PALLA MAHBUB ADARSHA HIGH SCHOOL
আকাশ ভর্তি জোছনা..
ঘরে কেরাসিন নাই...কারেন্ট? হেইডা তো বড়োলোকের জিনিস... কারেন্ট না থাকলেই তো ভালা... কারেন্টের বিল দিতে অয়না। কারেন্ট থাকলে বাতি টা জ্বালাইতে ইচ্ছা করে।
ওহ যেইডা কইতাসিলাম, ঘরে কেরাসিন নাই... কুপি হারিকেন কিচ্ছু জ্বালাইতে পাড়তাসিনা। কয়দিন পরে আমার পরীক্ষা...মেট্টিক পরীক্ষা... বাজানের ভ্যানের চাক্কা বাইক্কা গেসে, টেম্পুর লগে বাড়ি লাগসিলো। বাজানে হাডুত দুক পাইসে। নাইলে কি আর ঘরে একডু কেরাসিন থাহেনা?
দিনের সময় তো হামিদ আলীর ধান ভাঙ্গার কলে কাম করি, আজকা ৩০ টেকা পাইসি। ১ কেজি চাইল কিন্না আন্সি... মায় আজকা ৩ দিন পড়ে ভাত রানসে... ভাত খাইলে ঘুম আয়ে। মায় কইসে ভাত কম খাইলে নাকি বুদ্ধি বারে। আমি মারে কইসিলাম হ মা হের লাইগাই আমি টেস্ট পরীক্ষায় ফাস্ট হইসি। তয় আমার ভাত খাইতে ভাল্লাগে, কিন্তু মা'রে কই না... আমি জানি মায় কেন ভাত কম খাইতে কয়।
আইজকা যদি চান্নি রাইত হইতো তাইলে তো উডানে চাডি বিছাইয়া পড়তে বইতাম। আমার মাইঝে মইধ্যে মনে হয় আল্লা'র লগে কতা কই। আল্লা তুমি না সব হুনো? তাইলে আইজকা একটু চান্নি দিয়া দেও না... কেরাসিন তো চাইনাই... তুমি তো আর আকাশ থিকা টেকা ছিডাইবানা, একটু চান্নি ছিডাও... পড়তে বইতাম একডু...
মেট্টিক পরীক্ষার পড়ে আমি নাকি আর পড়তে পারুম না... তয় বাজান কইসে রক্ত বেইচ্চা হইলেও আমারে পড়াইবো। আমি বাজান রে রক্ত বেচতে দিমু না...
এতো রাইতে আবার কেডা আইলো? বাজান? তুমি কই গেসিলা? হাডুত দুক নিয়া আবার বাজারে গেসিলা চা খাইতে?
হায় হায় বাজান তুমি কেরাসিন লইয়া আইসো? আবার কর্জ করসো, না? বাজান তোমারে লইয়া আর পারিনা, একদিন না পড়লে কিসু অয়না...
ছেলেটি পড়তে বসে, আমি চোখে পানি নিয়ে, ঘর ভর্তি কারেন্ট নিয়ে বিশাল কম্পিউটার স্ক্রীনে টাইপ করে যাই...
বাইরে জোছনাও আছে... আকাশ ভর্তি জোছনা..
দিপু জামান
[ ৮-ই অক্টোবর, ২০১৩, ইস্ট এলমহারস্ট, নিউ ইয়র্ক ]
আজিকার শিশু – বেগম সুফিয়া কামাল
(কবি সুফিয়া কামাল এর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা পূর্বক......)
আমাদের যুগে আমরা যখন পরীক্ষার সময় পড়িতাম ঘরে,
তোমাদের এ যুগে তোমরা এখন ঘোরাঘুরি করো ইন্টারনেট ধরে।
আমাদের যুগে আমরা যখন থাকতাম প্রাইভেট টিচারের কাছে ,
তোমাদের এ যুগে তোমরা এখন থাকো ফেসবুক ইনবক্স পাছে ।
আমাদের যুগে নকল হলেই খেয়ে যেতাম কেইস,
তোমাদের যুগে তোমরা এখন খুঁজেই বেড়াও প্রশ্ন পত্রের পেইজ।
আমাদের যুগে সাজেশন নিতেই খেয়ে যেতাম বাঁশ,
তোমাদের এ যুগে প্রতিদিন ই – তাহা প্রশ্ন হচ্ছে ফাঁস।
সত্যি ই তোমরা ডিজিটাল হয়েছো জাতিকে দিয়েছো বাঁশ,
বুঝবে একদিন তোমাদের অধঃপতনের গোপন দীর্ঘশ্বাস।
২৫/ ১১/১৪
BY : Merely Nayamul
আমাদের যুগে আমরা যখন পরীক্ষার সময় পড়িতাম ঘরে,
তোমাদের এ যুগে তোমরা এখন ঘোরাঘুরি করো ইন্টারনেট ধরে।
আমাদের যুগে আমরা যখন থাকতাম প্রাইভেট টিচারের কাছে ,
তোমাদের এ যুগে তোমরা এখন থাকো ফেসবুক ইনবক্স পাছে ।
আমাদের যুগে নকল হলেই খেয়ে যেতাম কেইস,
তোমাদের যুগে তোমরা এখন খুঁজেই বেড়াও প্রশ্ন পত্রের পেইজ।
আমাদের যুগে সাজেশন নিতেই খেয়ে যেতাম বাঁশ,
তোমাদের এ যুগে প্রতিদিন ই – তাহা প্রশ্ন হচ্ছে ফাঁস।
সত্যি ই তোমরা ডিজিটাল হয়েছো জাতিকে দিয়েছো বাঁশ,
বুঝবে একদিন তোমাদের অধঃপতনের গোপন দীর্ঘশ্বাস।
২৫/ ১১/১৪
BY : Merely Nayamul
বাংলাভাষা পরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৩)
আমাদের দেহের মধ্যে নানাপ্রকার শরীরযন্ত্রে মিলে বিচিত্র কর্মপ্রণালীর যোগে শক্তি পাচ্ছে প্রাণ সমগ্রভাবে। আমরা তাদের বহন করে চলেছি কিছুই চিন্তা না করে। তাদের কোনো জায়গায় বিকার ঘটলে তবেই তার দুঃখবোধে দেহব্যবস্থা সম্বন্ধে বিশেষ করে চেতনা জেগে ওঠে।
আমাদের ভাষাকেও আমরা তেমনি দিনরাত্রি বহন করে নিয়ে চলেছি। শব্দপুঞ্জে বিশেষ্যে বিশেষণে সর্বনামে বচনে লিঙ্গে সন্ধিপ্রত্যয়ে এই ভাষা অত্যন্ত বিপুল এবং জটিল। অথচ তার কোনো ভার নেই আমাদের মনে, বিশেষ কোনো চিন্তা নেই। তার নিয়মগুলো কোথাও সংগত কোথাও অসংগত, তা নিয়ে পদে পদে বিচার ক'রে চলতে হয় না।
আমাদের প্রাণশক্তি যেমন প্রতিনিয়ত বর্ণে গন্ধে রূপে রসে বোধের জাল বিস্তার করে চলেছে, আমাদের ভাষাও তেমনি সৃষ্টি করছে কত ছবি, কত রস-- তার ছন্দে, তার শব্দে। কত রকমের তার জাদুশক্তি। মানুষ যখন কালের নেপথ্যে অন্তর্ধান করে তখনো তার বাণীর লীলা সজীব হয়ে থাকে ইতিহাসের রঙ্গভূমিতে। আলোকের রঙ্গশালায় গ্রহতারার নাট্য চলেছে অনাদিকাল থেকে। তা নিয়ে বিজ্ঞানীর বিস্ময়ের অন্ত নেই। দেশকালে মানুষের ভাষারঙ্গের সীমা তার চেয়ে অনেক সংকীর্ণ, কিন্তু বাণীলোকের রহস্যের বিস্ময়করতা এই নক্ষত্রলোকের চেয়ে অনেক গভীর ও অভাবনীয়। নক্ষত্রলোকের তেজ বহুলক্ষ তারা-চলার পথ পেরিয়ে আজ আমাদের চোখে এসে পৌঁছল; কিন্তু তার চেয়ে আরও অনেক বেশি আশ্চর্য যে, আমাদের ভাষা নীহারিকাচক্রে ঘূর্ণ্যমান সেই নক্ষত্রলোককে স্পর্শ করতে পেরেছে।
আমাকে কোনো ভাষাতাত্ত্বিক অনুরোধ করেছিলেন আমার এই প্রকাশোন্মুখ বইখানিতে আমি যেন ভাষাবিজ্ঞানের ভূমিকা করে কাজ আরম্ভ করি। তার যে উত্তর দিয়েছিলুম নিম্নে তা উদ্ধৃত করে দিই। সেটা পড়লে পাঠকেরা বুঝবেন আমার বইখানি তত্ত্বের পরিচয় নিয়ে নয়, রূপের পরিচয় নিয়ে।--
আমার পক্ষে যা সবচেয়ে দুঃসাধ্য তাই তুমি আমাকে ফরমাশ করেছ। অর্থাৎ মানুষের মূর্তির ব্যাখ্যা করবার ভার যে নিয়েছে তাকে তুমি মানুষের শরীরবিজ্ঞানের উপদেষ্টার মঞ্চে চড়াতে চাও। অহংকারে মানুষকে নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে অন্ধ করে-- মধুসূদনের কাছে আমার প্রার্থনা এই যে, দর্পহরণ করবার প্রয়োজন ঘটবার পূর্বেই তিনি আমাকে যেন কৃপা করেন। আমার এ গ্রন্থে ব্যাকরণের বন্ধুর পথ একেবারেই এড়াতে পারি নি, প্রতি মুহূর্তে পদস্খলনের আশঙ্কায় কম্পান্বিত আছি। ভয় আছে, পাছে আমার স্পর্ধা দেখে তাত্ত্বিকেরা "হায় কৃষ্টি' "হায় কৃষ্টি' ব'লে বক্ষে করাঘাত করতে থাকেন। কোনো কোনো বিখ্যাত রূপশিল্পী শারীরতত্ত্বের যাথাতথ্যে ভুল করেও চিত্রকলায় প্রশংসিত হয়েছেন, আমার বইখানি যদি সেই সৌভাগ্য লাভ করে তা হলেই ধন্য হব।
১৬|১১|৩৮
৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন
আমাদের ভাষাকেও আমরা তেমনি দিনরাত্রি বহন করে নিয়ে চলেছি। শব্দপুঞ্জে বিশেষ্যে বিশেষণে সর্বনামে বচনে লিঙ্গে সন্ধিপ্রত্যয়ে এই ভাষা অত্যন্ত বিপুল এবং জটিল। অথচ তার কোনো ভার নেই আমাদের মনে, বিশেষ কোনো চিন্তা নেই। তার নিয়মগুলো কোথাও সংগত কোথাও অসংগত, তা নিয়ে পদে পদে বিচার ক'রে চলতে হয় না।
আমাদের প্রাণশক্তি যেমন প্রতিনিয়ত বর্ণে গন্ধে রূপে রসে বোধের জাল বিস্তার করে চলেছে, আমাদের ভাষাও তেমনি সৃষ্টি করছে কত ছবি, কত রস-- তার ছন্দে, তার শব্দে। কত রকমের তার জাদুশক্তি। মানুষ যখন কালের নেপথ্যে অন্তর্ধান করে তখনো তার বাণীর লীলা সজীব হয়ে থাকে ইতিহাসের রঙ্গভূমিতে। আলোকের রঙ্গশালায় গ্রহতারার নাট্য চলেছে অনাদিকাল থেকে। তা নিয়ে বিজ্ঞানীর বিস্ময়ের অন্ত নেই। দেশকালে মানুষের ভাষারঙ্গের সীমা তার চেয়ে অনেক সংকীর্ণ, কিন্তু বাণীলোকের রহস্যের বিস্ময়করতা এই নক্ষত্রলোকের চেয়ে অনেক গভীর ও অভাবনীয়। নক্ষত্রলোকের তেজ বহুলক্ষ তারা-চলার পথ পেরিয়ে আজ আমাদের চোখে এসে পৌঁছল; কিন্তু তার চেয়ে আরও অনেক বেশি আশ্চর্য যে, আমাদের ভাষা নীহারিকাচক্রে ঘূর্ণ্যমান সেই নক্ষত্রলোককে স্পর্শ করতে পেরেছে।
আমাকে কোনো ভাষাতাত্ত্বিক অনুরোধ করেছিলেন আমার এই প্রকাশোন্মুখ বইখানিতে আমি যেন ভাষাবিজ্ঞানের ভূমিকা করে কাজ আরম্ভ করি। তার যে উত্তর দিয়েছিলুম নিম্নে তা উদ্ধৃত করে দিই। সেটা পড়লে পাঠকেরা বুঝবেন আমার বইখানি তত্ত্বের পরিচয় নিয়ে নয়, রূপের পরিচয় নিয়ে।--
আমার পক্ষে যা সবচেয়ে দুঃসাধ্য তাই তুমি আমাকে ফরমাশ করেছ। অর্থাৎ মানুষের মূর্তির ব্যাখ্যা করবার ভার যে নিয়েছে তাকে তুমি মানুষের শরীরবিজ্ঞানের উপদেষ্টার মঞ্চে চড়াতে চাও। অহংকারে মানুষকে নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে অন্ধ করে-- মধুসূদনের কাছে আমার প্রার্থনা এই যে, দর্পহরণ করবার প্রয়োজন ঘটবার পূর্বেই তিনি আমাকে যেন কৃপা করেন। আমার এ গ্রন্থে ব্যাকরণের বন্ধুর পথ একেবারেই এড়াতে পারি নি, প্রতি মুহূর্তে পদস্খলনের আশঙ্কায় কম্পান্বিত আছি। ভয় আছে, পাছে আমার স্পর্ধা দেখে তাত্ত্বিকেরা "হায় কৃষ্টি' "হায় কৃষ্টি' ব'লে বক্ষে করাঘাত করতে থাকেন। কোনো কোনো বিখ্যাত রূপশিল্পী শারীরতত্ত্বের যাথাতথ্যে ভুল করেও চিত্রকলায় প্রশংসিত হয়েছেন, আমার বইখানি যদি সেই সৌভাগ্য লাভ করে তা হলেই ধন্য হব।
১৬|১১|৩৮
৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন
Bangladesh Rising
(Every year Nat Geo honors ten individuals from the world under different categories, and it's an elite group of explorers and adventure seekers in the past who's been included in this prestigious award list, mostly made up of westerners. In their words, they selected our WASFIA "for her activism and commitment to empowering women through her work in the field of adventure."
Hardly anyone from Asia is in the list and of course the first from Bangladesh.
Additionally, there is a second award called the People's Choice Award where one can vote everyday for each of the ten individuals - One can vote everyday from now to January)
--
জীবনে, অনেকক তো ভোট দিলাম
৪৩ বছর থেকেই তো দেশকে পরিচিত করতে চাচ্ছি বিশ্বের কাছে
১ পা আগাই... ২ পা পিছাই
পরিবর্তন ‘আসবে আসবে আসবে আসবে’ করতে করতে মাঝে মাঝে ভুলে যাই যে; "আমরাই হলাম পরিবর্তন, we are THE change"
বিশ্বজুড়ে যারা এডভেঞ্চার এবং এক্সপ্লোর করে আসছে, এরকম বেঁছে বেঁছে ১০ জনকে NAT GEO প্রতি বছর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সম্মাননা দেয়
এবার, পুরো এশিয়া থেকে আমাদের ওয়াসফিয়া তার দুঃসাহসী অভিযানের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে নিজের অঙ্গীকার ও কর্মতৎপরতার জন্য সেলেক্টেড হয়েছে
গর্ব করার মতো ব্যাপার
এখানে একটা People's Choice Award আছে ... আপনারা চাইলে তাকে ভোট দিতে পারবেন এই লিঙ্কে যেয়ে http://on.natgeo.com/1E8oMz3
একটু আগে তার সাথে আলাপ হলো... প্রচন্ড খুশি সে... দেশ বিদেশ থেকে প্রচুর টুইট, ইনবক্স, ম্যাসেজ আসছে তার কাছে... কয়েকজন তো বিদেশ থেকে ফোন করে হাউমাউ করে কেঁদে দিয়েছে খুশিতে
কিন্তু চোখ মুছতে মুছতে টেলিফোন রেখে, তারা ভোট দিতে ভুলে গেছে
... দেশ আগাবে কেমনে?
আবেগ সাইডে রেখে আসেন এবার বেগের সহিত ভোট দিতে থাকি
চলুক
বিশ্ব চিনুক ... জানুকক ... #BangladeshRising
লেখক ঃ আরিফ আর হোসাইন
এক বছরের রাজা - সুকুমার রায়
এক ছিলেন সওদাগর— তাঁর একটি সামান্য ক্রীতদাস তাঁর একমাত্র ছেলেকে জল থেকে বাঁচায়। সওদাগর খুশি হয়ে তাকে মুক্তি তো দিলেনই, তা ছাড়া জাহাজ বোঝাই ক'রে নানা রকম বাণিজ্যের জিনিস তাকে বকশিশ দিয়ে বললেন, "সমুদ্র পার হয়ে বিদেশে যাও— এই সব জিনিস বেচে যা টাকা পাবে, সবই তোমার।" ক্রীতদাস মনিবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জাহাজে চড়ে রওনা হল বাণিজ্য করতে।
কিন্তু বাণিজ্য করা আর হল না। সমুদ্রের মাঝখানে তুফান উঠে জাহাজটিকে ভেঙ্গে-চুরে জিনিসপত্র লোকজন কোথায় যে ভাসিয়ে নিল, তার আর খোঁজ পাওয়া গেল না।
ক্রীতদাসটি অনেক কষ্টে হাবুডুবু খেয়ে, একটা দ্বীপের চড়ায় এসে ঠেকল। সেখানে ডাঙ্গায় উঠে সে চারিদিকে চেয়ে দেখল, তার জাহাজের চিহ্নমাত্র নাই, তার সঙ্গের লোকজন কেউ নাই। তখন সে হতাশ হয়ে সমুদ্রের ধারে বালির উপর বসে পড়ল। তারপর যখন সন্ধ্যা হয়ে এল, তখন সে উঠে দ্বীপের ভিতর দিকে যেতে লাগল। সেখানে বড় বড় গাছের বন— তারপর প্রকাণ্ড মাঠ, আর তারই ঠিক মাঝখানে চমৎকার শহর। শহরের ফটক দিয়ে মশাল হাতে মেলাই লোক বার হচ্ছে। তাকে দেখতে পেয়েই সেই লোকেরা চীৎকার ক'রে বলল, "মহারাজের শুভাগমন হোক। মহারাজ দীর্ঘজীবী হউন।" তারপর সবাই তাকে খাতির ক'রে জমকালো গাড়িতে চড়িয়ে প্রকাণ্ড এক প্রাসাদে নিয়ে গেল। সেখানের চাকরগুলো তাড়াতাড়ি রাজপোশাক এনে তাকে সাজিয়ে দিল।
সবাই বলছে, 'মহারাজ','মহারাজ', হুকুম মাত্র সবাই চট্পট্ কাজ করছে, এসব দেখেশুনে সে বেচারা একেবারে অবাক। সে ভাবল সবই বুঝি স্বপ্ন— বুঝি তার নিজেরই মাথা খারাপ হয়েছে তাই এরকম মনে হচ্ছে। কিন্তু ক্রমে সে বুঝতে পারল সে জেগেই আছে আর দিব্যি জ্ঞানও রয়েছে, আর যা যা ঘটছে সব সত্যিই। তখন সে লোকদের বলল, "এ কি রকম হচ্ছে বল তো? আমি তো এর কিছুই বুঝছি না। তোমরা কেনই বা আমায় 'মহারাজ' বলছ আর কেনই বা এমন সম্মান দেখাচ্ছ?"
