফারেন্স ‘ডাসফা’য়। পরবর্তী সময়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা ডেটাবেইস কনফারেন্স ‘সিগমডে’ প্রকাশিত হয় আরও দুটি পোস্টার। আন্তর্জাতিক এই কনফারেন্সগুলোতে যেখানে শুধু কিনা গ্লোবাল রিসার্চাররাই সুযোগ পান, যাঁরা প্রধানত পিএইচডি অথবা এমফিল ডিগ্রির জন্য কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র স্নাতকের শিক্ষার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে বিশেষভাবে সমাদৃত হন হিমেল।
গবেষণার কাজ কিন্তু এটাই হিমেলের প্রথম নয়। কমিউনিটি ডিটেকশন ছাড়াও হিমেল কাজ করেছেন ক্লাউড কম্পিউটিং এবং ক্রাউডসোর্স সিস্টেমস নিয়ে। এই কাজগুলো প্রকাশিত হয়েছে সিগকাই, সুপার কম্পিউটিংসহ বিভিন্ন খ্যাতনামা কনফারেন্সে। গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘হাইডেলবার্গ লরিয়েট সম্মেলনে’ বিশ্বের ১০০ জন উদীয়মান কম্পিউটার বিজ্ঞান গবেষকদের তালিকায় থাকার সম্মান। ইতিমধ্যে তাঁর ছয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রকাশনা রয়েছে।
এত অল্প সময়ে এত ভালো গবেষক হয়ে ওঠার পেছনের রহস্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেকোনো গবেষণার জন্য কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি অনেক বেশি ধৈর্যের প্রয়োজন। প্রাথমিক সাফল্যেই সন্তুষ্ট না হয়ে উত্তরোত্তর উন্নয়নের মাধ্যমে গবেষণার মানকে আরও সমৃদ্ধ করাই একজন গবেষকের লক্ষ্য হওয়া উচিত।’ তবে তিনি এই গবেষণাকাজে সহযোগিতার জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনুস আলী ও সহকারী অধ্যাপক ড. তানজিমা হাশেমের প্রতি।
তরুণদের গবেষণার প্রতি উৎসাহ দেওয়ার জন্য গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক ড. মোহাম্মদ ইউনুস আলীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনি জানান, ‘তরুণ গবেষকদের স্বল্পমেয়াদি সফলতার পেছনে না ছুটে কাজের মানের দিকে বেশি নজর দেওয়া উচিত। সাফল্য গবেষণার বাই প্রোডাক্ট, এটাকে কখনোই মূল লক্ষ্য মনে করা উচিত নয়।’

লেখক ঃ তৌশিকুর রহমান


বাংলাদেশের গর্ব হিমেল

সারা বিশ্বে ‘আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ড’কে অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ একটি পুরস্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। স্নাতক পর্যায়ে উদীয়মান গবেষকদের অনুপ্রাণিত করার জন্য সারাবিশ্বের শিক্ষার্থীদের জন্য এই আয়োজন।
আমাদের হিমেল দেবের এই পুরস্কার অর্জন, তাও আবার বিশ্বের বাঘা বাঘা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পেছনে ফেলে নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য, বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় একটা অর্জন।
আমাদের বড় ব্যর্থতা যে আমাদের শিক্ষার মান এখনো সম্যকভাবে বহির্বিশ্বে আমরা তুলে ধরতে পারিনি। বাংলাদেশে যে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা সম্ভব এবং তা যে আমাদের স্নাতকের ছাত্ররাই করতে পারে, হিমেলের সাফল্য আমাদের সে বিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। অবশ্য আমাদের কম্পিউটার কৌশলের শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা করে আসছে এবং ইতিমধ্যেই আমাদের অনেক শিক্ষার্থীদের গবেষণার ফলাফল স্নাতককালেই আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের ছাত্রদের প্রোগ্রামিং জ্ঞানও যে বিশ্বমানের, তাও আমাদের শিক্ষার্থীরা গত ১৭ বছর ধরে প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে স্বাক্ষর রেখে চলেছে।
এটা শুধু বুয়েটের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও তাদের প্রোগ্রামিং মেধার বলেই মাইক্রোসফট থেকে শুরু করে গুগলসহ বিশ্বের খ্যাতনামা আইটি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কাজ করছে এবং কাজ করার সুযোগ অর্জন করছে।
আমি আশা রাখব, হিমেলের এই সাফল্য বাংলাদেশের সব ছাত্রের জন্য ভবিষ্যতে একটি মডেল হিসেবে থাকবে এবং তাদের অনুপ্রাণিত করবে।

লেখক ঃ মোহাম্মদ কায়কোবাদ
অধ্যাপক, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)