তাজউদ্দীন আহমেদ

তাজউদ্দীন আহমেদ কে নিয়ে কিছু জানার ছিল, কিছু লেখার ছিল। ১৯৭১ সালের ২০ শে ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের বিখ্যাত “টাইম ম্যাগাজিন” খুব ছোট করে তাঁকে বর্ননা করেছিল এরকমঃ
“Tajuddin Ahmed, 46. Prime Minister, a lawyer who has been a chief organizer in the Awami League since its founding in 1949. He is an expert in economics and is considered one of the party's leading intellectuals.”
বঙ্গবন্ধুর পরে এই বাঙালি ছিলেন স্বয়ংসম্পূর্ণ, বিচক্ষণ এবং মেধার দিক দিয়ে সুদূর প্রসারী চিন্তাবিদ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যিনি তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলে তাজউদ্দীন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহন করেন।
অর্থমন্ত্রী হবার পর, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতায় আগুনে পোড়া নিজের পৈত্রিক ভিটার সামনে এসে দাঁড়ালে সমবেত জনতা বলে ওঠেন, আর চিন্তা কি,
তাজউদ্দীন ভাইসাবের পোড়া ভিটায় নতুন বাড়ি উঠবে।
তিনি বলেছিলেন- “যতদিন পর্যন্ত এই বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই না হবে, ততদিন এই ভিটায় বাড়ি উঠবে না”।
-“মনে রেখ, আমি শুধু এই এলাকার মন্ত্রী না, আমি সমস্ত বাংলাদেশের মন্ত্রী। এখন তোমাদের দায়িত্ব আগের চাইতে অনেক বেশি। কারণ সমস্ত দেশের মানুষ তোমাদের কাপাসিয়ার এই মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকবে। আমি স্বার্থপরের মতো আমার এলাকার উন্নয়নের কাজে হাত দিতে পারি না। আমাকে সমস্ত দেশে সব কিছু সমান ভাগ করে দিতে হবে”
-“বাড়িতে যখন অতিথি-মেহমান আসে তখন আমরা কি করি। তাকে ভালো করে আদর যত্ন করি, তার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করি। তাকে সবচাইতে ভালো জিনিসটা খেতে দেই। তারপর যা থাকে নিজেরা ভাগ করে খাই। তোমরাও সমস্ত বাংলাদেশকে তেমনিভাবে দেখ। এসো আগে আমরা সবাই মিলে দেশ গড়ি। তখন এই এলাকা এমনিতেই আর পিছিয়ে থাকবে না”।
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে তার শিশুপুত্র সোহেল অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাকে দেখতে যেতে তিনি চাননি। এ নিয়ে তার ভারতীয় নিরাপত্তা অফিসার ও বাংলাদেশের অনেক সহকর্মী বেশ পীড়াপীড়ি করলে এক বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন:
-“প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ছেলেমেয়ে স্ত্রী তো নিরাপদেই আছে কলকাতা শহরে। এদের কথা চিন্তা করার জন্যে তো সবাই রয়েছে। যেমন আপনারা, মিস্টার চ্যাটার্জি সবাই তো আমার ছেলেমেয়েদের ও স্ত্রীর সুখ-দুঃখের চিন্তার জন্যে রয়েছেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা শত্রুবাহিনীর হামলায় পা হারিয়েছে, হাত হারিয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। কেউ গুলির আঘাতের যন্ত্রণা চেপে ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে বনে-বাদাড়ে লুকিয়ে লুকিয়ে। এদের তো অনুভূতি আছে। তাদের মা-বোন-স্ত্রী-ছেলেমেয়ে স্বজন রয়েছেন। কিন্তু তাদের কথা চিন্তা করার সময় কোথায়? মাইন বা গুলির আঘাতে যন্ত্রণাকাতর ওই মুক্তিযোদ্ধা তার ব্যথা-বেদনা চেপে ধরে সকল অনুভূতি, চিন্তা, চেতনা, দেশমুক্ত করার অগ্নিশপথে সমর্পণ করেছে। শেষ সম্বল নিজ প্রাণটিও দেয়ার জন্যে প্রস্তুত। শত্রুর হাতে মৃত্যুর পর গোর-কাফন হবে কি হবে না, কিংবা কোথায় গোর-কাফন হবে; আত্মীয়-স্বজন স্ত্রী-পুত্র-পরিবার মৃত্যুর খবরটুকু জানতে পারবে কি না এই ভাবনাটুকু কি তার মনে একবার উদয় হয়? কোথায় তার অনুভূতি? যদি প্রশ্ন করেন, তার কি কোনো অনুভূতি আছে? এ পরিস্থিতিতে এর কী জবাব আছে? পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে যদি আমার মৃত্যু হতো তাহলে আমার পরিবার-ছেলেমেয়েদের অবস্থা কি হতো? কে ভাবত তাদের কথা? যারা এরই মধ্যে নিহত হয়েছেন তাদের রেখে যাওয়া আত্মীয়-স্বজনদের কথা এ মুহূর্তে আমিও কি একটিবার ভাবছি? আপনার মনকে জিজ্ঞাসা করুন আপনিও কি ভাবছেন”?