তখন তাদের মধ্যে থেকে এক বুড়ো উঠে বলল, "মহারাজ, আমরা কেউ মানুষ নই— আমরা সকলেই প্রেতগন্ধর্ব— যদিও আমাদের চেহারা ঠিক মানুষের মতো। অনেক দিন আগে আমরা, 'মানুষ রাজা' পাবার জন্য সবাই মিলে প্রার্থনা করেছিলাম; কারণ মানুষের মতো বুদ্ধিমান আর কে আছে? সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের মানুষ রাজার অভাব হয়নি। প্রতি বৎসরে একটি ক'রে মানুষ এইখানে আসে আর আমরা তাকে এক বৎসরের জন্য রাজা করি। তার রাজত্ব শুধু ঐ এক বৎসরের জন্যই। বৎসর শেষ হলেই তাকে সব ছাড়তে হয়। তাকে জাহাজে ক'রে সেই মরুভূমির দেশে রেখে আসা হয়, সেখানে সামান্য ফল ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না— আর সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বালি না খুঁড়লে এক ঘটি জলও মেলে না। তারপর আবার নূতন রাজা আসে— এই রকমে বৎসরের পর বৎসর আমাদের চলে আসছে।"
তখন দাসরাজা বললেন, "আচ্ছা বল তো— এর আগে তোমাদের রাজারা কি রকম স্বভাবের লোক ছিলেন?" বুড়ো বলল, "তাঁরা সবাই ছিলেন অসাবধান আর খামখেয়ালি। সারাটি বছর সবাই শুধু জাঁকজমক আমোদে আহ্লাদে দিন কাটাতেন— বছর শেষে কি হবে সে কথা ভাবতেন না।"
নতুন রাজা মন দিয়ে সব শুনলেন, বছরের শেষে তাঁর কি হবে এই কথা ভেবে ক'দিন তাঁর ঘুম হল না।
তারপর সে দেশের সকলের চেয়ে জ্ঞানী আর পণ্ডিত যারা, তাদের ডেকে আনা হল, আর রাজা তাদের কাছে মিনতি ক'রে বললেন, "আপনারা আমাকে উপদেশ দিন— যাতে বছর শেষে এই সর্বনেশে দিনের জন্য প্রস্তুত হতে পারি।"
তখন সবচেয়ে প্রবীণ বৃদ্ধ যে, সে বলল, "মহারাজ, শূন্য হাতে আপনি এসেছিলেন, শূন্য হাতেই আবার সে দেশে যেতে হবে— কিন্তু এই এক বছর আপনি আমাদের যা ইচ্ছা তাই করাতে পারেন। আমি বলি— এই বেলা রাজ্যের ওস্তাদ লোকদের সে দেশে পাঠিয়ে, সেখানে বাড়ি ক'রে, বাগান ক'রে, চাষবাসের ব্যবস্থা ক'রে চারিদিক সুন্দর করে রাখুন। ততদিনে ফলে ফুলে দেশ ভরে উঠবে, সেখানে লোকের যাতায়াত হবে। আপনার এখানকার রাজত্ব শেষ হতেই সেখানে আপনি সুখে রাজত্ব করবেন। বৎসর তো দেখতে দেখতে চলে যাবে, অথচ কাজ আপনার ঢের; কাজেই বলি, এই বেলা খেটে-খুটে সব ঠিক ক'রে নিন।" রাজা তখনই হুকুম দিয়ে লোকলস্কর, জিনিসপত্র, গাছে চারা, ফলের বীজ, আর বড় বড় কলকব্জা পাঠিয়ে, আগে থেকে সেই মরুভূমিকে সুন্দর ক'রে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলেন।
তারপর বছর যখন ফুরিয়ে এল, তখন প্রজারা তাঁর ছত্র মুকুট রাজদণ্ড সব ফিরিয়ে নিল, তাঁর রাজার পোশাক ছাড়িয়ে এক বছর আগেকার সেই সামান্য কাপড় পরিয়ে, তাঁকে জাহাজে তুলে সেই মরুভূমির দেশে রেখে এল। কিন্তু সে দেশ আর এখন মরুভূমি নেই— চারিদিকে ঘর বাড়ি, পথ ঘাট, পুকুর বাগান। সে দেশ এখন লোকে লোকারণ্য। তারা সবাই এসে ফুর্তি ক'রে শঙ্খ ঘণ্টা বাজিয়ে তাঁকে নিয়ে সিংহাসনে বসিয়ে দিল। এক বছরের রাজা সেখানে জন্ম ভরে রাজত্ব করতে লাগলেন।
(শিশু সাহিত্য)
কিন্তু বাণিজ্য করা আর হল না। সমুদ্রের মাঝখানে তুফান উঠে জাহাজটিকে ভেঙ্গে-চুরে জিনিসপত্র লোকজন কোথায় যে ভাসিয়ে নিল, তার আর খোঁজ পাওয়া গেল না।
ক্রীতদাসটি অনেক কষ্টে হাবুডুবু খেয়ে, একটা দ্বীপের চড়ায় এসে ঠেকল। সেখানে ডাঙ্গায় উঠে সে চারিদিকে চেয়ে দেখল, তার জাহাজের চিহ্নমাত্র নাই, তার সঙ্গের লোকজন কেউ নাই। তখন সে হতাশ হয়ে সমুদ্রের ধারে বালির উপর বসে পড়ল। তারপর যখন সন্ধ্যা হয়ে এল, তখন সে উঠে দ্বীপের ভিতর দিকে যেতে লাগল। সেখানে বড় বড় গাছের বন— তারপর প্রকাণ্ড মাঠ, আর তারই ঠিক মাঝখানে চমৎকার শহর। শহরের ফটক দিয়ে মশাল হাতে মেলাই লোক বার হচ্ছে। তাকে দেখতে পেয়েই সেই লোকেরা চীৎকার ক'রে বলল, "মহারাজের শুভাগমন হোক। মহারাজ দীর্ঘজীবী হউন।" তারপর সবাই তাকে খাতির ক'রে জমকালো গাড়িতে চড়িয়ে প্রকাণ্ড এক প্রাসাদে নিয়ে গেল। সেখানের চাকরগুলো তাড়াতাড়ি রাজপোশাক এনে তাকে সাজিয়ে দিল।
সবাই বলছে, 'মহারাজ','মহারাজ', হুকুম মাত্র সবাই চট্পট্ কাজ করছে, এসব দেখেশুনে সে বেচারা একেবারে অবাক। সে ভাবল সবই বুঝি স্বপ্ন— বুঝি তার নিজেরই মাথা খারাপ হয়েছে তাই এরকম মনে হচ্ছে। কিন্তু ক্রমে সে বুঝতে পারল সে জেগেই আছে আর দিব্যি জ্ঞানও রয়েছে, আর যা যা ঘটছে সব সত্যিই। তখন সে লোকদের বলল, "এ কি রকম হচ্ছে বল তো? আমি তো এর কিছুই বুঝছি না। তোমরা কেনই বা আমায় 'মহারাজ' বলছ আর কেনই বা এমন সম্মান দেখাচ্ছ?"
তখন তাদের মধ্যে থেকে এক বুড়ো উঠে বলল, "মহারাজ, আমরা কেউ মানুষ নই— আমরা সকলেই প্রেতগন্ধর্ব— যদিও আমাদের চেহারা ঠিক মানুষের মতো। অনেক দিন আগে আমরা, 'মানুষ রাজা' পাবার জন্য সবাই মিলে প্রার্থনা করেছিলাম; কারণ মানুষের মতো বুদ্ধিমান আর কে আছে? সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের মানুষ রাজার অভাব হয়নি। প্রতি বৎসরে একটি ক'রে মানুষ এইখানে আসে আর আমরা তাকে এক বৎসরের জন্য রাজা করি। তার রাজত্ব শুধু ঐ এক বৎসরের জন্যই। বৎসর শেষ হলেই তাকে সব ছাড়তে হয়। তাকে জাহাজে ক'রে সেই মরুভূমির দেশে রেখে আসা হয়, সেখানে সামান্য ফল ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না— আর সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বালি না খুঁড়লে এক ঘটি জলও মেলে না। তারপর আবার নূতন রাজা আসে— এই রকমে বৎসরের পর বৎসর আমাদের চলে আসছে।"
তখন দাসরাজা বললেন, "আচ্ছা বল তো— এর আগে তোমাদের রাজারা কি রকম স্বভাবের লোক ছিলেন?" বুড়ো বলল, "তাঁরা সবাই ছিলেন অসাবধান আর খামখেয়ালি। সারাটি বছর সবাই শুধু জাঁকজমক আমোদে আহ্লাদে দিন কাটাতেন— বছর শেষে কি হবে সে কথা ভাবতেন না।"
নতুন রাজা মন দিয়ে সব শুনলেন, বছরের শেষে তাঁর কি হবে এই কথা ভেবে ক'দিন তাঁর ঘুম হল না।
তারপর সে দেশের সকলের চেয়ে জ্ঞানী আর পণ্ডিত যারা, তাদের ডেকে আনা হল, আর রাজা তাদের কাছে মিনতি ক'রে বললেন, "আপনারা আমাকে উপদেশ দিন— যাতে বছর শেষে এই সর্বনেশে দিনের জন্য প্রস্তুত হতে পারি।"
তখন সবচেয়ে প্রবীণ বৃদ্ধ যে, সে বলল, "মহারাজ, শূন্য হাতে আপনি এসেছিলেন, শূন্য হাতেই আবার সে দেশে যেতে হবে— কিন্তু এই এক বছর আপনি আমাদের যা ইচ্ছা তাই করাতে পারেন। আমি বলি— এই বেলা রাজ্যের ওস্তাদ লোকদের সে দেশে পাঠিয়ে, সেখানে বাড়ি ক'রে, বাগান ক'রে, চাষবাসের ব্যবস্থা ক'রে চারিদিক সুন্দর করে রাখুন। ততদিনে ফলে ফুলে দেশ ভরে উঠবে, সেখানে লোকের যাতায়াত হবে। আপনার এখানকার রাজত্ব শেষ হতেই সেখানে আপনি সুখে রাজত্ব করবেন। বৎসর তো দেখতে দেখতে চলে যাবে, অথচ কাজ আপনার ঢের; কাজেই বলি, এই বেলা খেটে-খুটে সব ঠিক ক'রে নিন।" রাজা তখনই হুকুম দিয়ে লোকলস্কর, জিনিসপত্র, গাছে চারা, ফলের বীজ, আর বড় বড় কলকব্জা পাঠিয়ে, আগে থেকে সেই মরুভূমিকে সুন্দর ক'রে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলেন।
তারপর বছর যখন ফুরিয়ে এল, তখন প্রজারা তাঁর ছত্র মুকুট রাজদণ্ড সব ফিরিয়ে নিল, তাঁর রাজার পোশাক ছাড়িয়ে এক বছর আগেকার সেই সামান্য কাপড় পরিয়ে, তাঁকে জাহাজে তুলে সেই মরুভূমির দেশে রেখে এল। কিন্তু সে দেশ আর এখন মরুভূমি নেই— চারিদিকে ঘর বাড়ি, পথ ঘাট, পুকুর বাগান। সে দেশ এখন লোকে লোকারণ্য। তারা সবাই এসে ফুর্তি ক'রে শঙ্খ ঘণ্টা বাজিয়ে তাঁকে নিয়ে সিংহাসনে বসিয়ে দিল। এক বছরের রাজা সেখানে জন্ম ভরে রাজত্ব করতে লাগলেন।
(শিশু সাহিত্য)
বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা
বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা জিনিস টাই এমন, যে এটা কখনো কোনো অবস্থাতেই কিনতে পাওয়া যায়না, শেখা যায়না বা অধিকারে আনা যায়না। এটা বহুদিনের অধ্যাবসায়ে ধীরে ধীরে অর্জন করা যায়।
দুদিনের পরিচয়েই কারো কাছ থেকে শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস আশা করাটা ভুল এবং বোকামীর পরিচয়। এগুলো রেডিমেড জিনিস নয় যে বাজারে গেলাম আর কিনে নিয়ে এলাম। সম্পর্ক কে নিয়মিত পরিচর্যা এবং ব্যক্তির কর্ম, মুল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রকাশভঙ্গীর মাধ্যমে বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা অর্জিত হয়।
দুদিনের পরিচয়েই কারো কাছ থেকে শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস আশা করাটা ভুল এবং বোকামীর পরিচয়। এগুলো রেডিমেড জিনিস নয় যে বাজারে গেলাম আর কিনে নিয়ে এলাম। সম্পর্ক কে নিয়মিত পরিচর্যা এবং ব্যক্তির কর্ম, মুল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রকাশভঙ্গীর মাধ্যমে বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা অর্জিত হয়।
প্রতিটি সমস্যাই আবর্জনার মতো
এক কৃষকের একটা গাধা ছিল। গাধাটা একদিন অগভীর কুয়ায় পড়লো। কিন্তু কুয়াটার গভীরতা গাধার উচ্চতা থেকে বেশি হওয়াতে অবলা প্রাণীটি উঠে আসতে পারছিল না। গাধার ত্রাহি চিৎকারে কৃষক এবং আশপাশের মানুষ ছুটে আসল। কিন্তু ওরাও বুঝে উঠতে পারল না কী করবে।
ঘণ্টাখানেক নানাভাবে চেষ্টা করার পরও যখন গাধাকে উপরে তুলে আনা গেল না, কৃষক তখন চিন্তা করল, কুয়াটা আগে থেকেই বিপজ্জনক। বেশ কয়েকটি বাচ্চা কুয়াতে পড়ে বারবার আহত হয়েছে। কুয়াটা এমনিতেই ভরাট করতে হবে, তার উপর গাধাটা অনেক বুড়ো এবং দুর্বল হয়ে গেছে। তাই কৃষক সিদ্ধান্ত নিল গাধাসহ কুয়াটি ভরাট করে ফেলবে।
কৃষক সবাইকে ডাক দিয়ে হেল্প করতে বলল। সবাই হাতে বেলচা এবং কোদাল নিয়ে পাশ থেকে মাটি কেটে কুয়াতে ফেলতে লাগল। কিছু মাটির দলা গিয়ে গাধাটির উপরেও পড়ল। ওদের মাটি ফেলা দেখে গাধাটি বুঝতে পারল কি ঘটতে চলেছে, প্রাণী টি ভয়ে-দুঃখে নিরবে কাঁদতে লাগল।
কিছুক্ষণ মাটি ফেলার পরে সবাই হঠাৎ চমকে গেল, কারণ গাধাটি অদ্ভুত একটা কাণ্ড করে বসেছে। সবাই যখন গাধার উপরে মাটি ফেলছে, গাধাটি তখন গা-ঝাড়া দিয়ে মাটি নিচে ফেলে দিচ্ছে এবং এক-পা, এক-পা করে ভরাট হওয়া জায়গাতে অবস্থান নিচ্ছে। সবাই এবার দ্রুত গাধার উপরে মাটি ফেলতে শুরু করল, গাধাটিও তত দ্রুত মাটি গায়ের ওপর থেকে ঝেড়ে ফেলে ভরাট হওয়া জায়গাতে এসে দাঁড়ায়।
এভাবে কিছুক্ষণ মাটি ফেলার পর সবাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করল কুয়াটি প্রায় ভর্তি হয়ে গেছে, অবশেষে গাধা কুয়া থেকে বেরিয়ে আসলো।
…জীবনে চলার পথে এমন অসংখ্য কুয়াতে আপনি পড়বেন, যা থেকে উঠে আসার মতো সক্ষমতা হয়তো আপনার থাকবে না। আশপাশের মানুষগুলো আপনাকে টেনে তোলার পরিবর্তে আপনাকে আরো ডুবিয়ে দিতে চাইবে।
কিন্তু এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আপনাকে ওই গাধা টির মতই গা-থেকে আবর্জনাগুলো একটু একটু করে ঝাড়া দিয়ে ফেলতে হবে যতক্ষণ না ওই আবর্জনাতে কুয়াটা পূর্ণ হয়ে যায়। যখনই সমস্যা এসে আপনার শরীর এবং মনের উপরে চেপে বসবে, প্রতিবার একটু একটু করে ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিবেন। তারপর মাথা উঁচু করে একটু আগে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া সমস্যার উপরে গিয়ে দাঁড়াবেন।
প্রতিটি সমস্যা-ই আবর্জনার মতো। আপনি থেমে থাকলে আবর্জনার পাহাড় এসে আপনাকে জীবন্ত কবর দিয়ে দেবে। তাই কখনোই হাল ছাড়বেন না। থেমে থাকবেন না।
ঘণ্টাখানেক নানাভাবে চেষ্টা করার পরও যখন গাধাকে উপরে তুলে আনা গেল না, কৃষক তখন চিন্তা করল, কুয়াটা আগে থেকেই বিপজ্জনক। বেশ কয়েকটি বাচ্চা কুয়াতে পড়ে বারবার আহত হয়েছে। কুয়াটা এমনিতেই ভরাট করতে হবে, তার উপর গাধাটা অনেক বুড়ো এবং দুর্বল হয়ে গেছে। তাই কৃষক সিদ্ধান্ত নিল গাধাসহ কুয়াটি ভরাট করে ফেলবে।
কৃষক সবাইকে ডাক দিয়ে হেল্প করতে বলল। সবাই হাতে বেলচা এবং কোদাল নিয়ে পাশ থেকে মাটি কেটে কুয়াতে ফেলতে লাগল। কিছু মাটির দলা গিয়ে গাধাটির উপরেও পড়ল। ওদের মাটি ফেলা দেখে গাধাটি বুঝতে পারল কি ঘটতে চলেছে, প্রাণী টি ভয়ে-দুঃখে নিরবে কাঁদতে লাগল।
কিছুক্ষণ মাটি ফেলার পরে সবাই হঠাৎ চমকে গেল, কারণ গাধাটি অদ্ভুত একটা কাণ্ড করে বসেছে। সবাই যখন গাধার উপরে মাটি ফেলছে, গাধাটি তখন গা-ঝাড়া দিয়ে মাটি নিচে ফেলে দিচ্ছে এবং এক-পা, এক-পা করে ভরাট হওয়া জায়গাতে অবস্থান নিচ্ছে। সবাই এবার দ্রুত গাধার উপরে মাটি ফেলতে শুরু করল, গাধাটিও তত দ্রুত মাটি গায়ের ওপর থেকে ঝেড়ে ফেলে ভরাট হওয়া জায়গাতে এসে দাঁড়ায়।
এভাবে কিছুক্ষণ মাটি ফেলার পর সবাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করল কুয়াটি প্রায় ভর্তি হয়ে গেছে, অবশেষে গাধা কুয়া থেকে বেরিয়ে আসলো।
…জীবনে চলার পথে এমন অসংখ্য কুয়াতে আপনি পড়বেন, যা থেকে উঠে আসার মতো সক্ষমতা হয়তো আপনার থাকবে না। আশপাশের মানুষগুলো আপনাকে টেনে তোলার পরিবর্তে আপনাকে আরো ডুবিয়ে দিতে চাইবে।
কিন্তু এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আপনাকে ওই গাধা টির মতই গা-থেকে আবর্জনাগুলো একটু একটু করে ঝাড়া দিয়ে ফেলতে হবে যতক্ষণ না ওই আবর্জনাতে কুয়াটা পূর্ণ হয়ে যায়। যখনই সমস্যা এসে আপনার শরীর এবং মনের উপরে চেপে বসবে, প্রতিবার একটু একটু করে ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিবেন। তারপর মাথা উঁচু করে একটু আগে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া সমস্যার উপরে গিয়ে দাঁড়াবেন।
প্রতিটি সমস্যা-ই আবর্জনার মতো। আপনি থেমে থাকলে আবর্জনার পাহাড় এসে আপনাকে জীবন্ত কবর দিয়ে দেবে। তাই কখনোই হাল ছাড়বেন না। থেমে থাকবেন না।
রাগ নিয়ন্ত্রণ - একটি শিক্ষামূলক গল্প
→খুব ছোট্ট এক ছেলে প্রচন্ড রাগী ছিলো।সে খুব সামান্য কারণেই রেগে যেত । তার বাবা তাকে একটা পেরেক ভর্তি ব্যাগ দিল এবং বললো যে,যতবার তুমি রেগে যাবে ততবার একটা করে পেরেক আমাদের বাগানের কাঠের বেড়াতে লাগিয়ে আসবে।
→প্রথম দিনেই ছেলেটিকে বাগানে গিয়ে ৩৭ টি পেরেক মারতে হলো।পরের কয়েক সপ্তাহে ছেলেটি তার রাগকে কিছুটা নিয়ন্ত্রনে আনতে পারলো তাই প্রতিদিন কাঠে নতুন পেরেকের সংখ্যাও ধীরে ধীরে কমে এলো।
সে বুঝতে পারলো হাতুড়ী দিয়ে কাঠের বেড়ায় পেরেক বসানোর চেয়ে তার রাগকে নিয়ন্ত্রন করা অনেক বেশি সহজ।শেষ পর্যন্ত সেই দিনটি এলো যেদিন তাকে একটি পেরেকও মারতে হলো না।সে তার বাবাকে এই কথা জানালো।তারা বাবা তাকে বললো,এখন তুমি যেসব দিনে তোমার রাগকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রন করতে পারবে সেসব দিনে একটি একটি করে পেরেক খুলে ফেলো।অনেক দিন চলে গেল এবং ছেলেটি একদিন তার বাবাকে জানালো যে সব পেরেকই খুলে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
→তার বাবা এবার তাকে নিয়ে বাগানে গেল এবং কাঠের বেড়াটি দেখিয়ে বললো,
‘তুমি খুব ভালভাবে তোমার কাজসম্পন্ন করেছো,এখন তুমি তোমার রাগকে নিয়ন্ত্রন করতে পারো কিন্তু দেখো,প্রতিটা কাঠে পেরেকের গর্তগুলোএখনো রয়ে গিয়েছে।কাঠের বেড়াটিকখনো আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না।যখন তুমি কাউকে রেগে গিয়ে কিছু বলো তখন তার মনে তুমি যেন একটি পেরেক ঠুকলে পরবর্তিতে যদি তুমি তোমার কথা ফিরিয়েও নাও তখনও তার মনে ঠিক এমন একটা আচড় থেকে যায়।
→তাই নিজের রাগতে নিয়ন্ত্রন করতে শেখো।মানসিক ক্ষত অনেক সময় শারীরিক ক্ষতেরচেয়েও অনেক বেশি ভয়ংকর।
→প্রথম দিনেই ছেলেটিকে বাগানে গিয়ে ৩৭ টি পেরেক মারতে হলো।পরের কয়েক সপ্তাহে ছেলেটি তার রাগকে কিছুটা নিয়ন্ত্রনে আনতে পারলো তাই প্রতিদিন কাঠে নতুন পেরেকের সংখ্যাও ধীরে ধীরে কমে এলো।
সে বুঝতে পারলো হাতুড়ী দিয়ে কাঠের বেড়ায় পেরেক বসানোর চেয়ে তার রাগকে নিয়ন্ত্রন করা অনেক বেশি সহজ।শেষ পর্যন্ত সেই দিনটি এলো যেদিন তাকে একটি পেরেকও মারতে হলো না।সে তার বাবাকে এই কথা জানালো।তারা বাবা তাকে বললো,এখন তুমি যেসব দিনে তোমার রাগকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রন করতে পারবে সেসব দিনে একটি একটি করে পেরেক খুলে ফেলো।অনেক দিন চলে গেল এবং ছেলেটি একদিন তার বাবাকে জানালো যে সব পেরেকই খুলে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
→তার বাবা এবার তাকে নিয়ে বাগানে গেল এবং কাঠের বেড়াটি দেখিয়ে বললো,
‘তুমি খুব ভালভাবে তোমার কাজসম্পন্ন করেছো,এখন তুমি তোমার রাগকে নিয়ন্ত্রন করতে পারো কিন্তু দেখো,প্রতিটা কাঠে পেরেকের গর্তগুলোএখনো রয়ে গিয়েছে।কাঠের বেড়াটিকখনো আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না।যখন তুমি কাউকে রেগে গিয়ে কিছু বলো তখন তার মনে তুমি যেন একটি পেরেক ঠুকলে পরবর্তিতে যদি তুমি তোমার কথা ফিরিয়েও নাও তখনও তার মনে ঠিক এমন একটা আচড় থেকে যায়।
→তাই নিজের রাগতে নিয়ন্ত্রন করতে শেখো।মানসিক ক্ষত অনেক সময় শারীরিক ক্ষতেরচেয়েও অনেক বেশি ভয়ংকর।
বাংলাভাষা পরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২২)
চলতি বাংলার আর-একটি বিশেষত্ব জানিয়ে দিয়ে এ বই শেষ করি। যাঁরা সাধু ভাষায় গদ্যসাহিত্যকে রূপ দিয়েছিলেন স্বভাবতই তাঁদের হাতে বাক্যবিন্যাসের একটা ধারা বাঁধা হয়েছিল।
তার প্রয়োজন নিয়ে তর্ক নেই। আমার বক্তব্য এই যে, এ বাঁধাবাঁধি বাংলা চলতি ভাষায় নয়।
কোথায় গেলেন তোমার দাদা, তোমার দাদা কোথায় গেলেন, গেলেন কেথায় তোমার দাদা, দাদা তোমার গেলেন কোথায়, কোথায় গেলেন দাদা তোমার : প্রথম পাঁচটি বাক্যে "গেলেন' ক্রিয়াপদের উপর এবং শেষের বাক্যটিতে "কোথায়' শব্দের উপর ঝোঁক দিয়ে এই সবকটা প্রয়োগই চলে। আশ্চর্য তোমার সাহস, কিংবা, রেখে দাও তোমার চালাকি, একেবারে ভাসিয়ে দিলে কেঁদে : সাধু ভাষার ছাঁদের চেয়ে এতে আরও বেশি জোর পৌঁছয়। যা থাকে অদৃষ্টে, যা করেন ভগবান, সে প'ড়ে আছে পিছনে : এ আমরা কেবল-যে বলি তা নয়, এইটেই বলি সহজে।
বাংলা ভাষার একটা বিপদ তার ক্রিয়াপদ নিয়ে; "ইল' "তেছে' "ছিল'-যোগে বিশেষ বিশেষ কালবাচক ক্রিয়ার সমাপ্তি। ক্রিয়াপদের এই একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি এড়াবার জন্যে লেখকদের সতর্ক থাকতে হয়। বাংলা বাক্যবিন্যাসে যদি স্বাধীনতা না থাকত তা হলে উপায় থাকত না। এই স্বাধীনতা আছে বটে, কিন্তু তাই বলে স্বৈরাচার নেই। "ভাসিয়ে একেবারে দিলে কেঁদে' কিংবা "ভাসিয়ে দিলে একেবারে কেঁদে' বলি নে। "সে প'ড়ে সবার আছে পিছনে' কিংবা "রেখে চালাকি দাও তোমার' হবার জো নেই। তার কারণ জোড়া ক্রিয়ার জোড় ভাঙা অবৈধ।
চলতি গদ্যের একটা নমুনা দেওয়া যাক। এতে সাধু গদ্যভাষার বাক্যপদ্ধতি অনেকটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে--
কুঞ্জবাবু চললেন মথুরায়। তাঁর ভাই মুকুন্দ যাবে স্টেশন পর্যন্ত। বৈজু দারোয়ান চলেছে মাঠাকরুনের পাল্কির পাশে পাশে, লম্বা বাঁশের লাঠি হাতে, ছিটের মের্জাই গায়ে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। ঘর সামলাবার জন্যে রয়ে গেছে ভরু সর্দার। টেমি কুকরটা ঘুমোচ্ছিল সিমেন্টের বস্তার উপর ল্যাজে মাথা গুঁজে, গোলমাল শুনে ছুটে এল এক লাফে। যত ওরা বারণ করে ততই কেঁই কেঁই ঘেউ-ঘেউ রবে মিনতি জানায়, ঘন ঘন নাড়ে বোঁচা ল্যাজটা। রেল লাইন থেকে শোনা যাচ্ছে মালগাড়ি আসার শব্দ। ডাকগাড়ি আসতে বাকি আছে বিশ মিনিট মাত্র। বিষম ব্যস্ত হয়ে পড়ল মুকুন্দ; সে যাবে কলকাতার দিকে, আজ সেখানে মোহনবাগানের ম্যাচ। ঐ বুঝি দেখা গেল সিগ্ন্যাল-ডাউন। এ দিকে নামল ঝমাঝম্ বৃষ্টি, তার সঙ্গে জোর হাওয়া। বেহারাগুলো পাল্কি নামালো অশথতলায়। হঠাৎ একটি ভিখিরি মেয়ে ছুটে এসে বললে, "দরজা খোলো মা, একবার মুখখানি দেখে নিই।' দরজা খুলে চমকে উঠলেন গিন্নিঠাকরুন, "ওমা, ও কে গো! আমাদের বিনোদিনী যে! কে করলে ওর এ দশা!" কুকুরটা ওকে দেখেই লাফিয়ে উঠল, ওর বুকে দুই পা তুলে কাঁই-কাঁই করতে লাগল আনন্দে। বিনোদিনী একবার তার গলা জড়িয়ে ধরল দুই হাতে, তার পরেই ওকে সরিয়ে দিল, জোরে ঠেলা দিয়ে। গোলেমালে কোথায় মেয়েটি পালালো ঝড়ের আড়ালে, দেখা গেল না। চারি দিকে সন্ধানে ছুটল লোকজন। বড়োবাবু স্বয়ং হাঁকতে থাকলেন "বিনু বিনু', মিলল না কোনো সাড়া। মুকুন্দ রইল তার সেকেণ্ড ক্লাসের গাড়িতে, রুমালে মুখ লুকিয়ে একেবারে চুপ। মেলগাড়ি কখন্ গেল বেরিয়ে। বৃষ্টির বিরাম নেই।
৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন
তার প্রয়োজন নিয়ে তর্ক নেই। আমার বক্তব্য এই যে, এ বাঁধাবাঁধি বাংলা চলতি ভাষায় নয়।
কোথায় গেলেন তোমার দাদা, তোমার দাদা কোথায় গেলেন, গেলেন কেথায় তোমার দাদা, দাদা তোমার গেলেন কোথায়, কোথায় গেলেন দাদা তোমার : প্রথম পাঁচটি বাক্যে "গেলেন' ক্রিয়াপদের উপর এবং শেষের বাক্যটিতে "কোথায়' শব্দের উপর ঝোঁক দিয়ে এই সবকটা প্রয়োগই চলে। আশ্চর্য তোমার সাহস, কিংবা, রেখে দাও তোমার চালাকি, একেবারে ভাসিয়ে দিলে কেঁদে : সাধু ভাষার ছাঁদের চেয়ে এতে আরও বেশি জোর পৌঁছয়। যা থাকে অদৃষ্টে, যা করেন ভগবান, সে প'ড়ে আছে পিছনে : এ আমরা কেবল-যে বলি তা নয়, এইটেই বলি সহজে।
বাংলা ভাষার একটা বিপদ তার ক্রিয়াপদ নিয়ে; "ইল' "তেছে' "ছিল'-যোগে বিশেষ বিশেষ কালবাচক ক্রিয়ার সমাপ্তি। ক্রিয়াপদের এই একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি এড়াবার জন্যে লেখকদের সতর্ক থাকতে হয়। বাংলা বাক্যবিন্যাসে যদি স্বাধীনতা না থাকত তা হলে উপায় থাকত না। এই স্বাধীনতা আছে বটে, কিন্তু তাই বলে স্বৈরাচার নেই। "ভাসিয়ে একেবারে দিলে কেঁদে' কিংবা "ভাসিয়ে দিলে একেবারে কেঁদে' বলি নে। "সে প'ড়ে সবার আছে পিছনে' কিংবা "রেখে চালাকি দাও তোমার' হবার জো নেই। তার কারণ জোড়া ক্রিয়ার জোড় ভাঙা অবৈধ।
চলতি গদ্যের একটা নমুনা দেওয়া যাক। এতে সাধু গদ্যভাষার বাক্যপদ্ধতি অনেকটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে--
কুঞ্জবাবু চললেন মথুরায়। তাঁর ভাই মুকুন্দ যাবে স্টেশন পর্যন্ত। বৈজু দারোয়ান চলেছে মাঠাকরুনের পাল্কির পাশে পাশে, লম্বা বাঁশের লাঠি হাতে, ছিটের মের্জাই গায়ে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। ঘর সামলাবার জন্যে রয়ে গেছে ভরু সর্দার। টেমি কুকরটা ঘুমোচ্ছিল সিমেন্টের বস্তার উপর ল্যাজে মাথা গুঁজে, গোলমাল শুনে ছুটে এল এক লাফে। যত ওরা বারণ করে ততই কেঁই কেঁই ঘেউ-ঘেউ রবে মিনতি জানায়, ঘন ঘন নাড়ে বোঁচা ল্যাজটা। রেল লাইন থেকে শোনা যাচ্ছে মালগাড়ি আসার শব্দ। ডাকগাড়ি আসতে বাকি আছে বিশ মিনিট মাত্র। বিষম ব্যস্ত হয়ে পড়ল মুকুন্দ; সে যাবে কলকাতার দিকে, আজ সেখানে মোহনবাগানের ম্যাচ। ঐ বুঝি দেখা গেল সিগ্ন্যাল-ডাউন। এ দিকে নামল ঝমাঝম্ বৃষ্টি, তার সঙ্গে জোর হাওয়া। বেহারাগুলো পাল্কি নামালো অশথতলায়। হঠাৎ একটি ভিখিরি মেয়ে ছুটে এসে বললে, "দরজা খোলো মা, একবার মুখখানি দেখে নিই।' দরজা খুলে চমকে উঠলেন গিন্নিঠাকরুন, "ওমা, ও কে গো! আমাদের বিনোদিনী যে! কে করলে ওর এ দশা!" কুকুরটা ওকে দেখেই লাফিয়ে উঠল, ওর বুকে দুই পা তুলে কাঁই-কাঁই করতে লাগল আনন্দে। বিনোদিনী একবার তার গলা জড়িয়ে ধরল দুই হাতে, তার পরেই ওকে সরিয়ে দিল, জোরে ঠেলা দিয়ে। গোলেমালে কোথায় মেয়েটি পালালো ঝড়ের আড়ালে, দেখা গেল না। চারি দিকে সন্ধানে ছুটল লোকজন। বড়োবাবু স্বয়ং হাঁকতে থাকলেন "বিনু বিনু', মিলল না কোনো সাড়া। মুকুন্দ রইল তার সেকেণ্ড ক্লাসের গাড়িতে, রুমালে মুখ লুকিয়ে একেবারে চুপ। মেলগাড়ি কখন্ গেল বেরিয়ে। বৃষ্টির বিরাম নেই।
৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন
তাজউদ্দীন আহমেদ
তাজউদ্দীন আহমেদ কে নিয়ে কিছু জানার ছিল, কিছু লেখার ছিল। ১৯৭১ সালের ২০ শে ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের বিখ্যাত “টাইম ম্যাগাজিন” খুব ছোট করে তাঁকে বর্ননা করেছিল এরকমঃ
“Tajuddin Ahmed, 46. Prime Minister, a lawyer who has been a chief organizer in the Awami League since its founding in 1949. He is an expert in economics and is considered one of the party's leading intellectuals.”
বঙ্গবন্ধুর পরে এই বাঙালি ছিলেন স্বয়ংসম্পূর্ণ, বিচক্ষণ এবং মেধার দিক দিয়ে সুদূর প্রসারী চিন্তাবিদ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যিনি তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলে তাজউদ্দীন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহন করেন।
অর্থমন্ত্রী হবার পর, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতায় আগুনে পোড়া নিজের পৈত্রিক ভিটার সামনে এসে দাঁড়ালে সমবেত জনতা বলে ওঠেন, আর চিন্তা কি,
তাজউদ্দীন ভাইসাবের পোড়া ভিটায় নতুন বাড়ি উঠবে।
তিনি বলেছিলেন- “যতদিন পর্যন্ত এই বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই না হবে, ততদিন এই ভিটায় বাড়ি উঠবে না”।
-“মনে রেখ, আমি শুধু এই এলাকার মন্ত্রী না, আমি সমস্ত বাংলাদেশের মন্ত্রী। এখন তোমাদের দায়িত্ব আগের চাইতে অনেক বেশি। কারণ সমস্ত দেশের মানুষ তোমাদের কাপাসিয়ার এই মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকবে। আমি স্বার্থপরের মতো আমার এলাকার উন্নয়নের কাজে হাত দিতে পারি না। আমাকে সমস্ত দেশে সব কিছু সমান ভাগ করে দিতে হবে”
-“বাড়িতে যখন অতিথি-মেহমান আসে তখন আমরা কি করি। তাকে ভালো করে আদর যত্ন করি, তার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করি। তাকে সবচাইতে ভালো জিনিসটা খেতে দেই। তারপর যা থাকে নিজেরা ভাগ করে খাই। তোমরাও সমস্ত বাংলাদেশকে তেমনিভাবে দেখ। এসো আগে আমরা সবাই মিলে দেশ গড়ি। তখন এই এলাকা এমনিতেই আর পিছিয়ে থাকবে না”।
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে তার শিশুপুত্র সোহেল অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাকে দেখতে যেতে তিনি চাননি। এ নিয়ে তার ভারতীয় নিরাপত্তা অফিসার ও বাংলাদেশের অনেক সহকর্মী বেশ পীড়াপীড়ি করলে এক বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন:
-“প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ছেলেমেয়ে স্ত্রী তো নিরাপদেই আছে কলকাতা শহরে। এদের কথা চিন্তা করার জন্যে তো সবাই রয়েছে। যেমন আপনারা, মিস্টার চ্যাটার্জি সবাই তো আমার ছেলেমেয়েদের ও স্ত্রীর সুখ-দুঃখের চিন্তার জন্যে রয়েছেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা শত্রুবাহিনীর হামলায় পা হারিয়েছে, হাত হারিয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। কেউ গুলির আঘাতের যন্ত্রণা চেপে ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে বনে-বাদাড়ে লুকিয়ে লুকিয়ে। এদের তো অনুভূতি আছে। তাদের মা-বোন-স্ত্রী-ছেলেমেয়ে স্বজন রয়েছেন। কিন্তু তাদের কথা চিন্তা করার সময় কোথায়? মাইন বা গুলির আঘাতে যন্ত্রণাকাতর ওই মুক্তিযোদ্ধা তার ব্যথা-বেদনা চেপে ধরে সকল অনুভূতি, চিন্তা, চেতনা, দেশমুক্ত করার অগ্নিশপথে সমর্পণ করেছে। শেষ সম্বল নিজ প্রাণটিও দেয়ার জন্যে প্রস্তুত। শত্রুর হাতে মৃত্যুর পর গোর-কাফন হবে কি হবে না, কিংবা কোথায় গোর-কাফন হবে; আত্মীয়-স্বজন স্ত্রী-পুত্র-পরিবার মৃত্যুর খবরটুকু জানতে পারবে কি না এই ভাবনাটুকু কি তার মনে একবার উদয় হয়? কোথায় তার অনুভূতি? যদি প্রশ্ন করেন, তার কি কোনো অনুভূতি আছে? এ পরিস্থিতিতে এর কী জবাব আছে? পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে যদি আমার মৃত্যু হতো তাহলে আমার পরিবার-ছেলেমেয়েদের অবস্থা কি হতো? কে ভাবত তাদের কথা? যারা এরই মধ্যে নিহত হয়েছেন তাদের রেখে যাওয়া আত্মীয়-স্বজনদের কথা এ মুহূর্তে আমিও কি একটিবার ভাবছি? আপনার মনকে জিজ্ঞাসা করুন আপনিও কি ভাবছেন”?
ড. আনিসুজ্জামান তার অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণনা করেছিলেন- তিনি একদিন সকালে অফিসে এসে দেখেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের চোখ লাল হয়ে আছে, কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেন যে, -“রাতে ঝড়ো বাতাসের শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। জানালা বন্ধ করতে গিয়ে বৈরী আবহাওয়া লক্ষ করে শরণার্থী শিবিরের মানুষের কথা মনে পড়ে যায়। তারপর আর ঘুমাতে পারেননি”।
লেখক শুভ কিবরিয়ার লেখায় আরো জানা যায়- এ.আর. মল্লিক তার বইয়ে লিখেছেন:
-“একই ভবনে তাজউদ্দীনের স্ত্রী, সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরিবার বাস করতেন। কিন্তু তাজউদ্দীন সেখানে থাকতেন না। আমাকে বলেছিলেন, ‘ভাই দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমার পরিবারের সঙ্গে এক বাসাতে থাকতে চাই না। কাজেরও সুবিধা হয়, সাংসারিক ঝামেলা আমি নিতে চাই না। তার গায়ে একটি শার্টই প্রায় দেখতাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, ‘শার্ট বদলান না কেন?’ বললেন ওটাও হাঙ্গামা হবে। ‘এই শার্টটি ময়লা কম হয়, গোসল করার সময় মাঝে মাঝে ধুয়ে নিই।’
-দ্যাট ওয়াজ তাজউদ্দীন।
বঙ্গবন্ধু যখন ৭৪ সালে পাকিস্থান সফর করেন তখন তাজউদ্দীন সেই সফরের বিরোধিতা করে বলেন -“ভুট্টোর সঙ্গে যেচে মাখামাখি করার ফলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে যে অমীমাংসিত বিরোধ রয়েছে তার সমাধান বিলম্বিত হবে, এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আবার সক্রিয় হবার সাহস পাবে”।
বঙ্গবন্ধু যদিও তাঁর খুব কাছের মানুষ তাজউদ্দীনের সেই মতামত কে আগ্রাহ্য করে ইসলামী দেশগুলোর ডাকা লাহোরের সম্মেলনে যোগ দেন, বঙ্গবন্ধুর সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে ক্রমাগত, পরবর্তীতে ৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর জাতীয় স্বার্থে আবার বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গীকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন।
অথচ, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অন্যতম ঘাতক বজলুল হুদা তাজউদ্দীন কে ব্যবহার করতে এসেছিল, তাজউদ্দীন তাঁর স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন –“শেখ মুজিবের রক্তের উপর দিয়ে হেঁটে আমি প্রধানমন্ত্রি-প্রেসিডেন্ট হতে চাইনা”।
সমগ্র জাতিকে নিজ চেতনায় ধারণ করেছিলেন বলেই তার পক্ষে সম্ভব হয় শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা।
আজ আমাদের সেই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুবার্ষিকী। নাহ, তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেননি তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছিল ইতিহাসের জঘন্যতম ভাবে, নৃশংসভাবে। ৭৫ এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু খুন হবার পর প্রথমে গৃহবন্ধী, পরে সামরিক আইনে ২২ আগস্ট গ্রেফতার করে ৩রা নভেম্বর জেলেই খুন করে সেই ঘাতকেরা। তারা জানতো তাজউদ্দীন বেঁচে থাকলে আরেক বঙ্গবন্ধু রয়ে যাবে বাংলাদেশে।
আরাফাত তানিম
“Tajuddin Ahmed, 46. Prime Minister, a lawyer who has been a chief organizer in the Awami League since its founding in 1949. He is an expert in economics and is considered one of the party's leading intellectuals.”