ড. আনিসুজ্জামান তার অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণনা করেছিলেন- তিনি একদিন সকালে অফিসে এসে দেখেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের চোখ লাল হয়ে আছে, কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেন যে, -“রাতে ঝড়ো বাতাসের শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। জানালা বন্ধ করতে গিয়ে বৈরী আবহাওয়া লক্ষ করে শরণার্থী শিবিরের মানুষের কথা মনে পড়ে যায়। তারপর আর ঘুমাতে পারেননি”।
লেখক শুভ কিবরিয়ার লেখায় আরো জানা যায়- এ.আর. মল্লিক তার বইয়ে লিখেছেন:
-“একই ভবনে তাজউদ্দীনের স্ত্রী, সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরিবার বাস করতেন। কিন্তু তাজউদ্দীন সেখানে থাকতেন না। আমাকে বলেছিলেন, ‘ভাই দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমার পরিবারের সঙ্গে এক বাসাতে থাকতে চাই না। কাজেরও সুবিধা হয়, সাংসারিক ঝামেলা আমি নিতে চাই না। তার গায়ে একটি শার্টই প্রায় দেখতাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, ‘শার্ট বদলান না কেন?’ বললেন ওটাও হাঙ্গামা হবে। ‘এই শার্টটি ময়লা কম হয়, গোসল করার সময় মাঝে মাঝে ধুয়ে নিই।’
-দ্যাট ওয়াজ তাজউদ্দীন।
বঙ্গবন্ধু যখন ৭৪ সালে পাকিস্থান সফর করেন তখন তাজউদ্দীন সেই সফরের বিরোধিতা করে বলেন -“ভুট্টোর সঙ্গে যেচে মাখামাখি করার ফলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে যে অমীমাংসিত বিরোধ রয়েছে তার সমাধান বিলম্বিত হবে, এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আবার সক্রিয় হবার সাহস পাবে”।
বঙ্গবন্ধু যদিও তাঁর খুব কাছের মানুষ তাজউদ্দীনের সেই মতামত কে আগ্রাহ্য করে ইসলামী দেশগুলোর ডাকা লাহোরের সম্মেলনে যোগ দেন, বঙ্গবন্ধুর সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে ক্রমাগত, পরবর্তীতে ৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর জাতীয় স্বার্থে আবার বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গীকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন।
অথচ, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অন্যতম ঘাতক বজলুল হুদা তাজউদ্দীন কে ব্যবহার করতে এসেছিল, তাজউদ্দীন তাঁর স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন –“শেখ মুজিবের রক্তের উপর দিয়ে হেঁটে আমি প্রধানমন্ত্রি-প্রেসিডেন্ট হতে চাইনা”।
সমগ্র জাতিকে নিজ চেতনায় ধারণ করেছিলেন বলেই তার পক্ষে সম্ভব হয় শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা।
আজ আমাদের সেই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুবার্ষিকী। নাহ, তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেননি তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছিল ইতিহাসের জঘন্যতম ভাবে, নৃশংসভাবে। ৭৫ এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু খুন হবার পর প্রথমে গৃহবন্ধী, পরে সামরিক আইনে ২২ আগস্ট গ্রেফতার করে ৩রা নভেম্বর জেলেই খুন করে সেই ঘাতকেরা। তারা জানতো তাজউদ্দীন বেঁচে থাকলে আরেক বঙ্গবন্ধু রয়ে যাবে বাংলাদেশে।

আরাফাত তানিম