বঙ্গবন্ধুর পরে এই বাঙালি ছিলেন স্বয়ংসম্পূর্ণ, বিচক্ষণ এবং মেধার দিক দিয়ে সুদূর প্রসারী চিন্তাবিদ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যিনি তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলে তাজউদ্দীন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহন করেন।
অর্থমন্ত্রী হবার পর, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতায় আগুনে পোড়া নিজের পৈত্রিক ভিটার সামনে এসে দাঁড়ালে সমবেত জনতা বলে ওঠেন, আর চিন্তা কি,
তাজউদ্দীন ভাইসাবের পোড়া ভিটায় নতুন বাড়ি উঠবে।
তিনি বলেছিলেন- “যতদিন পর্যন্ত এই বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই না হবে, ততদিন এই ভিটায় বাড়ি উঠবে না”।
-“মনে রেখ, আমি শুধু এই এলাকার মন্ত্রী না, আমি সমস্ত বাংলাদেশের মন্ত্রী। এখন তোমাদের দায়িত্ব আগের চাইতে অনেক বেশি। কারণ সমস্ত দেশের মানুষ তোমাদের কাপাসিয়ার এই মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকবে। আমি স্বার্থপরের মতো আমার এলাকার উন্নয়নের কাজে হাত দিতে পারি না। আমাকে সমস্ত দেশে সব কিছু সমান ভাগ করে দিতে হবে”
-“বাড়িতে যখন অতিথি-মেহমান আসে তখন আমরা কি করি। তাকে ভালো করে আদর যত্ন করি, তার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করি। তাকে সবচাইতে ভালো জিনিসটা খেতে দেই। তারপর যা থাকে নিজেরা ভাগ করে খাই। তোমরাও সমস্ত বাংলাদেশকে তেমনিভাবে দেখ। এসো আগে আমরা সবাই মিলে দেশ গড়ি। তখন এই এলাকা এমনিতেই আর পিছিয়ে থাকবে না”।
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে তার শিশুপুত্র সোহেল অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাকে দেখতে যেতে তিনি চাননি। এ নিয়ে তার ভারতীয় নিরাপত্তা অফিসার ও বাংলাদেশের অনেক সহকর্মী বেশ পীড়াপীড়ি করলে এক বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন:
-“প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ছেলেমেয়ে স্ত্রী তো নিরাপদেই আছে কলকাতা শহরে। এদের কথা চিন্তা করার জন্যে তো সবাই রয়েছে। যেমন আপনারা, মিস্টার চ্যাটার্জি সবাই তো আমার ছেলেমেয়েদের ও স্ত্রীর সুখ-দুঃখের চিন্তার জন্যে রয়েছেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা শত্রুবাহিনীর হামলায় পা হারিয়েছে, হাত হারিয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। কেউ গুলির আঘাতের যন্ত্রণা চেপে ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে বনে-বাদাড়ে লুকিয়ে লুকিয়ে। এদের তো অনুভূতি আছে। তাদের মা-বোন-স্ত্রী-ছেলেমেয়ে স্বজন রয়েছেন। কিন্তু তাদের কথা চিন্তা করার সময় কোথায়? মাইন বা গুলির আঘাতে যন্ত্রণাকাতর ওই মুক্তিযোদ্ধা তার ব্যথা-বেদনা চেপে ধরে সকল অনুভূতি, চিন্তা, চেতনা, দেশমুক্ত করার অগ্নিশপথে সমর্পণ করেছে। শেষ সম্বল নিজ প্রাণটিও দেয়ার জন্যে প্রস্তুত। শত্রুর হাতে মৃত্যুর পর গোর-কাফন হবে কি হবে না, কিংবা কোথায় গোর-কাফন হবে; আত্মীয়-স্বজন স্ত্রী-পুত্র-পরিবার মৃত্যুর খবরটুকু জানতে পারবে কি না এই ভাবনাটুকু কি তার মনে একবার উদয় হয়? কোথায় তার অনুভূতি? যদি প্রশ্ন করেন, তার কি কোনো অনুভূতি আছে? এ পরিস্থিতিতে এর কী জবাব আছে? পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে যদি আমার মৃত্যু হতো তাহলে আমার পরিবার-ছেলেমেয়েদের অবস্থা কি হতো? কে ভাবত তাদের কথা? যারা এরই মধ্যে নিহত হয়েছেন তাদের রেখে যাওয়া আত্মীয়-স্বজনদের কথা এ মুহূর্তে আমিও কি একটিবার ভাবছি? আপনার মনকে জিজ্ঞাসা করুন আপনিও কি ভাবছেন”?
ড. আনিসুজ্জামান তার অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণনা করেছিলেন- তিনি একদিন সকালে অফিসে এসে দেখেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের চোখ লাল হয়ে আছে, কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেন যে, -“রাতে ঝড়ো বাতাসের শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। জানালা বন্ধ করতে গিয়ে বৈরী আবহাওয়া লক্ষ করে শরণার্থী শিবিরের মানুষের কথা মনে পড়ে যায়। তারপর আর ঘুমাতে পারেননি”।
লেখক শুভ কিবরিয়ার লেখায় আরো জানা যায়- এ.আর. মল্লিক তার বইয়ে লিখেছেন:
-“একই ভবনে তাজউদ্দীনের স্ত্রী, সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরিবার বাস করতেন। কিন্তু তাজউদ্দীন সেখানে থাকতেন না। আমাকে বলেছিলেন, ‘ভাই দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমার পরিবারের সঙ্গে এক বাসাতে থাকতে চাই না। কাজেরও সুবিধা হয়, সাংসারিক ঝামেলা আমি নিতে চাই না। তার গায়ে একটি শার্টই প্রায় দেখতাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, ‘শার্ট বদলান না কেন?’ বললেন ওটাও হাঙ্গামা হবে। ‘এই শার্টটি ময়লা কম হয়, গোসল করার সময় মাঝে মাঝে ধুয়ে নিই।’
-দ্যাট ওয়াজ তাজউদ্দীন।
বঙ্গবন্ধু যখন ৭৪ সালে পাকিস্থান সফর করেন তখন তাজউদ্দীন সেই সফরের বিরোধিতা করে বলেন -“ভুট্টোর সঙ্গে যেচে মাখামাখি করার ফলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে যে অমীমাংসিত বিরোধ রয়েছে তার সমাধান বিলম্বিত হবে, এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আবার সক্রিয় হবার সাহস পাবে”।
বঙ্গবন্ধু যদিও তাঁর খুব কাছের মানুষ তাজউদ্দীনের সেই মতামত কে আগ্রাহ্য করে ইসলামী দেশগুলোর ডাকা লাহোরের সম্মেলনে যোগ দেন, বঙ্গবন্ধুর সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে ক্রমাগত, পরবর্তীতে ৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর জাতীয় স্বার্থে আবার বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গীকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন।
অথচ, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অন্যতম ঘাতক বজলুল হুদা তাজউদ্দীন কে ব্যবহার করতে এসেছিল, তাজউদ্দীন তাঁর স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন –“শেখ মুজিবের রক্তের উপর দিয়ে হেঁটে আমি প্রধানমন্ত্রি-প্রেসিডেন্ট হতে চাইনা”।
সমগ্র জাতিকে নিজ চেতনায় ধারণ করেছিলেন বলেই তার পক্ষে সম্ভব হয় শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা।
আজ আমাদের সেই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুবার্ষিকী। নাহ, তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেননি তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছিল ইতিহাসের জঘন্যতম ভাবে, নৃশংসভাবে। ৭৫ এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু খুন হবার পর প্রথমে গৃহবন্ধী, পরে সামরিক আইনে ২২ আগস্ট গ্রেফতার করে ৩রা নভেম্বর জেলেই খুন করে সেই ঘাতকেরা। তারা জানতো তাজউদ্দীন বেঁচে থাকলে আরেক বঙ্গবন্ধু রয়ে যাবে বাংলাদেশে।
আরাফাত তানিম
শিক্ষার উদ্দেশ্য বই পড়া কিংবা ডিগ্রি অর্জন নয়
যদিও জানেন তবু মানেন কিনা দেখে নিনঃ
১।কারও বিপদে হাসবেন না! আপনি জানেন না, একটু পর আপনার জন্য কী অপেক্ষা করছে। সুতরাং নিজের ভালোর জন্য হলেও পরের ব্যাপারে সদয় হোন।
২। অহংকার করেন? মনে রাখা ভালো, গাছের উঁচু শাখাটির উপরও বিস্তীর্ণ আকাশের অবস্থান। আবার সেই নীল আকাশও ঢাকা পড়ে বিশাল কালো মেঘে! কাউকেই ছোট করার অধিকার আপনাকে দেওয়া হয়নি, সুতরাং বড়াই করার অভ্যাস থাকলে আজই ত্যাগ করুন।
৩।এটা-সেটা হাজার কিছু করে বেড়ান? ভাবছেন সাহস আছে- তাই ছাড়া পেয়ে যায়? কিংবা ভাবেন, আমি তো মুক্ত পাখি। আমাকে রুখবে সে সাধ্য কার? মনে রাখা ভালো, সাগরে বিশাল আকৃতির যে মাছটি ভরপেটে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে-- সেই মাছটিও মুক্ত অবস্থায় থাকে। কিন্তু একসময় জালে ধরা পড়ে তার জীবনেরও অবসান হয়! আজ আপনি মুক্ত, ভাবুন না কাল কী হতে পারে?
৪।অবহেলা করেন যে কোনও কিছুকে? বলেন নাকি এমন-“একটুতেই উতলা হবার প্রয়োজন নেই”?
জেনে রাখুন- বিপদের সূত্রপাত হয় ছোট ছোট সব অবহেলা থেকেই। এ ক্ষেত্রেও উপরের সূত্রটি কার্যকর- “আজ না হয় কিছু হয়নি, জানেন না কাল কী হতে চলেছে”!
৫।সফল হতে চাই! নিশ্চয় বালিশের উপর মাথা দিয়ে এমনটা ভেবে থাকেন?
বালিশটা সরিয়ে রেখে কাজে নেমে পড়ুন। বালিশে মাথা রেখে ভালো ঘুম হয়, কিন্তু বাস্তব কোনও স্বপ্নপূরণের স্থান ঐ বালিশ নয়!
বাস্তববাদী হতে শিখুন! শিক্ষার উদ্দেশ্য বই পড়া কিংবা ডিগ্রি অর্জন নয়, বরং আপনাকে রক্ষা করা, আপনাকে এগিয়ে নেওয়া। নীতি বাক্যগুলোকে স্রেফ বইয়ের কথা বলে ফেলে রাখবেন না। সেগুলিকে কাজে রূপান্তর করুন- দেখবেন জীবনটাই বদলে গেছে!
১।কারও বিপদে হাসবেন না! আপনি জানেন না, একটু পর আপনার জন্য কী অপেক্ষা করছে। সুতরাং নিজের ভালোর জন্য হলেও পরের ব্যাপারে সদয় হোন।
২। অহংকার করেন? মনে রাখা ভালো, গাছের উঁচু শাখাটির উপরও বিস্তীর্ণ আকাশের অবস্থান। আবার সেই নীল আকাশও ঢাকা পড়ে বিশাল কালো মেঘে! কাউকেই ছোট করার অধিকার আপনাকে দেওয়া হয়নি, সুতরাং বড়াই করার অভ্যাস থাকলে আজই ত্যাগ করুন।
৩।এটা-সেটা হাজার কিছু করে বেড়ান? ভাবছেন সাহস আছে- তাই ছাড়া পেয়ে যায়? কিংবা ভাবেন, আমি তো মুক্ত পাখি। আমাকে রুখবে সে সাধ্য কার? মনে রাখা ভালো, সাগরে বিশাল আকৃতির যে মাছটি ভরপেটে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে-- সেই মাছটিও মুক্ত অবস্থায় থাকে। কিন্তু একসময় জালে ধরা পড়ে তার জীবনেরও অবসান হয়! আজ আপনি মুক্ত, ভাবুন না কাল কী হতে পারে?
৪।অবহেলা করেন যে কোনও কিছুকে? বলেন নাকি এমন-“একটুতেই উতলা হবার প্রয়োজন নেই”?
জেনে রাখুন- বিপদের সূত্রপাত হয় ছোট ছোট সব অবহেলা থেকেই। এ ক্ষেত্রেও উপরের সূত্রটি কার্যকর- “আজ না হয় কিছু হয়নি, জানেন না কাল কী হতে চলেছে”!
৫।সফল হতে চাই! নিশ্চয় বালিশের উপর মাথা দিয়ে এমনটা ভেবে থাকেন?
বালিশটা সরিয়ে রেখে কাজে নেমে পড়ুন। বালিশে মাথা রেখে ভালো ঘুম হয়, কিন্তু বাস্তব কোনও স্বপ্নপূরণের স্থান ঐ বালিশ নয়!
বাস্তববাদী হতে শিখুন! শিক্ষার উদ্দেশ্য বই পড়া কিংবা ডিগ্রি অর্জন নয়, বরং আপনাকে রক্ষা করা, আপনাকে এগিয়ে নেওয়া। নীতি বাক্যগুলোকে স্রেফ বইয়ের কথা বলে ফেলে রাখবেন না। সেগুলিকে কাজে রূপান্তর করুন- দেখবেন জীবনটাই বদলে গেছে!
শিক্ষা সংস্কার - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
যাঁহারা খবরের কাগজ পড়েন তাঁহারা জানেন, ইংলণ্ডে ফ্রান্সে শিক্ষা সম্বন্ধে খুব একটা গোলমাল চলিতেছে। শিক্ষা লইয়া আমরাও নিশ্চিন্ত নাই, তাহাও কাহারো অবিদিত নাই।
এক সময়ে "স্পীকার' নামক বিখ্যাত ইংরেজি সাপ্তাহিক-পত্রে আইরিশ শিক্ষা-সংস্কার সম্বন্ধে যে প্রস্তাব আলোচিত হইয়াছে, তাহা আমাদের মনোযোগপূর্বক চিন্তা করিয়া দেখিবার বিষয়।
য়ুরোপের যে-যুগকে অন্ধকার যুগ বলে, যখন বর্বর আক্রমণের ঝড়ে রোমের বাতি নিবিয়া গেল, সেই সময়ে যুরোপের সকল দেশের মধ্যে কেবলমাত্র আয়রলণ্ডেই বিদ্যার চর্চা জাগিয়াছিল। তখন য়ুরোপের ছাত্রগণ আয়রলণ্ডের বিদ্যালয়ে আসিয়া পড়াশুনা করিত। সপ্তম শতাব্দীতে যখন বহুতর বিদ্যার্থী এখানে আসিয়া জুটিয়াছিল, তখন তাহারা আহার বাসা পুঁথি এবং শিক্ষা বিনামূল্যেই পাইত। কতকটা আমাদের দেশের টোলের মতো আর কি।
য়ুরোপের অধিকাংশ দেশেই আইরিশ বৈরাগিগণ বিদ্যা এবং খৃস্টধর্মের নির্বাণপ্রায় শিখা আবার উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছেন। ফ্রান্সের রাজা শার্লমান অষ্টম শতাব্দীতে পারিস-য়ুনিভরসিটির প্রতিষ্ঠাভার বিখ্যাত আইরিশ পণ্ডিত ক্লেমেন্সের হাতে দিয়াছিলেন। এরূপ আরো অনেক দৃষ্টান্ত আছে।
প্রাচীন আইরিশ বিদ্যালয়ে যদিচ লাটিন, গ্রীক এবং হিব্রু শেখানো হইত, তবু সেখানে শিখাইবার ভাষা ছিল আইরিশ। গণিতজ্যোতিষ, ফলিতজ্যোতিষ এবং তখনকার কালে যে-সকল বিজ্ঞান প্রচলিত ছিল তাহা আইরিশ ভাষা দ্বারাই শেখানো হইত, সুতরাং এ ভাষার পারিভাষিক শব্দের দৈন্য ছিল না।
যখন দিনেমার এবং ইংরেজরা আয়রলণ্ড আক্রমণ করে, তখন এই-সকল বিদ্যালয়ে আগুন লাগাইয়া বিপুলসঞ্চিত পুঁথিপত্র জ্বালাইয়া দেওয়া হয় এবং অধ্যাপক ও ছাত্রগণ হত ও বিক্ষিপ্ত হইতে থাকে। কিন্তু আয়রলণ্ডের যে যে স্থান এই-সকল উৎপাত হইতে দূরে থাকিয়া ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত দেশীয় রাজাদের অধীন ছিল, সে-সকল স্থানের বড়ো বড়ো বিদ্যাগারে শিক্ষাকার্য সম্পূর্ণ আইরিশ প্রণালীতেই নির্বাহিত হইত। অবশেষে এলিজাবেথের কালে লড়াই হইয়া যখন সমস্ত সম্পত্তি অপহৃত হইল, তখন আয়রলণ্ডের স্বায়ত্তবিদ্যা ও বিদ্যালয় একেবারে নষ্ট করিয়া দেওয়া হইল।
এইরূপে আয়রলণ্ডবাসীরা জ্ঞানচর্চা হইতে বঞ্চিত হইয়া রহিল, তাহাদের ভাষা নিকৃষ্টসমাজের ভাষা বলিয়া অবজ্ঞা প্রাপ্ত হইতে থাকিল। অবশেষে ঊনবিংশ শতাব্দীতে "ন্যাশনাল ইস্কুল' প্রণালীর সূত্রপাত হইল। জ্ঞানপিপাসু আইরিশগণ এই প্রণালীর দোষগুলি বিচারমাত্র না করিয়া ব্যগ্রভাবে ইহাকে অভ্যর্থনা করিয়া লইল। কেবল একজন বড়োলোক-- টুয়ামের আর্চবিশপ জন ম্যাকহেল-- এই প্রণালীর বিরুদ্ধে আপত্তি প্রকাশ করেন এবং ইহার দ্বারা ভবিষ্যতে যে অমঙ্গল হইবে তাহা ব্যক্ত করেন।
আইরিশদিগকে জোর করিয়া স্যাকসনের ছাঁচে ঢালা এবং ইংরেজ করিয়া তোলাই ন্যাশনাল ইস্কুল-প্রণালীর মতলব ছিল। ফলে এই চেষ্টার ব্যর্থতা প্রমাণ হইল। ভালোই বলো আর মন্দই বলো, প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন জাতিকে এমন ভিন্ন রকম করিয়া গড়িয়াছেন যে, এক জাতকে ভিন্ন জাতের কাঠামোর মধ্যে পুরিতে গেলে সমস্ত খাপছাড়া হইয়া যায়।
যে-সময়ে এই শিক্ষাপ্রণালীর প্রবর্তন করা হয়, তখন আয়রলণ্ডের শতকরা আশিজন লোক আইরিশ ভাষায় কথা কহিত। যদি শিক্ষা দেওয়াই ন্যাশনাল বোর্ডের উদ্দেশ্য হইত, তবে আইরিশ ছাত্রদিগকে আগে নিজের ভাষায় পড়িতে শুনিতে শিখাইয়া তাহার পরে সেই মাতৃভাষার সাহায্যে তাহাদিগকে বিদেশী ভাষা শিক্ষা দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তাহা না করিয়া নানাপ্রকার কঠিন শাস্তিদ্বারা বালকদিগকে তাহাদের মাতৃভাষা ব্যবহার করিতে একেবারে নিরস্ত করিয়া দেওয়া হইল।
শুধু ভাষা নয়, আইরিশ ইতিহাস পড়ানো বন্ধ হইল; আইরিশ ভূবৃত্তান্তও ভালো করিয়া শেখানো হইত না। ছেলেরা বিদেশের ইতিহাস ও ভূবৃত্তান্ত শিখিয়া নিজের দেশের সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকিত।
ইহার ফল যেমন হওয়া উচিত, তাহাই হইল। মানসিক জড়তা সমস্ত দেশে ব্যাপ্ত হইয়া গেল। আইরিশ-ভাষী ছেলেরা বুদ্ধি এবং জিজ্ঞাসা লইয়া বিদ্যালয়ে প্রবেশ করিল আর বাহির হইল পঙ্গু মন এবং জ্ঞানের প্রতি বিতৃষ্ণা লইয়া।
ইহার কারণ, এ শিক্ষাপ্রণালী কলের প্রণালী, ইহাতে মন খাটে না, ছেলেরা তোতাপাখি বনিয়া যায়।
এই প্রাথমিক শিক্ষার পর মাধ্যমিক শিক্ষা (Intermediate Education)। আটাশ বৎসর ধরিয়া আয়রলণ্ডে সেই মাধ্যমিক শিক্ষার পরখ করা হইয়াছে। তাহার ফলস্বরূপ বিদ্যাশিক্ষা সেখানে একেবারে দলিত হইয়া গেল। পরীক্ষাফলের প্রতি অতিমাত্র লোভ করিয়া করিয়া কলেজে শেখাইবার চেষ্টা হয় না, কেবল গেলাইবার আয়োজন হয়। ইহাতে হাজার হাজার আইরিশ ছাত্রের স্বাস্থ্য নষ্ট হয় এবং বুদ্ধি বন্ধ্যা হইয়া যাইতেছে। অতিশ্রমের দ্বারা অকালে তাহাদের মন জীর্ণ হইয়া যায় এবং বিদ্যার প্রতি তাহাদের অনুরাগ থাকে না।
এই বিদ্যাবিভ্রাটের প্রতিকারস্বরূপ আইরিশ জাতি কি প্রার্থনা করিতেছে। তাহারা বিপ্লব বাধাইতে চায় না, দেশের বিদ্যাশিক্ষার ভার তাহারা নিজের হাতে চালাইতে চায়। ব্যয়ের জন্যও কর্তৃপক্ষকে বেশি ভাবিতে হইবে না। শিক্ষাব্যয়ের জন্য আয়রলণ্ডের যে বরাদ্দ নির্দিষ্ট হইতেছে, তাহা অতি যৎসামান্য। ইংলণ্ডে পুলিস এবং আদালতে যে খরচ হয় তাহার প্রত্যেক পাউণ্ডের হারে বিদ্যাশিক্ষায় আট পাউণ্ড খরচ হইয়া থাকে। আর আয়রলণ্ডে যেখানে অপরাধের সংখ্যা তুলনায় অত্যন্ত কম, সেখানে প্রত্যেক পুলিস ও আদালতের বরাদ্দের প্রত্যেক পাউণ্ডের অনুপাতে বিদ্যাশিক্ষায় তেরো শিলিং চার পেন্স মাত্র ব্যয় ধরা হইয়াছে।
ঠিক একটা দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সকল অংশে তুলনা হইতেই পারে না। আয়রলণ্ডের শিক্ষারীতি যে-ভাবে চলিয়াছিল, ভারতবর্ষেও যে ঠিক সেই ভাবেই চলিয়াছে তাহা বলা যায় না, কিন্তু আয়রলণ্ডের শিক্ষাসংকটের কথা আলোচনা করিয়া দেখিলে একটা গভীর জায়গায় আমাদের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।
বিদ্যাশিক্ষায় আমাদেরও মন খাটিতেছে না-- আমাদেরও শিক্ষাপ্রণালীতে কলের অংশ বেশি। যে-ভাষায় আমাদের শিক্ষা সমাধা হয়, সে-ভাষায় প্রবেশ করিতে আমাদের অনেক দিন লাগে। ততদিন পর্যন্ত কেবল দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া হাতুড়ি পেটা এবং কুলুপ-খোলার তত্ত্ব অভ্যাস করিতেই প্রাণান্ত হইতে হয়। আমাদের মন তেরো-চোদ্দো বছর বয়স হইতেই জ্ঞানের আলোক এবং ভাবের রস গ্রহণ করিবার জন্য ফুটিবার উপক্রম করিতে থাকে, সেই সময়েই অহরহ যদি তাহার উপর বিদেশী ভাষার ব্যাকরণ এবং মুখস্থবিদ্যার শিলাবৃষ্টিবর্ষণ হইতে থাকে, তবে তাহা পুষ্টিলাভ করিবে কী করিয়া। প্রায় বছর কুড়ি বয়স পর্যন্ত মারামারির পর ইংরেজি ভাষায় আমাদের স্বাধীন অধিকার জন্মে, কিন্তু ততদিন আমাদের মন কী খোরাকে বাঁচিয়াছে। আমরা কী ভাবিতে পাইয়াছি, আমাদের হৃদয় কী রস আকর্ষণ করিয়াছে, আমাদের কল্পনাবৃত্তি সৃষ্টিকার্য চর্চার জন্য কী উপকরণ লাভ করিয়াছে। যাহা গ্রহণ করি, তাহা সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ করিতে থাকিলে তবেই ধারণাটা পাকা হয়। পরের ভাষায় গ্রহণ করাও শক্ত প্রকাশ করাও কঠিন। এইরূপে রচনা করিবার চর্চা না থাকাতে যাহা শিখি তাহাতে আমাদের অধিকার দৃঢ় হইতেই পারে না। ঔনঁ মুখস্থ করিয়া শেখা এবং লেখা, দুয়ের কাজ চালাইয়া দিতে হয়। যে-বয়সে মন অনেকটা পরিমাণে পাকিয়া যায়, সে-বয়সের লাভ পুরালাভ নহে। যে-কাঁচাবয়সে মন অজ্ঞাতসারে আপনার খাদ্য শোষণ করিতে পারে, তখনই সে জ্ঞান ও ভাবকে আপনার রক্তমাংসের সহিত পূর্ণভাবে মিশাইয়া নিজেকে সজীব সবল সক্ষম করিয়া তোলে। সেই সময়টাই আমাদের মাঠে মারা যায়। সে-মাঠ শস্যশূন্য অনুর্বর নীরস মাঠ। সেই মাঠে আমাদের বুদ্ধি ও স্বাস্থ্য কত যে মরিয়াছে তাহার হিসাব কে রাখে।
এইরূপ শিক্ষাপ্রণালীতে আমাদের মন যে অপরিণত থাকিয়া যায়, বুদ্ধি যে সম্পূর্ণ স্ফূর্তি পায় না, সে কথা আমাদিগকে স্বীকার করিতে হইবে। আমাদের পাণ্ডিত্য অল্প কিছু দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়, আমাদের উদ্ভাবনশক্তি শেষ পর্যন্ত পৌঁছে না, আমাদের ধারণাশক্তির বলিষ্ঠতা নাই। আমাদের ভাবাচিন্তা আমাদের লেখাপড়ার মধ্যে সেই ছাত্র-অবস্থার ক্ষীণতাই বরাবর থাকিয়া যায়; আমরা নকল করি, নজির খুঁজি, এবং স্বাধীন মত বলিয়া যাহা প্রচার করি, তাহা হয় কোনো-না কোনো মুখস্থ বিদ্যার প্রতিধ্বনি, নয় একটা ছেলেমানুষি ব্যাপার। হয় মানসিক ভীরুতাবশত আমরা পদচিহ্ন মিলাইয়া চলি, নয় অজ্ঞতার স্পর্ধাবশত বেড়া ডিঙাইয়া চলিতে থাকি। কিন্তু আমাদের বুদ্ধির যে স্বাভাবিক খর্বতা আছে, এ কথা কোনো মতেই স্বীকার্য নহে। আমাদের শিক্ষাপ্রণালীর ত্রুটি সত্ত্বেও আমরা অল্প সময়ের মধ্যে যতটা মাথা তুলিতে পারিয়াছি, সে আমাদের নিজের গুণে।
আর একটি কথা। শিক্ষা দিবার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গে যদি আর-কোনো অবান্তর উদ্দেশ্য ভিতরে ভিতরে থাকিয়া যায় তবে তাহাতে বিকার জন্মায়। আইরিশকে স্যাকসন করিবার চেষ্টায় তাহার শিক্ষাকেই মাটি করা হইয়াছে। কর্তৃপক্ষ আজকাল আমাদের শিক্ষার মধ্যে পোলিটিক্যাল মতলবকে সাঁধ করাইবার চেষ্টা করিতেছেন, তাহা বুঝা কঠিন নহে। সেইজন্য তাঁহারা শিক্ষাব্যাপারে দেশীয় লোকের স্বাধীনতা নানা দিক হইতে খর্ব করিতে উদ্যত হইয়াছেন। শিক্ষাকে তাঁহারা শাসনবিভাগের আপিসভুক্ত করিয়া লইতে চান। এখন হইতে অনভিজ্ঞ ডাইরেক্টরের পরীক্ষিত, অনভিজ্ঞ ম্যাকমিলান কোম্পানির রচিত, অতি সংকীর্ণ, অতি দরিদ্র এবং বিকৃত বাংলার পাঠ্যগ্রন্থ পড়িয়া বাঙালির ছেলেকে মানুষ হইতে হইবে এবং বিদ্যালয়ের বইগুলি এমন ভাবে প্রস্তুত ও নির্বাচিত হইবে যাহাতে নিরপেক্ষ উদার জ্ঞানচর্চা পোলিটিক্যাল প্রয়োজনসিদ্ধির কাছে খণ্ডিত হইয়া যায়।
শুধু তাই নয়। ডিসিপ্লিনের যন্ত্রটাতে যে-পরিমাণ পাক দিলে ছেলেরা সংযত হয়, তাহার চেয়ে পাক বাড়াইবার চেষ্টা দেখা যাইতেছে, ইহাতে তাহাদিগকে নিঃসত্ত্ব করা হইবে। ছেলেদের মধ্যে ছেলেমানুষের চাঞ্চল্য যে স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর তাহা স্বদেশের সম্বন্ধে ইংরেজ ভালোই বোঝে। তাহারা জানে, এই চাঞ্চল্যকে দমন না করিয়া যদি নিয়মিত করিয়া পুষ্ট করা যায়, তবে ইহাই একদিন চরিত্র এবং বুদ্ধির শক্তিরূপে সঞ্চিত হইবে। এই চাঞ্চল্যকে একেবারে দলিত করাই কাপুরুষতাসৃষ্টির প্রধান উপায়। ছেলেদের যাহারা যথার্থ হিতৈষী, তাহারা এই চাঞ্চল্যের মধ্যে প্রকৃতির শুভ উদ্দেশ্য স্বীকার করে, তাহারা ইহাকে উপদ্রব বলিয়া গণ্য করে না। এইজন্য বালোচিত চাপল্যের নানাবিধ উৎপাতকে বিজ্ঞলোকেরা সস্নেহে রক্ষা করেন। ইংলণ্ডে এই ক্ষমাগুণের চর্চা যথেষ্ট দেখা যায়-- এমন-কি, আমাদের কাছে তাহা অতিরিক্ত বলিয়া মনে হয়।
নিজে চিন্তা করিবে, নিজে সন্ধান করিবে, নিজে কাজ করিবে, এমনতরো মানুষ তৈরি করবার প্রণালী এক, আর পরের হুকুম মানিয়া চলিবে, পরের মতের প্রতিবাদ করিবে না, ও পরের কাজে জোগানদার হইয়া থাকিবে মাত্র, এমন মানুষ তৈরির বিধান অন্যরূপ। আমরা স্বভাবত স্বজাতিকে স্বাতন্ত্র্যের জন্য প্রস্তুত করিতে ইচ্ছা করিব, সে কথা বলাই বাহুল্য। ইংলণ্ডের যখন সুদিন ছিল, তখন ইংলণ্ডও কোনো জাতিসম্বন্ধেই এই আদর্শে বাধা দিত না-- ভারতবর্ষে শিক্ষানীতি সম্বন্ধে মেকলের মন্তব্য তাহার প্রমাণ। এখন কালের পরিবর্তন হইয়াছে; এইজন্যই শিক্ষার আদর্শ লইয়া কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে স্বদেশভক্তদের বিরোধ অবশ্যম্ভাবী হইয়া পড়িয়াছে। আমরা বিদ্যালয়ের সাহায্যে এ দেশে তাঁবেদারির চিরস্থায়ী ভিত্তি পত্তন করিতে কিছুতেই রাজি হইতে পারি না। কাজেই, সময় উপস্থিত হইয়াছে, এখন বিদ্যাশিক্ষাকে যেমন করিয়া হউক নিজের হাতে গ্রহণ করিতেই হইবে।
গবর্মেন্ট-প্রতিষ্ঠিত সেনেটে সিণ্ডিকেটে বাঙালি থাকিলেই যে বিদ্যাশিক্ষার ভার আমাদের নিজের হাতে রহিল, তাহা আমি মনে করি না। গবর্মেণ্টের আমাদের কাছে জবাবদিহি না থাকিয়া দেশের লোকের কাছে জবাবদিহি থাকা চাই। আমরা গবর্মেণ্টের সম্মতির অধীনে যখন বাহ্যস্বাতন্ত্র্যের একটা বিড়ম্বনা লাভ করি, তখনই আমাদের বিপদ সব চেয়ে বেশি। তখন প্রসাদলব্ধ সেই মিথ্যা স্বাতন্ত্র্যের মূল্য যাহা দিতে হয়, তাহাতে মাথা বিকাইয়া যায়। বিশেষত দেশীলোককে দিয়াই দেশের মঙ্গল দলন করা গবর্মেণ্টের পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন নহে, নইলে এ দেশের দুর্গতি কিসের। অতএব, চাকরির অধিকার নহে, মনুষত্বের অধিকারের যোগ্য হইবার প্রতি যদি লক্ষ রাখি, তবে শিক্ষা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য-চেষ্টার দিন আসিয়াছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। দেশের লোককে শিশুকাল হইতে মানুষ করিবার সদুপায় যদি নিজে উদ্ভাবন এবং তাহার উদ্যোগ যদি নিজে না করি, তবে আমরা সর্বপ্রকারে বিনাশপ্রাপ্ত হইব-- অন্নে মরিব, স্বাস্থ্যে মরিব, বুদ্ধিতে মরিব, চরিত্রে মরিব-- ইহা নিশ্চয়। বস্তুত আমরা প্রত্যহই মরিতেছি অথচ তাহার প্রতিকারের উপযুক্ত চেষ্টামাত্র করিতেছি না,তাহার চিন্তামাত্র যথার্থরূপে আমাদের মনেও উদয় হইতেছে না, এই যে নিবিড় মোহাবৃত নিরুদ্যম ও চরিত্রবিকার-- বাল্যকাল হইতে প্রকৃত শিক্ষা ব্যতীত কোনো অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের দ্বারা ইহা নিবারণের কোনো উপায় নাই
বর্তমানকালে যে একটিমাত্র সাধক য়ুরোপে গুরুর আসনে বসিয়া নিরন্তর অরণ্যে রোদন করিয়া মরিতেছেন সেই টল্স্টয় রুশিয়ার শিক্ষানীতি সম্বন্ধে যে-কথা বলিয়াছেন তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করি।
It seems to me that it is now specially important to do what is right quietly and persistently, not only without asking permission from Government, but consciously avoiding its participation। The strength of the Government lies in the people's ignorance, and the Government knows this, and will therefore always oppose true enlightenment। It is time we realized that fact। And it is most undesirable to let the Government, while it is spreading darkness, pretend to be busy with the enlightenment of the people। It is doing this now by means of all sorts of pseudo educational establishment which it controls ; schools, high schools, universities, academies, and all kinds of committees and congresses। But good is good and enlightenment is enlightenment, only when it is quite good and quite enlightened and not when it is toned down to meet the requirements of Delyanof's or Dournovo's circulars। And I am extremely sorry when I see valuable, disinterested, and self-sacrificing efforts spent unprofitably। It is strange to see good, wise people spending their strength in a struggle against the Government, but carrying on this struggle on the basis of whatever laws the Government itself likes to make।
১৩১৩ বঙ্গাব্দ
এক সময়ে "স্পীকার' নামক বিখ্যাত ইংরেজি সাপ্তাহিক-পত্রে আইরিশ শিক্ষা-সংস্কার সম্বন্ধে যে প্রস্তাব আলোচিত হইয়াছে, তাহা আমাদের মনোযোগপূর্বক চিন্তা করিয়া দেখিবার বিষয়।
য়ুরোপের যে-যুগকে অন্ধকার যুগ বলে, যখন বর্বর আক্রমণের ঝড়ে রোমের বাতি নিবিয়া গেল, সেই সময়ে যুরোপের সকল দেশের মধ্যে কেবলমাত্র আয়রলণ্ডেই বিদ্যার চর্চা জাগিয়াছিল। তখন য়ুরোপের ছাত্রগণ আয়রলণ্ডের বিদ্যালয়ে আসিয়া পড়াশুনা করিত। সপ্তম শতাব্দীতে যখন বহুতর বিদ্যার্থী এখানে আসিয়া জুটিয়াছিল, তখন তাহারা আহার বাসা পুঁথি এবং শিক্ষা বিনামূল্যেই পাইত। কতকটা আমাদের দেশের টোলের মতো আর কি।
য়ুরোপের অধিকাংশ দেশেই আইরিশ বৈরাগিগণ বিদ্যা এবং খৃস্টধর্মের নির্বাণপ্রায় শিখা আবার উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছেন। ফ্রান্সের রাজা শার্লমান অষ্টম শতাব্দীতে পারিস-য়ুনিভরসিটির প্রতিষ্ঠাভার বিখ্যাত আইরিশ পণ্ডিত ক্লেমেন্সের হাতে দিয়াছিলেন। এরূপ আরো অনেক দৃষ্টান্ত আছে।
প্রাচীন আইরিশ বিদ্যালয়ে যদিচ লাটিন, গ্রীক এবং হিব্রু শেখানো হইত, তবু সেখানে শিখাইবার ভাষা ছিল আইরিশ। গণিতজ্যোতিষ, ফলিতজ্যোতিষ এবং তখনকার কালে যে-সকল বিজ্ঞান প্রচলিত ছিল তাহা আইরিশ ভাষা দ্বারাই শেখানো হইত, সুতরাং এ ভাষার পারিভাষিক শব্দের দৈন্য ছিল না।
যখন দিনেমার এবং ইংরেজরা আয়রলণ্ড আক্রমণ করে, তখন এই-সকল বিদ্যালয়ে আগুন লাগাইয়া বিপুলসঞ্চিত পুঁথিপত্র জ্বালাইয়া দেওয়া হয় এবং অধ্যাপক ও ছাত্রগণ হত ও বিক্ষিপ্ত হইতে থাকে। কিন্তু আয়রলণ্ডের যে যে স্থান এই-সকল উৎপাত হইতে দূরে থাকিয়া ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত দেশীয় রাজাদের অধীন ছিল, সে-সকল স্থানের বড়ো বড়ো বিদ্যাগারে শিক্ষাকার্য সম্পূর্ণ আইরিশ প্রণালীতেই নির্বাহিত হইত। অবশেষে এলিজাবেথের কালে লড়াই হইয়া যখন সমস্ত সম্পত্তি অপহৃত হইল, তখন আয়রলণ্ডের স্বায়ত্তবিদ্যা ও বিদ্যালয় একেবারে নষ্ট করিয়া দেওয়া হইল।
এইরূপে আয়রলণ্ডবাসীরা জ্ঞানচর্চা হইতে বঞ্চিত হইয়া রহিল, তাহাদের ভাষা নিকৃষ্টসমাজের ভাষা বলিয়া অবজ্ঞা প্রাপ্ত হইতে থাকিল। অবশেষে ঊনবিংশ শতাব্দীতে "ন্যাশনাল ইস্কুল' প্রণালীর সূত্রপাত হইল। জ্ঞানপিপাসু আইরিশগণ এই প্রণালীর দোষগুলি বিচারমাত্র না করিয়া ব্যগ্রভাবে ইহাকে অভ্যর্থনা করিয়া লইল। কেবল একজন বড়োলোক-- টুয়ামের আর্চবিশপ জন ম্যাকহেল-- এই প্রণালীর বিরুদ্ধে আপত্তি প্রকাশ করেন এবং ইহার দ্বারা ভবিষ্যতে যে অমঙ্গল হইবে তাহা ব্যক্ত করেন।
আইরিশদিগকে জোর করিয়া স্যাকসনের ছাঁচে ঢালা এবং ইংরেজ করিয়া তোলাই ন্যাশনাল ইস্কুল-প্রণালীর মতলব ছিল। ফলে এই চেষ্টার ব্যর্থতা প্রমাণ হইল। ভালোই বলো আর মন্দই বলো, প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন জাতিকে এমন ভিন্ন রকম করিয়া গড়িয়াছেন যে, এক জাতকে ভিন্ন জাতের কাঠামোর মধ্যে পুরিতে গেলে সমস্ত খাপছাড়া হইয়া যায়।
যে-সময়ে এই শিক্ষাপ্রণালীর প্রবর্তন করা হয়, তখন আয়রলণ্ডের শতকরা আশিজন লোক আইরিশ ভাষায় কথা কহিত। যদি শিক্ষা দেওয়াই ন্যাশনাল বোর্ডের উদ্দেশ্য হইত, তবে আইরিশ ছাত্রদিগকে আগে নিজের ভাষায় পড়িতে শুনিতে শিখাইয়া তাহার পরে সেই মাতৃভাষার সাহায্যে তাহাদিগকে বিদেশী ভাষা শিক্ষা দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তাহা না করিয়া নানাপ্রকার কঠিন শাস্তিদ্বারা বালকদিগকে তাহাদের মাতৃভাষা ব্যবহার করিতে একেবারে নিরস্ত করিয়া দেওয়া হইল।
শুধু ভাষা নয়, আইরিশ ইতিহাস পড়ানো বন্ধ হইল; আইরিশ ভূবৃত্তান্তও ভালো করিয়া শেখানো হইত না। ছেলেরা বিদেশের ইতিহাস ও ভূবৃত্তান্ত শিখিয়া নিজের দেশের সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকিত।
ইহার ফল যেমন হওয়া উচিত, তাহাই হইল। মানসিক জড়তা সমস্ত দেশে ব্যাপ্ত হইয়া গেল। আইরিশ-ভাষী ছেলেরা বুদ্ধি এবং জিজ্ঞাসা লইয়া বিদ্যালয়ে প্রবেশ করিল আর বাহির হইল পঙ্গু মন এবং জ্ঞানের প্রতি বিতৃষ্ণা লইয়া।
ইহার কারণ, এ শিক্ষাপ্রণালী কলের প্রণালী, ইহাতে মন খাটে না, ছেলেরা তোতাপাখি বনিয়া যায়।
এই প্রাথমিক শিক্ষার পর মাধ্যমিক শিক্ষা (Intermediate Education)। আটাশ বৎসর ধরিয়া আয়রলণ্ডে সেই মাধ্যমিক শিক্ষার পরখ করা হইয়াছে। তাহার ফলস্বরূপ বিদ্যাশিক্ষা সেখানে একেবারে দলিত হইয়া গেল। পরীক্ষাফলের প্রতি অতিমাত্র লোভ করিয়া করিয়া কলেজে শেখাইবার চেষ্টা হয় না, কেবল গেলাইবার আয়োজন হয়। ইহাতে হাজার হাজার আইরিশ ছাত্রের স্বাস্থ্য নষ্ট হয় এবং বুদ্ধি বন্ধ্যা হইয়া যাইতেছে। অতিশ্রমের দ্বারা অকালে তাহাদের মন জীর্ণ হইয়া যায় এবং বিদ্যার প্রতি তাহাদের অনুরাগ থাকে না।
এই বিদ্যাবিভ্রাটের প্রতিকারস্বরূপ আইরিশ জাতি কি প্রার্থনা করিতেছে। তাহারা বিপ্লব বাধাইতে চায় না, দেশের বিদ্যাশিক্ষার ভার তাহারা নিজের হাতে চালাইতে চায়। ব্যয়ের জন্যও কর্তৃপক্ষকে বেশি ভাবিতে হইবে না। শিক্ষাব্যয়ের জন্য আয়রলণ্ডের যে বরাদ্দ নির্দিষ্ট হইতেছে, তাহা অতি যৎসামান্য। ইংলণ্ডে পুলিস এবং আদালতে যে খরচ হয় তাহার প্রত্যেক পাউণ্ডের হারে বিদ্যাশিক্ষায় আট পাউণ্ড খরচ হইয়া থাকে। আর আয়রলণ্ডে যেখানে অপরাধের সংখ্যা তুলনায় অত্যন্ত কম, সেখানে প্রত্যেক পুলিস ও আদালতের বরাদ্দের প্রত্যেক পাউণ্ডের অনুপাতে বিদ্যাশিক্ষায় তেরো শিলিং চার পেন্স মাত্র ব্যয় ধরা হইয়াছে।
ঠিক একটা দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সকল অংশে তুলনা হইতেই পারে না। আয়রলণ্ডের শিক্ষারীতি যে-ভাবে চলিয়াছিল, ভারতবর্ষেও যে ঠিক সেই ভাবেই চলিয়াছে তাহা বলা যায় না, কিন্তু আয়রলণ্ডের শিক্ষাসংকটের কথা আলোচনা করিয়া দেখিলে একটা গভীর জায়গায় আমাদের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।
বিদ্যাশিক্ষায় আমাদেরও মন খাটিতেছে না-- আমাদেরও শিক্ষাপ্রণালীতে কলের অংশ বেশি। যে-ভাষায় আমাদের শিক্ষা সমাধা হয়, সে-ভাষায় প্রবেশ করিতে আমাদের অনেক দিন লাগে। ততদিন পর্যন্ত কেবল দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া হাতুড়ি পেটা এবং কুলুপ-খোলার তত্ত্ব অভ্যাস করিতেই প্রাণান্ত হইতে হয়। আমাদের মন তেরো-চোদ্দো বছর বয়স হইতেই জ্ঞানের আলোক এবং ভাবের রস গ্রহণ করিবার জন্য ফুটিবার উপক্রম করিতে থাকে, সেই সময়েই অহরহ যদি তাহার উপর বিদেশী ভাষার ব্যাকরণ এবং মুখস্থবিদ্যার শিলাবৃষ্টিবর্ষণ হইতে থাকে, তবে তাহা পুষ্টিলাভ করিবে কী করিয়া। প্রায় বছর কুড়ি বয়স পর্যন্ত মারামারির পর ইংরেজি ভাষায় আমাদের স্বাধীন অধিকার জন্মে, কিন্তু ততদিন আমাদের মন কী খোরাকে বাঁচিয়াছে। আমরা কী ভাবিতে পাইয়াছি, আমাদের হৃদয় কী রস আকর্ষণ করিয়াছে, আমাদের কল্পনাবৃত্তি সৃষ্টিকার্য চর্চার জন্য কী উপকরণ লাভ করিয়াছে। যাহা গ্রহণ করি, তাহা সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ করিতে থাকিলে তবেই ধারণাটা পাকা হয়। পরের ভাষায় গ্রহণ করাও শক্ত প্রকাশ করাও কঠিন। এইরূপে রচনা করিবার চর্চা না থাকাতে যাহা শিখি তাহাতে আমাদের অধিকার দৃঢ় হইতেই পারে না। ঔনঁ মুখস্থ করিয়া শেখা এবং লেখা, দুয়ের কাজ চালাইয়া দিতে হয়। যে-বয়সে মন অনেকটা পরিমাণে পাকিয়া যায়, সে-বয়সের লাভ পুরালাভ নহে। যে-কাঁচাবয়সে মন অজ্ঞাতসারে আপনার খাদ্য শোষণ করিতে পারে, তখনই সে জ্ঞান ও ভাবকে আপনার রক্তমাংসের সহিত পূর্ণভাবে মিশাইয়া নিজেকে সজীব সবল সক্ষম করিয়া তোলে। সেই সময়টাই আমাদের মাঠে মারা যায়। সে-মাঠ শস্যশূন্য অনুর্বর নীরস মাঠ। সেই মাঠে আমাদের বুদ্ধি ও স্বাস্থ্য কত যে মরিয়াছে তাহার হিসাব কে রাখে।
এইরূপ শিক্ষাপ্রণালীতে আমাদের মন যে অপরিণত থাকিয়া যায়, বুদ্ধি যে সম্পূর্ণ স্ফূর্তি পায় না, সে কথা আমাদিগকে স্বীকার করিতে হইবে। আমাদের পাণ্ডিত্য অল্প কিছু দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়, আমাদের উদ্ভাবনশক্তি শেষ পর্যন্ত পৌঁছে না, আমাদের ধারণাশক্তির বলিষ্ঠতা নাই। আমাদের ভাবাচিন্তা আমাদের লেখাপড়ার মধ্যে সেই ছাত্র-অবস্থার ক্ষীণতাই বরাবর থাকিয়া যায়; আমরা নকল করি, নজির খুঁজি, এবং স্বাধীন মত বলিয়া যাহা প্রচার করি, তাহা হয় কোনো-না কোনো মুখস্থ বিদ্যার প্রতিধ্বনি, নয় একটা ছেলেমানুষি ব্যাপার। হয় মানসিক ভীরুতাবশত আমরা পদচিহ্ন মিলাইয়া চলি, নয় অজ্ঞতার স্পর্ধাবশত বেড়া ডিঙাইয়া চলিতে থাকি। কিন্তু আমাদের বুদ্ধির যে স্বাভাবিক খর্বতা আছে, এ কথা কোনো মতেই স্বীকার্য নহে। আমাদের শিক্ষাপ্রণালীর ত্রুটি সত্ত্বেও আমরা অল্প সময়ের মধ্যে যতটা মাথা তুলিতে পারিয়াছি, সে আমাদের নিজের গুণে।
আর একটি কথা। শিক্ষা দিবার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গে যদি আর-কোনো অবান্তর উদ্দেশ্য ভিতরে ভিতরে থাকিয়া যায় তবে তাহাতে বিকার জন্মায়। আইরিশকে স্যাকসন করিবার চেষ্টায় তাহার শিক্ষাকেই মাটি করা হইয়াছে। কর্তৃপক্ষ আজকাল আমাদের শিক্ষার মধ্যে পোলিটিক্যাল মতলবকে সাঁধ করাইবার চেষ্টা করিতেছেন, তাহা বুঝা কঠিন নহে। সেইজন্য তাঁহারা শিক্ষাব্যাপারে দেশীয় লোকের স্বাধীনতা নানা দিক হইতে খর্ব করিতে উদ্যত হইয়াছেন। শিক্ষাকে তাঁহারা শাসনবিভাগের আপিসভুক্ত করিয়া লইতে চান। এখন হইতে অনভিজ্ঞ ডাইরেক্টরের পরীক্ষিত, অনভিজ্ঞ ম্যাকমিলান কোম্পানির রচিত, অতি সংকীর্ণ, অতি দরিদ্র এবং বিকৃত বাংলার পাঠ্যগ্রন্থ পড়িয়া বাঙালির ছেলেকে মানুষ হইতে হইবে এবং বিদ্যালয়ের বইগুলি এমন ভাবে প্রস্তুত ও নির্বাচিত হইবে যাহাতে নিরপেক্ষ উদার জ্ঞানচর্চা পোলিটিক্যাল প্রয়োজনসিদ্ধির কাছে খণ্ডিত হইয়া যায়।
শুধু তাই নয়। ডিসিপ্লিনের যন্ত্রটাতে যে-পরিমাণ পাক দিলে ছেলেরা সংযত হয়, তাহার চেয়ে পাক বাড়াইবার চেষ্টা দেখা যাইতেছে, ইহাতে তাহাদিগকে নিঃসত্ত্ব করা হইবে। ছেলেদের মধ্যে ছেলেমানুষের চাঞ্চল্য যে স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর তাহা স্বদেশের সম্বন্ধে ইংরেজ ভালোই বোঝে। তাহারা জানে, এই চাঞ্চল্যকে দমন না করিয়া যদি নিয়মিত করিয়া পুষ্ট করা যায়, তবে ইহাই একদিন চরিত্র এবং বুদ্ধির শক্তিরূপে সঞ্চিত হইবে। এই চাঞ্চল্যকে একেবারে দলিত করাই কাপুরুষতাসৃষ্টির প্রধান উপায়। ছেলেদের যাহারা যথার্থ হিতৈষী, তাহারা এই চাঞ্চল্যের মধ্যে প্রকৃতির শুভ উদ্দেশ্য স্বীকার করে, তাহারা ইহাকে উপদ্রব বলিয়া গণ্য করে না। এইজন্য বালোচিত চাপল্যের নানাবিধ উৎপাতকে বিজ্ঞলোকেরা সস্নেহে রক্ষা করেন। ইংলণ্ডে এই ক্ষমাগুণের চর্চা যথেষ্ট দেখা যায়-- এমন-কি, আমাদের কাছে তাহা অতিরিক্ত বলিয়া মনে হয়।
নিজে চিন্তা করিবে, নিজে সন্ধান করিবে, নিজে কাজ করিবে, এমনতরো মানুষ তৈরি করবার প্রণালী এক, আর পরের হুকুম মানিয়া চলিবে, পরের মতের প্রতিবাদ করিবে না, ও পরের কাজে জোগানদার হইয়া থাকিবে মাত্র, এমন মানুষ তৈরির বিধান অন্যরূপ। আমরা স্বভাবত স্বজাতিকে স্বাতন্ত্র্যের জন্য প্রস্তুত করিতে ইচ্ছা করিব, সে কথা বলাই বাহুল্য। ইংলণ্ডের যখন সুদিন ছিল, তখন ইংলণ্ডও কোনো জাতিসম্বন্ধেই এই আদর্শে বাধা দিত না-- ভারতবর্ষে শিক্ষানীতি সম্বন্ধে মেকলের মন্তব্য তাহার প্রমাণ। এখন কালের পরিবর্তন হইয়াছে; এইজন্যই শিক্ষার আদর্শ লইয়া কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে স্বদেশভক্তদের বিরোধ অবশ্যম্ভাবী হইয়া পড়িয়াছে। আমরা বিদ্যালয়ের সাহায্যে এ দেশে তাঁবেদারির চিরস্থায়ী ভিত্তি পত্তন করিতে কিছুতেই রাজি হইতে পারি না। কাজেই, সময় উপস্থিত হইয়াছে, এখন বিদ্যাশিক্ষাকে যেমন করিয়া হউক নিজের হাতে গ্রহণ করিতেই হইবে।
গবর্মেন্ট-প্রতিষ্ঠিত সেনেটে সিণ্ডিকেটে বাঙালি থাকিলেই যে বিদ্যাশিক্ষার ভার আমাদের নিজের হাতে রহিল, তাহা আমি মনে করি না। গবর্মেণ্টের আমাদের কাছে জবাবদিহি না থাকিয়া দেশের লোকের কাছে জবাবদিহি থাকা চাই। আমরা গবর্মেণ্টের সম্মতির অধীনে যখন বাহ্যস্বাতন্ত্র্যের একটা বিড়ম্বনা লাভ করি, তখনই আমাদের বিপদ সব চেয়ে বেশি। তখন প্রসাদলব্ধ সেই মিথ্যা স্বাতন্ত্র্যের মূল্য যাহা দিতে হয়, তাহাতে মাথা বিকাইয়া যায়। বিশেষত দেশীলোককে দিয়াই দেশের মঙ্গল দলন করা গবর্মেণ্টের পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন নহে, নইলে এ দেশের দুর্গতি কিসের। অতএব, চাকরির অধিকার নহে, মনুষত্বের অধিকারের যোগ্য হইবার প্রতি যদি লক্ষ রাখি, তবে শিক্ষা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য-চেষ্টার দিন আসিয়াছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। দেশের লোককে শিশুকাল হইতে মানুষ করিবার সদুপায় যদি নিজে উদ্ভাবন এবং তাহার উদ্যোগ যদি নিজে না করি, তবে আমরা সর্বপ্রকারে বিনাশপ্রাপ্ত হইব-- অন্নে মরিব, স্বাস্থ্যে মরিব, বুদ্ধিতে মরিব, চরিত্রে মরিব-- ইহা নিশ্চয়। বস্তুত আমরা প্রত্যহই মরিতেছি অথচ তাহার প্রতিকারের উপযুক্ত চেষ্টামাত্র করিতেছি না,তাহার চিন্তামাত্র যথার্থরূপে আমাদের মনেও উদয় হইতেছে না, এই যে নিবিড় মোহাবৃত নিরুদ্যম ও চরিত্রবিকার-- বাল্যকাল হইতে প্রকৃত শিক্ষা ব্যতীত কোনো অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের দ্বারা ইহা নিবারণের কোনো উপায় নাই
বর্তমানকালে যে একটিমাত্র সাধক য়ুরোপে গুরুর আসনে বসিয়া নিরন্তর অরণ্যে রোদন করিয়া মরিতেছেন সেই টল্স্টয় রুশিয়ার শিক্ষানীতি সম্বন্ধে যে-কথা বলিয়াছেন তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করি।
It seems to me that it is now specially important to do what is right quietly and persistently, not only without asking permission from Government, but consciously avoiding its participation। The strength of the Government lies in the people's ignorance, and the Government knows this, and will therefore always oppose true enlightenment। It is time we realized that fact। And it is most undesirable to let the Government, while it is spreading darkness, pretend to be busy with the enlightenment of the people। It is doing this now by means of all sorts of pseudo educational establishment which it controls ; schools, high schools, universities, academies, and all kinds of committees and congresses। But good is good and enlightenment is enlightenment, only when it is quite good and quite enlightened and not when it is toned down to meet the requirements of Delyanof's or Dournovo's circulars। And I am extremely sorry when I see valuable, disinterested, and self-sacrificing efforts spent unprofitably। It is strange to see good, wise people spending their strength in a struggle against the Government, but carrying on this struggle on the basis of whatever laws the Government itself likes to make।
১৩১৩ বঙ্গাব্দ
এই হলাম আমরা
মাঝরাতে যখন আমার এলাকায় কারেন্ট এসেছে তখন পুরো এলাকা হৈ হৈ করে উঠেছে
রাজাবাজারে শুনলাম খুশিতে মাঝরাতেই আনন্দমিছিল বের হয়ে গিয়েছিল
বাড্ডায় ছেলেপেলে খুশিতে পটকা ফুটিয়েছে... গাজীপুরে এক উত্তেজিত বান্দা খুশিতে তারাবাতি জ্বালাতে যেয়ে তার লুঙ্গি জ্বালিয়ে ফেলেছে
সে এখন গাজীপুর সদর হাসপাতালে উপুত হয়ে হাসিহাসি মুখ করে শুয়ে আছে
পুরো দেশ ১০ ঘন্টা অন্ধকারে ছিলো... এই কাহিনী বাইরের যে কোনও দেশে ঘটলে, নিমিষেই দাঙ্গা লেগে যেত
আমেরিকার মতো দেশে এতক্ষণ কারেন্ট না থাকলে তো দোকানের শাটার ভেঙ্গে লুটপাট শুরু হয়ে যেত
আমাদের কোথাও কিন্তু এরকম হয়নি ... ১/২ টা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ... তারমধ্যে আবার গাজীপুরের ঘটনাটাও আছে
এই হলাম আমরা... এই হলাম সুখি আমরা
গতকাল মোমবাতি কিনতে গিয়েছি; যে মোমবাতির দাম ১০ টাকা, সেটা দোকানদার ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে চাইলো ১০০ টাকা
চোখ গরম করে টাকা দিতে যাব এমন সময় টুসস করে কারেন্ট এসে পড়লো
বেচারা পারলে দৌড় দেয় ভয়ে
নিজের দোকান... নিজের মোমবাতি... তাও সে কাচুমাচু করছে; এক পর্যায়ে বললো, ‘আইচ্ছা পার পিচ ৫০ টাকা কম দিলেও হইবো’
... এই হলাম আমরা
আমাদের দৌড় এততুকুই ... এই মোমবাতির দাম বাড়ানো পর্যন্তই
দেশ যখন অন্ধকারে, তখন বিরোধীদল ভেবেছে, “সাব্বাস পাইলাম একটা ইস্যু... সরকার নাড়ায়ে দেয়ার মতো ইস্যু”
ওদিকে সরকারিদল শিওর জনগণকে ভয় পাওয়ার থেকে বিরোধীদলকেই বেশী ভয় পেয়েছে
দুই দলের কেউই, গাজীপুরের সেই মান্নানদের কথা ভাবেনি
অথচ এরাই, ঘামতে থাকা অবস্থাতেই বিদ্যুৎ আসায় এমনন জোরে চিৎকার দিয়েছে যেন মনে হয় বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতে ফেলেছে
যে দেশে এতো সুন্দর মানুষেরা থাকে, সে দেশের তো এমন অবস্থা হবার কথা না... উহু
একটা ন্যাশনাল ক্রাইসিসে, দল মত নির্বিশেষ সবার ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা
... কিন্তু এটা, ‘কথা’ পর্যন্তই
একটা ন্যাশনাল ইস্যুতে দুইদল এক হতে পারে না... সেটা তিস্তার পানি বন্টন ইস্যু হোক বা রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প হোক
কেন, কাল বিরোধীদল যদি এসে বলতো; “আমাদের দলে যারা জ্বালানী এক্সপার্ট আছে তাদের এখনইই পাঠাচ্ছি আপনাদের সাহায্য করতে” ... তাহলে কি তাদের ভোট নিমিষে বেড়ে যেত না?
কেন, কাল যদি সরকারী দলের একজন পলিসিমেকার এতবড় ঘটনার পর সাথে সাথে পদত্যাগ করতো... তাহলে কি তার দল মানুষের কাছে আরো আস্থাভাজন হতো না?
আমি বুঝি না... যে সিম্পল বিষয়গুলো আমরা বুঝি, আপনারা কেন বুঝেন না
হ্যা আমাদের দেশের জনগন প্রচন্ড সিম্পল... কিন্তু প্লিজ এটাকে আপনারা আমাদের উইকনেস হিসেবে নিবেন না
এখন যতই ড্যাম কেয়ার ভাব নেন; যেদিন মোমবাতিওয়ালার মতো টাইমিং এর মারপ্যাঁচে পড়বেন, সেদিন এই মান্নান্রাই আপনাকে হাসিমুখে হাতে কেরোসিন নিয়ে দৌড়ানি দিবে
১টা ২টা মান্নান না ... লক্ষ লক্ষ মান্নান
যারা আপনার ক্রেডিটে নিজের লুঙ্গি পোড়াতে পারে ... সেই তারাই কিন্তু আবার নিজের লুঙ্গি বাঁচানোর জন্য, আপনাকেও পোড়াতে পারবে।
লেখক ঃ আরিফ আর হোসাইন
রাজাবাজারে শুনলাম খুশিতে মাঝরাতেই আনন্দমিছিল বের হয়ে গিয়েছিল
বাড্ডায় ছেলেপেলে খুশিতে পটকা ফুটিয়েছে... গাজীপুরে এক উত্তেজিত বান্দা খুশিতে তারাবাতি জ্বালাতে যেয়ে তার লুঙ্গি জ্বালিয়ে ফেলেছে
সে এখন গাজীপুর সদর হাসপাতালে উপুত হয়ে হাসিহাসি মুখ করে শুয়ে আছে
পুরো দেশ ১০ ঘন্টা অন্ধকারে ছিলো... এই কাহিনী বাইরের যে কোনও দেশে ঘটলে, নিমিষেই দাঙ্গা লেগে যেত
আমেরিকার মতো দেশে এতক্ষণ কারেন্ট না থাকলে তো দোকানের শাটার ভেঙ্গে লুটপাট শুরু হয়ে যেত
আমাদের কোথাও কিন্তু এরকম হয়নি ... ১/২ টা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ... তারমধ্যে আবার গাজীপুরের ঘটনাটাও আছে
এই হলাম আমরা... এই হলাম সুখি আমরা
গতকাল মোমবাতি কিনতে গিয়েছি; যে মোমবাতির দাম ১০ টাকা, সেটা দোকানদার ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে চাইলো ১০০ টাকা
চোখ গরম করে টাকা দিতে যাব এমন সময় টুসস করে কারেন্ট এসে পড়লো
বেচারা পারলে দৌড় দেয় ভয়ে
নিজের দোকান... নিজের মোমবাতি... তাও সে কাচুমাচু করছে; এক পর্যায়ে বললো, ‘আইচ্ছা পার পিচ ৫০ টাকা কম দিলেও হইবো’
... এই হলাম আমরা
আমাদের দৌড় এততুকুই ... এই মোমবাতির দাম বাড়ানো পর্যন্তই
দেশ যখন অন্ধকারে, তখন বিরোধীদল ভেবেছে, “সাব্বাস পাইলাম একটা ইস্যু... সরকার নাড়ায়ে দেয়ার মতো ইস্যু”
ওদিকে সরকারিদল শিওর জনগণকে ভয় পাওয়ার থেকে বিরোধীদলকেই বেশী ভয় পেয়েছে
দুই দলের কেউই, গাজীপুরের সেই মান্নানদের কথা ভাবেনি
অথচ এরাই, ঘামতে থাকা অবস্থাতেই বিদ্যুৎ আসায় এমনন জোরে চিৎকার দিয়েছে যেন মনে হয় বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতে ফেলেছে
যে দেশে এতো সুন্দর মানুষেরা থাকে, সে দেশের তো এমন অবস্থা হবার কথা না... উহু
একটা ন্যাশনাল ক্রাইসিসে, দল মত নির্বিশেষ সবার ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা
... কিন্তু এটা, ‘কথা’ পর্যন্তই
একটা ন্যাশনাল ইস্যুতে দুইদল এক হতে পারে না... সেটা তিস্তার পানি বন্টন ইস্যু হোক বা রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প হোক
কেন, কাল বিরোধীদল যদি এসে বলতো; “আমাদের দলে যারা জ্বালানী এক্সপার্ট আছে তাদের এখনইই পাঠাচ্ছি আপনাদের সাহায্য করতে” ... তাহলে কি তাদের ভোট নিমিষে বেড়ে যেত না?
কেন, কাল যদি সরকারী দলের একজন পলিসিমেকার এতবড় ঘটনার পর সাথে সাথে পদত্যাগ করতো... তাহলে কি তার দল মানুষের কাছে আরো আস্থাভাজন হতো না?
আমি বুঝি না... যে সিম্পল বিষয়গুলো আমরা বুঝি, আপনারা কেন বুঝেন না
হ্যা আমাদের দেশের জনগন প্রচন্ড সিম্পল... কিন্তু প্লিজ এটাকে আপনারা আমাদের উইকনেস হিসেবে নিবেন না
এখন যতই ড্যাম কেয়ার ভাব নেন; যেদিন মোমবাতিওয়ালার মতো টাইমিং এর মারপ্যাঁচে পড়বেন, সেদিন এই মান্নান্রাই আপনাকে হাসিমুখে হাতে কেরোসিন নিয়ে দৌড়ানি দিবে
১টা ২টা মান্নান না ... লক্ষ লক্ষ মান্নান
যারা আপনার ক্রেডিটে নিজের লুঙ্গি পোড়াতে পারে ... সেই তারাই কিন্তু আবার নিজের লুঙ্গি বাঁচানোর জন্য, আপনাকেও পোড়াতে পারবে।
লেখক ঃ আরিফ আর হোসাইন
বিশ্বসেরা হিমেল
আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বসেরার স্বীকৃতি পেলেন বাংলাদেশের হিমেল দেব। ২০১৪ সালের ‘কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি’ বিভাগে ‘দ্য আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ড’ পেলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সদ্যসাবেক শিক্ষার্থী হিমেল দেব।
(বিস্তারিত তথ্য:www.undergraduateawards.com/winners-2014)
সারা বিশ্বের সব স্নাতকপড়ুয়া শিক্ষার্থীর গবেষণা আর সৃজনশীলতার সম্মানজনক পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত হয় আয়ারল্যান্ডের ‘দ্য আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ড’। প্রতিবছর সাহিত্য, অর্থনীতি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর জমা দেওয়া অভিনব গবেষণা বা প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয় এই পুরস্কার। খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপকেরা বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৪ সালের ‘কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি’ বিভাগে সারাবিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের তাবৎ শিক্ষার্থীর মধ্যে এই পুরস্কার পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সদ্যসাবেক শিক্ষার্থী হিমেল দেব। স্নাতক শেষ বর্ষে করা হিমেলের থিসিসের বিষয় ছিল User Interaction Based Community Detection in Online Social Networks.
সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে ছোট ছোট কমিউনিটি শনাক্তকরণ এবং এর তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের পদ্ধতি নিয়ে। সম্প্রতি তিনি বুয়েটের কম্পিউটার কৌশল বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন।
আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের একমাত্র গবেষণাধর্মী কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচ্য হওয়ায় এমআইটি থেকে শুরু করে স্ট্যানফোর্ড, হার্ভার্ড, প্রিন্সটনের মতো বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়মিত অংশগ্রহণ দেখা যায়। আর সেই সব বিশ্বসেরা শিক্ষার্থীর ভিড়ে বাজিমাত করলেন চট্টগ্রামের পরীক্ষিত দেব ও নীলিমা দেবের সন্তান হিমেল দেব।
কী ছিল তাঁর গবেষণায়? জানতে চাইলে হিমেলের কথায় উঠে আসে, বাস্তবিক সমাজব্যবস্থার মতো অনলাইন সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোও কিছু ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত। উদাহরণ হিসেবে ফেসবুকে মানুষের ব্যক্তিগত বন্ধুতালিকার দিকে যদি আলোকপাত করা হয়, তবে দেখা যাবে সেখানে রয়েছে স্কুল-কলেজের বন্ধু থেকে শুরু করে পরিবার কিংবা অফিস সহকর্মীদের মতো ছোট ছোট গোষ্ঠী। অনলাইন সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারী মানুষগুলোর পারস্পরিক যোগাযোগের বিভিন্ন তথ্য ব্যবহার করে এ ধরনের গোষ্ঠীগুলোকে খুঁজে বের করাকে বলা হয় কমিউনিটি ডিটেকশন, যার প্রয়োগ রয়েছে ব্যবহারকারীদের তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। আর এই কমিউনিটি ডিটেকশনের একটি নতুন পদ্ধতি বাতলে দিয়ে প্রায় ১২ হাজার শব্দের একটি বিস্তারিত পেপার জমা দেওয়ার মাধ্যমে এই খেতাব জিতে নেন হিমেল।
তবে এই গবেষণার পুরস্কার এবারই প্রথম পেলেন না হিমেল। তাঁর কমিউনিটি ডিটেকশন-সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল প্রথম প্রকাশিত হয় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের বিখ্যাত ডেটাবেইস কনফারেন্স ‘ডাসফা’য়। পরবর্তী সময়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা ডেটাবেইস কনফারেন্স ‘সিগমডে’ প্রকাশিত হয় আরও দুটি পোস্টার। আন্তর্জাতিক এই কনফারেন্সগুলোতে যেখানে শুধু কিনা গ্লোবাল রিসার্চাররাই সুযোগ পান, যাঁরা প্রধানত পিএইচডি অথবা এমফিল ডিগ্রির জন্য কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র স্নাতকের শিক্ষার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে বিশেষভাবে সমাদৃত হন হিমেল।
গবেষণার কাজ কিন্তু এটাই হিমেলের প্রথম নয়। কমিউনিটি ডিটেকশন ছাড়াও হিমেল কাজ করেছেন ক্লাউড কম্পিউটিং এবং ক্রাউডসোর্স সিস্টেমস নিয়ে। এই কাজগুলো প্রকাশিত হয়েছে সিগকাই, সুপার কম্পিউটিংসহ বিভিন্ন খ্যাতনামা কনফারেন্সে। গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘হাইডেলবার্গ লরিয়েট সম্মেলনে’ বিশ্বের ১০০ জন উদীয়মান কম্পিউটার বিজ্ঞান গবেষকদের তালিকায় থাকার সম্মান। ইতিমধ্যে তাঁর ছয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রকাশনা রয়েছে।
এত অল্প সময়ে এত ভালো গবেষক হয়ে ওঠার পেছনের রহস্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেকোনো গবেষণার জন্য কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি অনেক বেশি ধৈর্যের প্রয়োজন। প্রাথমিক সাফল্যেই সন্তুষ্ট না হয়ে উত্তরোত্তর উন্নয়নের মাধ্যমে গবেষণার মানকে আরও সমৃদ্ধ করাই একজন গবেষকের লক্ষ্য হওয়া উচিত।’ তবে তিনি এই গবেষণাকাজে সহযোগিতার জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনুস আলী ও সহকারী অধ্যাপক ড. তানজিমা হাশেমের প্রতি।
তরুণদের গবেষণার প্রতি উৎসাহ দেওয়ার জন্য গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক ড. মোহাম্মদ ইউনুস আলীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনি জানান, ‘তরুণ গবেষকদের স্বল্পমেয়াদি সফলতার পেছনে না ছুটে কাজের মানের দিকে বেশি নজর দেওয়া উচিত। সাফল্য গবেষণার বাই প্রোডাক্ট, এটাকে কখনোই মূল লক্ষ্য মনে করা উচিত নয়।’
লেখক ঃ তৌশিকুর রহমান
আমাদের হিমেল দেবের এই পুরস্কার অর্জন, তাও আবার বিশ্বের বাঘা বাঘা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পেছনে ফেলে নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য, বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় একটা অর্জন।
আমাদের বড় ব্যর্থতা যে আমাদের শিক্ষার মান এখনো সম্যকভাবে বহির্বিশ্বে আমরা তুলে ধরতে পারিনি। বাংলাদেশে যে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা সম্ভব এবং তা যে আমাদের স্নাতকের ছাত্ররাই করতে পারে, হিমেলের সাফল্য আমাদের সে বিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। অবশ্য আমাদের কম্পিউটার কৌশলের শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা করে আসছে এবং ইতিমধ্যেই আমাদের অনেক শিক্ষার্থীদের গবেষণার ফলাফল স্নাতককালেই আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের ছাত্রদের প্রোগ্রামিং জ্ঞানও যে বিশ্বমানের, তাও আমাদের শিক্ষার্থীরা গত ১৭ বছর ধরে প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে স্বাক্ষর রেখে চলেছে।
এটা শুধু বুয়েটের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও তাদের প্রোগ্রামিং মেধার বলেই মাইক্রোসফট থেকে শুরু করে গুগলসহ বিশ্বের খ্যাতনামা আইটি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কাজ করছে এবং কাজ করার সুযোগ অর্জন করছে।
আমি আশা রাখব, হিমেলের এই সাফল্য বাংলাদেশের সব ছাত্রের জন্য ভবিষ্যতে একটি মডেল হিসেবে থাকবে এবং তাদের অনুপ্রাণিত করবে।
লেখক ঃ মোহাম্মদ কায়কোবাদ
অধ্যাপক, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
(বিস্তারিত তথ্য:www.undergraduateawards.com/winners-2014)
সারা বিশ্বের সব স্নাতকপড়ুয়া শিক্ষার্থীর গবেষণা আর সৃজনশীলতার সম্মানজনক পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত হয় আয়ারল্যান্ডের ‘দ্য আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ড’। প্রতিবছর সাহিত্য, অর্থনীতি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর জমা দেওয়া অভিনব গবেষণা বা প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয় এই পুরস্কার। খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপকেরা বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৪ সালের ‘কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি’ বিভাগে সারাবিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের তাবৎ শিক্ষার্থীর মধ্যে এই পুরস্কার পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সদ্যসাবেক শিক্ষার্থী হিমেল দেব। স্নাতক শেষ বর্ষে করা হিমেলের থিসিসের বিষয় ছিল User Interaction Based Community Detection in Online Social Networks.
সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে ছোট ছোট কমিউনিটি শনাক্তকরণ এবং এর তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের পদ্ধতি নিয়ে। সম্প্রতি তিনি বুয়েটের কম্পিউটার কৌশল বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন।
আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের একমাত্র গবেষণাধর্মী কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচ্য হওয়ায় এমআইটি থেকে শুরু করে স্ট্যানফোর্ড, হার্ভার্ড, প্রিন্সটনের মতো বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়মিত অংশগ্রহণ দেখা যায়। আর সেই সব বিশ্বসেরা শিক্ষার্থীর ভিড়ে বাজিমাত করলেন চট্টগ্রামের পরীক্ষিত দেব ও নীলিমা দেবের সন্তান হিমেল দেব।
কী ছিল তাঁর গবেষণায়? জানতে চাইলে হিমেলের কথায় উঠে আসে, বাস্তবিক সমাজব্যবস্থার মতো অনলাইন সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোও কিছু ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত। উদাহরণ হিসেবে ফেসবুকে মানুষের ব্যক্তিগত বন্ধুতালিকার দিকে যদি আলোকপাত করা হয়, তবে দেখা যাবে সেখানে রয়েছে স্কুল-কলেজের বন্ধু থেকে শুরু করে পরিবার কিংবা অফিস সহকর্মীদের মতো ছোট ছোট গোষ্ঠী। অনলাইন সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারী মানুষগুলোর পারস্পরিক যোগাযোগের বিভিন্ন তথ্য ব্যবহার করে এ ধরনের গোষ্ঠীগুলোকে খুঁজে বের করাকে বলা হয় কমিউনিটি ডিটেকশন, যার প্রয়োগ রয়েছে ব্যবহারকারীদের তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। আর এই কমিউনিটি ডিটেকশনের একটি নতুন পদ্ধতি বাতলে দিয়ে প্রায় ১২ হাজার শব্দের একটি বিস্তারিত পেপার জমা দেওয়ার মাধ্যমে এই খেতাব জিতে নেন হিমেল।
তবে এই গবেষণার পুরস্কার এবারই প্রথম পেলেন না হিমেল। তাঁর কমিউনিটি ডিটেকশন-সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল প্রথম প্রকাশিত হয় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের বিখ্যাত ডেটাবেইস কনফারেন্স ‘ডাসফা’য়। পরবর্তী সময়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা ডেটাবেইস কনফারেন্স ‘সিগমডে’ প্রকাশিত হয় আরও দুটি পোস্টার। আন্তর্জাতিক এই কনফারেন্সগুলোতে যেখানে শুধু কিনা গ্লোবাল রিসার্চাররাই সুযোগ পান, যাঁরা প্রধানত পিএইচডি অথবা এমফিল ডিগ্রির জন্য কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র স্নাতকের শিক্ষার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে বিশেষভাবে সমাদৃত হন হিমেল।
গবেষণার কাজ কিন্তু এটাই হিমেলের প্রথম নয়। কমিউনিটি ডিটেকশন ছাড়াও হিমেল কাজ করেছেন ক্লাউড কম্পিউটিং এবং ক্রাউডসোর্স সিস্টেমস নিয়ে। এই কাজগুলো প্রকাশিত হয়েছে সিগকাই, সুপার কম্পিউটিংসহ বিভিন্ন খ্যাতনামা কনফারেন্সে। গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘হাইডেলবার্গ লরিয়েট সম্মেলনে’ বিশ্বের ১০০ জন উদীয়মান কম্পিউটার বিজ্ঞান গবেষকদের তালিকায় থাকার সম্মান। ইতিমধ্যে তাঁর ছয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রকাশনা রয়েছে।
এত অল্প সময়ে এত ভালো গবেষক হয়ে ওঠার পেছনের রহস্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেকোনো গবেষণার জন্য কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি অনেক বেশি ধৈর্যের প্রয়োজন। প্রাথমিক সাফল্যেই সন্তুষ্ট না হয়ে উত্তরোত্তর উন্নয়নের মাধ্যমে গবেষণার মানকে আরও সমৃদ্ধ করাই একজন গবেষকের লক্ষ্য হওয়া উচিত।’ তবে তিনি এই গবেষণাকাজে সহযোগিতার জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনুস আলী ও সহকারী অধ্যাপক ড. তানজিমা হাশেমের প্রতি।
তরুণদের গবেষণার প্রতি উৎসাহ দেওয়ার জন্য গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক ড. মোহাম্মদ ইউনুস আলীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনি জানান, ‘তরুণ গবেষকদের স্বল্পমেয়াদি সফলতার পেছনে না ছুটে কাজের মানের দিকে বেশি নজর দেওয়া উচিত। সাফল্য গবেষণার বাই প্রোডাক্ট, এটাকে কখনোই মূল লক্ষ্য মনে করা উচিত নয়।’
লেখক ঃ তৌশিকুর রহমান
বাংলাদেশের গর্ব হিমেল
সারা বিশ্বে ‘আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ড’কে অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ একটি পুরস্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। স্নাতক পর্যায়ে উদীয়মান গবেষকদের অনুপ্রাণিত করার জন্য সারাবিশ্বের শিক্ষার্থীদের জন্য এই আয়োজন।আমাদের হিমেল দেবের এই পুরস্কার অর্জন, তাও আবার বিশ্বের বাঘা বাঘা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পেছনে ফেলে নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য, বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় একটা অর্জন।
আমাদের বড় ব্যর্থতা যে আমাদের শিক্ষার মান এখনো সম্যকভাবে বহির্বিশ্বে আমরা তুলে ধরতে পারিনি। বাংলাদেশে যে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা সম্ভব এবং তা যে আমাদের স্নাতকের ছাত্ররাই করতে পারে, হিমেলের সাফল্য আমাদের সে বিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। অবশ্য আমাদের কম্পিউটার কৌশলের শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা করে আসছে এবং ইতিমধ্যেই আমাদের অনেক শিক্ষার্থীদের গবেষণার ফলাফল স্নাতককালেই আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের ছাত্রদের প্রোগ্রামিং জ্ঞানও যে বিশ্বমানের, তাও আমাদের শিক্ষার্থীরা গত ১৭ বছর ধরে প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে স্বাক্ষর রেখে চলেছে।
এটা শুধু বুয়েটের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও তাদের প্রোগ্রামিং মেধার বলেই মাইক্রোসফট থেকে শুরু করে গুগলসহ বিশ্বের খ্যাতনামা আইটি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কাজ করছে এবং কাজ করার সুযোগ অর্জন করছে।
আমি আশা রাখব, হিমেলের এই সাফল্য বাংলাদেশের সব ছাত্রের জন্য ভবিষ্যতে একটি মডেল হিসেবে থাকবে এবং তাদের অনুপ্রাণিত করবে।
লেখক ঃ মোহাম্মদ কায়কোবাদ
অধ্যাপক, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
বেকার মানেই বাতিল নয়
ছেলে তখন বেকার হয়নি। বেকার হওয়ার পথে আর কি। জীবনে ঝড়ের ঘনঘটা। পকেটে খুচরো খাচরা মিলিয়ে বোধহয় পঞ্চাশটা টাকা থাকত। বন্ধুতো দুরে থাক। একটা মশাও বসত না গায়ে। পাড়ার অদুরে একটা চিপায় বইসা বিড়ি টানত। মোটা মানিব্যাগওয়ালা বন্ধুরা সাই সাই করে হোন্ডা চালিয়ে ক্রস করার সময় হাল্কা থামাত
- কিরে খবর কি
- আপাতত নাই
- গত সপ্তাহে কক্সবাজার গেছিলাম। তুই তো গেলিনা। যে মজা করছি। মালের উপর শুইয়া ছিলাম দোস্ত
মুচকি হাসত ছেলে। তুই তো গেলিনা? তারে বলাই হয়নাই যাওয়ার কথা। বাজেটে ফিটিং ছিলনা। একসময় এই বন্ধুদের বাজেট টা নিজের থেকে দিয়ে সম্মানজনক পর্যায়ে আনত যে ছেলে,সেদিন তারেই ফাপড়? কত রঙ্গ দেখাইল যে সাই..
ছেলের ইয়ার ফাইনাল একজামের সময়ের ঘটনা। ফরম ফিলাপের লাস্ট ডেট। কিন্তু টাকা নাই। ফোন দিল বন্ধুদের্। একেক জনের এক একটা অজুহাত
- দোস্ত আমার কাছে তো নাই
- এক হাজার!!! এত টাকা কই পামু দোস্ত
সে বন্ধুরাই বিকালে তার সামনে হাজার টাকার ভদকার বোতল খুলল। ছেলে সেদিনও হেসেছিল। ভদকা গিলবার টাকা আছে। কিন্তু বন্ধুর ফর্ম ফিলাপের জন্য দেয়ার মত টাকা নাই ...মাল মানুষের মৌলিক অধিকার
এরপর ছেলে পাশ কইরা করল আরেক পাপ। বেকার মানেই অভিশাপ। সকালটা শুরু হয় মায়ের খোটা শুনে। দিনটা পার হয় চাকরির বিজ্ঞাপনে। এরই মধ্যে বন্ধুরা অনেক এগিয়ে গেছে। পোষ্টে এবং পার্টে। অলটাইম ফর্মাল ড্রেস। ফোন দিল সেইরকম পাওয়ারফুল এক বন্ধুলে। ভাল কোম্পানিতে ভাল জবে
- দোস্ত দেখ না একটা জব
- দোস্ত জব তো দিতে পারি ,কিন্তু বুঝিসই তো দেয়া নেয়ার ব্যাপারটা
- মানে
- ওকে তোর জন্য কনসিডার্। পাচ লাখ দিলেই হইব
ফোনটা রাইখা ধ্যানে বসছিল ছেলে। আজকের এই রিয়াদ না একদিন পাচ টাকার বেনসন দুই টাকা তার থেকে নিয়া মিলাইত। আজ সে রিয়াদের ডিমান্ড পাচ লক্ষ?
এদিকে বন্ধুরা দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে গেল। এস্টাবলিশড টাই টুই পড়া কর্পোরেট ডুডদের পাশে ক্ষেত কুচকানো শার্টের বেকার ছেলেটাকে মানায়না। ওকে মাইনাস কইরা দে। কেমন লাগে? দুরে বইসা সব খবর পাইত ছেলে। জি এফ দের নিয়ে পার্টি থ্রো, সিলেট ভ্রমন। বেকার গ্রুপে সে একলাই রইল
কিন্তু দিন কি পাল্টায় না? পাল্টায়। আল্লাহ যারে মাথা দেয় ,তারে কে ঠেকায়। এক বিখ্যাত কোম্পানির সিইও ঠিকই চিনে নেয় রত্ন। এপোয়েন্টমেন্ট লেটার টা হাতে ধরিয়ে বলে
- বেকার মানেই বাতিল নয়। তুমি জয়েন কর্।
সেদিনের সে বেকার ছেলে আজ এলিয়নে চড়ে। সকালে মা নিজের হাতে ডিমটা তুলে দেয় প্লেটে। সদ্য কুচিভাঙ্গা পিটার ইংল্যান্ডের শার্টটা থেকে লোমানির সুগন্ধ বেরোয়। একদিন ফোন দেয় সে বন্ধু। ভদকার বোতল খুলেছিল যে
-দোস্ত আমার তো বিদেশ যাওয়া দরকার্। ফ্যামিলির অবস্থা খারাপ জানিসই তো। তুই যদি দুই লাখটা টাকা ধার দেস। আমি শোধ করে দেব দোস্ত
ছেলে সেদিনও মুচকি হাসে। সে সন্ধ্যায় দুই লক্ষ টাকার একটা চেক আর একটা শিভাস রিগ্যালের বোতল পৌছে যায় বন্ধুর ঠিকানায়। চিরকুটে ছোট্ট করে লেখা ,বেকার মানেই বাতিল নয়।
আরেকদিন ফোন দেয় সেই হাই পোষ্টের হ্যাডমওয়ালা বন্ধু। ভাগ্যের হেরফেরে দুর্নিতীতে ধরা খেয়ে আজ সে চাকরী হারিয়ে পথের ফকির
- দোস্ত তোর তো অনেক লিঙ্ক দেখ না একটা জব। ছোটখাট হলেই চলবে
- জব তো আছে। তবে বুঝিসি তো দেয়া নেয়ার ব্যাপার্।
- মানে দোস্ত
- আচ্ছা তুই দোস্ত মানুষ। তোর লাইগা কনসিডারেশন। এক কাপ চা খাওয়াইলেই চলবে
ফোনটা কেটে মুচকি হেসে অফিস থেকে বের হয় একদার বেকার ছেলে। দিস ইজ কলড সুইট রিভেঞ্জ...মুখের উপর হাইসা হাইসা থাপ্পড়
দিন সবারই আসে রে পাগলা। বেকার মানেই বাতিল নয়। এই শীত তোমাদের্। এই শীতে তোমরা শহরের কোণায় মাথা নিচু করে বসে থাকা যে ছেলেটাকে গ্যারবেজ ভেবে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছ , আসছে শীতে সে হ্যাডম হবে...
লেখক ঃ ওয়ারিশ আজাদ নাফি
- কিরে খবর কি
- আপাতত নাই
- গত সপ্তাহে কক্সবাজার গেছিলাম। তুই তো গেলিনা। যে মজা করছি। মালের উপর শুইয়া ছিলাম দোস্ত
মুচকি হাসত ছেলে। তুই তো গেলিনা? তারে বলাই হয়নাই যাওয়ার কথা। বাজেটে ফিটিং ছিলনা। একসময় এই বন্ধুদের বাজেট টা নিজের থেকে দিয়ে সম্মানজনক পর্যায়ে আনত যে ছেলে,সেদিন তারেই ফাপড়? কত রঙ্গ দেখাইল যে সাই..
ছেলের ইয়ার ফাইনাল একজামের সময়ের ঘটনা। ফরম ফিলাপের লাস্ট ডেট। কিন্তু টাকা নাই। ফোন দিল বন্ধুদের্। একেক জনের এক একটা অজুহাত
- দোস্ত আমার কাছে তো নাই
- এক হাজার!!! এত টাকা কই পামু দোস্ত
সে বন্ধুরাই বিকালে তার সামনে হাজার টাকার ভদকার বোতল খুলল। ছেলে সেদিনও হেসেছিল। ভদকা গিলবার টাকা আছে। কিন্তু বন্ধুর ফর্ম ফিলাপের জন্য দেয়ার মত টাকা নাই ...মাল মানুষের মৌলিক অধিকার
এরপর ছেলে পাশ কইরা করল আরেক পাপ। বেকার মানেই অভিশাপ। সকালটা শুরু হয় মায়ের খোটা শুনে। দিনটা পার হয় চাকরির বিজ্ঞাপনে। এরই মধ্যে বন্ধুরা অনেক এগিয়ে গেছে। পোষ্টে এবং পার্টে। অলটাইম ফর্মাল ড্রেস। ফোন দিল সেইরকম পাওয়ারফুল এক বন্ধুলে। ভাল কোম্পানিতে ভাল জবে
- দোস্ত দেখ না একটা জব
- দোস্ত জব তো দিতে পারি ,কিন্তু বুঝিসই তো দেয়া নেয়ার ব্যাপারটা
- মানে
- ওকে তোর জন্য কনসিডার্। পাচ লাখ দিলেই হইব
ফোনটা রাইখা ধ্যানে বসছিল ছেলে। আজকের এই রিয়াদ না একদিন পাচ টাকার বেনসন দুই টাকা তার থেকে নিয়া মিলাইত। আজ সে রিয়াদের ডিমান্ড পাচ লক্ষ?
এদিকে বন্ধুরা দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে গেল। এস্টাবলিশড টাই টুই পড়া কর্পোরেট ডুডদের পাশে ক্ষেত কুচকানো শার্টের বেকার ছেলেটাকে মানায়না। ওকে মাইনাস কইরা দে। কেমন লাগে? দুরে বইসা সব খবর পাইত ছেলে। জি এফ দের নিয়ে পার্টি থ্রো, সিলেট ভ্রমন। বেকার গ্রুপে সে একলাই রইল
কিন্তু দিন কি পাল্টায় না? পাল্টায়। আল্লাহ যারে মাথা দেয় ,তারে কে ঠেকায়। এক বিখ্যাত কোম্পানির সিইও ঠিকই চিনে নেয় রত্ন। এপোয়েন্টমেন্ট লেটার টা হাতে ধরিয়ে বলে
- বেকার মানেই বাতিল নয়। তুমি জয়েন কর্।
সেদিনের সে বেকার ছেলে আজ এলিয়নে চড়ে। সকালে মা নিজের হাতে ডিমটা তুলে দেয় প্লেটে। সদ্য কুচিভাঙ্গা পিটার ইংল্যান্ডের শার্টটা থেকে লোমানির সুগন্ধ বেরোয়। একদিন ফোন দেয় সে বন্ধু। ভদকার বোতল খুলেছিল যে
-দোস্ত আমার তো বিদেশ যাওয়া দরকার্। ফ্যামিলির অবস্থা খারাপ জানিসই তো। তুই যদি দুই লাখটা টাকা ধার দেস। আমি শোধ করে দেব দোস্ত
ছেলে সেদিনও মুচকি হাসে। সে সন্ধ্যায় দুই লক্ষ টাকার একটা চেক আর একটা শিভাস রিগ্যালের বোতল পৌছে যায় বন্ধুর ঠিকানায়। চিরকুটে ছোট্ট করে লেখা ,বেকার মানেই বাতিল নয়।
আরেকদিন ফোন দেয় সেই হাই পোষ্টের হ্যাডমওয়ালা বন্ধু। ভাগ্যের হেরফেরে দুর্নিতীতে ধরা খেয়ে আজ সে চাকরী হারিয়ে পথের ফকির
- দোস্ত তোর তো অনেক লিঙ্ক দেখ না একটা জব। ছোটখাট হলেই চলবে
- জব তো আছে। তবে বুঝিসি তো দেয়া নেয়ার ব্যাপার্।
- মানে দোস্ত
- আচ্ছা তুই দোস্ত মানুষ। তোর লাইগা কনসিডারেশন। এক কাপ চা খাওয়াইলেই চলবে
ফোনটা কেটে মুচকি হেসে অফিস থেকে বের হয় একদার বেকার ছেলে। দিস ইজ কলড সুইট রিভেঞ্জ...মুখের উপর হাইসা হাইসা থাপ্পড়
দিন সবারই আসে রে পাগলা। বেকার মানেই বাতিল নয়। এই শীত তোমাদের্। এই শীতে তোমরা শহরের কোণায় মাথা নিচু করে বসে থাকা যে ছেলেটাকে গ্যারবেজ ভেবে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছ , আসছে শীতে সে হ্যাডম হবে...
লেখক ঃ ওয়ারিশ আজাদ নাফি
A Man
Who is a MAN?
A man is a beautiful part of God's creation who starts compromising at a very tender age.
He sacrifices his chocolates for his sister.
He sacrifices his dreams for just a smile on his parents face.
He spends his entire pocket money on buying gifts for the lady he loves just to see her smiling.
He sacrifices his full youth for his wife & children by working late at night without any complain.
He builds their future by taking loans from banks & repaying them for lifetime.
He struggles a lot & still has to bear scolding from his mother, wife & boss.
His life finally ends up only by compromising for others' happiness.
If he goes out, then he's careless
If he stays at home, then he's a lazy
If he scolds children, then he's a monster
If he doesn't scold, then he's a irresponsible guy
If he stops wife from working, then he's an insecure guy
If he doesn't stops wife from working, then he's somebody who lives on wife's earnings.
If he listens to mom, then he's mama's boy
If he listens to wife, he's wife's slave
Respect every male in your life. U will never know what he has sacrificed for you. Worth sending to every man to make him smile & every woman to make her realize his worth!
A man is a beautiful part of God's creation who starts compromising at a very tender age.
He sacrifices his chocolates for his sister.
He sacrifices his dreams for just a smile on his parents face.
He spends his entire pocket money on buying gifts for the lady he loves just to see her smiling.
He sacrifices his full youth for his wife & children by working late at night without any complain.
He builds their future by taking loans from banks & repaying them for lifetime.
He struggles a lot & still has to bear scolding from his mother, wife & boss.
His life finally ends up only by compromising for others' happiness.
If he goes out, then he's careless
If he stays at home, then he's a lazy
If he scolds children, then he's a monster
If he doesn't scold, then he's a irresponsible guy
If he stops wife from working, then he's an insecure guy
If he doesn't stops wife from working, then he's somebody who lives on wife's earnings.
If he listens to mom, then he's mama's boy
If he listens to wife, he's wife's slave
Respect every male in your life. U will never know what he has sacrificed for you. Worth sending to every man to make him smile & every woman to make her realize his worth!
একাত্তরের দিনগুলি
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন খালেদের সাথে রেণুর বিয়েটা ধুমধাম করে হয়েছিল। বিয়ের পরদিনই যুদ্ধের ডাক পেয়ে রনাঙ্গনে চলে যায় ক্যাপ্টেন খালেদ। যদিও প্রেমের বিয়ে না, তবে চিঠি চালাচালির মাধ্যমে এনগেজমেন্ট আর বিয়ের মাঝামাঝির তিনমাসে ভালোই প্রেম করেছে ওরা...
রেনুর মনে পড়ে বাসর রাতের কথা...
- আচ্ছা রেনু, তুমি কি কখনও প্রেম করেছ।
রেনু মুচকি হেসে বলল,
" হাঁ করেছি তো। "
খালেদের মুখটা কেমন বোকাবোকা হয়ে গেল। আর্মির লোক সে। জেনারেলের অর্ডার বুঝে। কিন্তু নারীর মন বুঝা তার চেয়ে কঠিন...
" তার মান... তার মানে, তুমি আমায় বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছ।" খালেদ... উত্তেজিত হলে তোতলানো তার অভ্যাস
" আচ্ছা, তুমি এতো গাধা কেন" -রেনু
" মানে আমি গাধা না। আর তুমি যার সাথে প্রেম করতে সে খুব চালাক ছিল। "
" না গো না। আমি তোমারই।"
" এই শুন... তুমি সবসময় চোখে কাজল দিবা"
" কেন"
" কাজল দিলে তোমায় সুচিত্রার মত লাগে..."
আচ্ছা তাই বুঝি,......... "
বৃদ্ধ শশুরকে নিয়ে থাকত রেণু। অগাস্টের ১৫ তারিখে প্রথম রাজাকারেরা তার বাসায় হানা দিয়ে তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা করে। রেণু কিচ্ছু বলেনি। পরের সপ্তাহে আসবে বলে হুমকী দিয়ে চলে যায় রাজাকারেরা। অগাস্টের ২২ তারিখে রাজাকারেরা ক্যাপ্টেন খালদের স্ত্রী রেণুকে টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়ার কয়েকদিন আগে রেণু স্বামীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে পাঠায়। এরপর থেকে রেণুর আর খোজ পাওয়া যায়নি...
আখাউরা সেক্টর, মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প
অগাস্টের ২৫ তারিখ কুমিল্লা ফেরত সহযোদ্ধা টিপু মারফত ক্যাপ্টেন খালেদ একটা চিঠি আর কিছু টাকা পায়। রেণুর চিঠি।
টিপুকে বিদায় দিয়ে কাঁপা হাতে চিঠিটা খুলল খালেদ। সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে লিখে রেনু
প্রিয় খালেদ
কেমন আছ। আশা করি ভাল। তোমার চিঠিটা পেয়েছিলাম। বাবা আল্লাহর রহমতে সুস্থ আছেন। খালেদ কিছু কথা তোমায় বলা হয়নি। সেদিন রাতে প্রশ্ন করেছিলে, আমি কাউকে ভালবেসেছিলাম কিনা?এড়িয়ে গিয়েছিলাম প্রশ্নটা।আজ মনে হল প্রশ্নটার জবাব না দিলে আমি অশুচি রয়ে যাব। হাঁ, কলেজ লাইফে একজন কে ভালোবেসেছিলাম। আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু। কবিতা লিখত। কবিতা শুনিয়ে অল্পবয়সী রেনুকে পাগল করে দিয়েছিলেন। অনেক স্বপ্ন দেখানোর পর একদিন জানতে পারি, ওনার একটা বিয়ে হয়েছে আগে। গোপনে। সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আর কোনদিন কোন পুরুষ কে ঘিরে স্বপ্ন দেখব না। কিন্তু এরপর তোমার সাথে কথা হল। চিঠিতে। বুঝলাম মেয়ে সম্পর্কে তোমার ধারণা কম। আমি এমনটাই চেয়েছিলাম, একতাল কাঁদা... যা দিয়ে একটা ঘর বানানো যায়। গতকাল রাজাকার মোবারক আর তিন পাক মেজর এসেছিল বাসায়। আমাকে নানা প্রশ্ন করেছিল। তুমি কোথায় আছ, তোমাদের ক্যাম্প কোথায়, তুমি বাড়িতে আসো কিনা। মনে হয় ওরা কিছু সন্দেহ করছে। আমি জানি ওরা আবার আসবে। বাবার জন্য চিন্তা কোরনা। বাবার দুই মাসের ঔষধ কিনে রেখেছি। কাজল ফুফু রেধে দিবেন রোজ। আমাকে হয়ত ইন্টারোগেট করার জন্য ওরা ধরে নিয়ে যেতে পারে। চিন্তা কোরনা। কিছু বলব না। মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর সম্মানটা রাখব, যতই কস্ট দেক। স্বামী হিসেবে মাত্র একটা রাত তোমায় পাশে পেয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস কর,সেই রাতটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত ছিল। সাথে কিছু টাকা পাঠালাম। আমার স্কলারশিপের টাকা। সংকোচ বোধ কোরনা নিতে। তোমার ফেরার অপেক্ষায় রইলাম।
ইতি তোমার
রেনু
রেনুর জন্য বুকটা হু হু করে ঊঠক খালেদের্। স্বাধীনতা তুমি, ভালোবাসার বলি নিয়ে সুর্য ওঠাও
পরিশেষঃ ডিসেম্বরের ৪ তারিখে বিখ্যাত আখাউড়ার যুদ্ধে , হানাদার বাহিনীর গুলিতে আরো দুই সহযোদ্ধাসহ ক্যাপ্টেন খালেদ নিহত হন। ডিসেম্বরের ৮ তারিখে কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার পর, পাকবাহিনীর ক্যাম্পের পেছনে মুক্তিযোদ্ধারা একজন নারীর গলিত লাশ খুজে পায়। পচা লাশ শেয়াল কুকুরে খেয়ে ফেলেছিল অর্ধেক। তবে হাতের আংটি সনাক্ত করে বোঝা যায়, সেটা ক্যাপ্টেন খালেদের স্ত্রী রেণুর লাশ...
লেখক ঃ ওয়ারিশ আজাদ নাফি
রেনুর মনে পড়ে বাসর রাতের কথা...
- আচ্ছা রেনু, তুমি কি কখনও প্রেম করেছ।
রেনু মুচকি হেসে বলল,
" হাঁ করেছি তো। "
খালেদের মুখটা কেমন বোকাবোকা হয়ে গেল। আর্মির লোক সে। জেনারেলের অর্ডার বুঝে। কিন্তু নারীর মন বুঝা তার চেয়ে কঠিন...
" তার মান... তার মানে, তুমি আমায় বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছ।" খালেদ... উত্তেজিত হলে তোতলানো তার অভ্যাস
" আচ্ছা, তুমি এতো গাধা কেন" -রেনু
" মানে আমি গাধা না। আর তুমি যার সাথে প্রেম করতে সে খুব চালাক ছিল। "
" না গো না। আমি তোমারই।"
" এই শুন... তুমি সবসময় চোখে কাজল দিবা"
" কেন"
" কাজল দিলে তোমায় সুচিত্রার মত লাগে..."
আচ্ছা তাই বুঝি,......... "
বৃদ্ধ শশুরকে নিয়ে থাকত রেণু। অগাস্টের ১৫ তারিখে প্রথম রাজাকারেরা তার বাসায় হানা দিয়ে তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা করে। রেণু কিচ্ছু বলেনি। পরের সপ্তাহে আসবে বলে হুমকী দিয়ে চলে যায় রাজাকারেরা। অগাস্টের ২২ তারিখে রাজাকারেরা ক্যাপ্টেন খালদের স্ত্রী রেণুকে টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়ার কয়েকদিন আগে রেণু স্বামীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে পাঠায়। এরপর থেকে রেণুর আর খোজ পাওয়া যায়নি...
আখাউরা সেক্টর, মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প
অগাস্টের ২৫ তারিখ কুমিল্লা ফেরত সহযোদ্ধা টিপু মারফত ক্যাপ্টেন খালেদ একটা চিঠি আর কিছু টাকা পায়। রেণুর চিঠি।
টিপুকে বিদায় দিয়ে কাঁপা হাতে চিঠিটা খুলল খালেদ। সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে লিখে রেনু
প্রিয় খালেদ
কেমন আছ। আশা করি ভাল। তোমার চিঠিটা পেয়েছিলাম। বাবা আল্লাহর রহমতে সুস্থ আছেন। খালেদ কিছু কথা তোমায় বলা হয়নি। সেদিন রাতে প্রশ্ন করেছিলে, আমি কাউকে ভালবেসেছিলাম কিনা?এড়িয়ে গিয়েছিলাম প্রশ্নটা।আজ মনে হল প্রশ্নটার জবাব না দিলে আমি অশুচি রয়ে যাব। হাঁ, কলেজ লাইফে একজন কে ভালোবেসেছিলাম। আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু। কবিতা লিখত। কবিতা শুনিয়ে অল্পবয়সী রেনুকে পাগল করে দিয়েছিলেন। অনেক স্বপ্ন দেখানোর পর একদিন জানতে পারি, ওনার একটা বিয়ে হয়েছে আগে। গোপনে। সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আর কোনদিন কোন পুরুষ কে ঘিরে স্বপ্ন দেখব না। কিন্তু এরপর তোমার সাথে কথা হল। চিঠিতে। বুঝলাম মেয়ে সম্পর্কে তোমার ধারণা কম। আমি এমনটাই চেয়েছিলাম, একতাল কাঁদা... যা দিয়ে একটা ঘর বানানো যায়। গতকাল রাজাকার মোবারক আর তিন পাক মেজর এসেছিল বাসায়। আমাকে নানা প্রশ্ন করেছিল। তুমি কোথায় আছ, তোমাদের ক্যাম্প কোথায়, তুমি বাড়িতে আসো কিনা। মনে হয় ওরা কিছু সন্দেহ করছে। আমি জানি ওরা আবার আসবে। বাবার জন্য চিন্তা কোরনা। বাবার দুই মাসের ঔষধ কিনে রেখেছি। কাজল ফুফু রেধে দিবেন রোজ। আমাকে হয়ত ইন্টারোগেট করার জন্য ওরা ধরে নিয়ে যেতে পারে। চিন্তা কোরনা। কিছু বলব না। মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর সম্মানটা রাখব, যতই কস্ট দেক। স্বামী হিসেবে মাত্র একটা রাত তোমায় পাশে পেয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস কর,সেই রাতটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত ছিল। সাথে কিছু টাকা পাঠালাম। আমার স্কলারশিপের টাকা। সংকোচ বোধ কোরনা নিতে। তোমার ফেরার অপেক্ষায় রইলাম।
ইতি তোমার
রেনু
রেনুর জন্য বুকটা হু হু করে ঊঠক খালেদের্। স্বাধীনতা তুমি, ভালোবাসার বলি নিয়ে সুর্য ওঠাও
পরিশেষঃ ডিসেম্বরের ৪ তারিখে বিখ্যাত আখাউড়ার যুদ্ধে , হানাদার বাহিনীর গুলিতে আরো দুই সহযোদ্ধাসহ ক্যাপ্টেন খালেদ নিহত হন। ডিসেম্বরের ৮ তারিখে কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার পর, পাকবাহিনীর ক্যাম্পের পেছনে মুক্তিযোদ্ধারা একজন নারীর গলিত লাশ খুজে পায়। পচা লাশ শেয়াল কুকুরে খেয়ে ফেলেছিল অর্ধেক। তবে হাতের আংটি সনাক্ত করে বোঝা যায়, সেটা ক্যাপ্টেন খালেদের স্ত্রী রেণুর লাশ...
লেখক ঃ ওয়ারিশ আজাদ নাফি
তাঁর দরকার ‘লিভ টুগেদার’
রংপুর জিলা স্কুলের মাঠে দুটো বটগাছ ছিল। আমরা সেই বটগাছের নিচে অনুষ্ঠান করতাম, অ্যাসেমব্লি করতাম, খেলতাম ও আড্ডা দিতাম। মাথার ওপরে ছিল পাখিদের অভয়নগর। তারা লাল লাল ফল খেত আর সেসবই একটু পরে বের করে দিত শরীর থেকে। আমরা মাথায় হাত বুলাতাম, গুঁড়ো গুঁড়ো বটের লাল ফল মাথা থেকে ঝরে পড়ত।
এমনি একদিন খেলার শেষে মাঠে বটগাছের নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছি। আমাদের বন্ধু তাহের আলী বলল, ‘সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি রে, কখন কী ভুল হয়া যায়।’
‘কী ভুল করেছ তুমি, তাহের আলী?’
তাহের আলী বলল, ‘শোনো, ঢাকা গেছি। বড়লোক আত্মীয়র বাড়ি উঠেছি। বাথরুমে গেছি। বালতির অর্ধেকটা ভরা। বালতির পানি ঢেলে দিলাম কমোডে। তখন দেখি, বালতির পানিতে লুঙ্গি ভেজানো ছিল। সেই লুঙ্গির অর্ধেকটা চলে গেছে পাইপের ভেতর। অর্ধেকটা বাইরে। এখন না পারি ঢোকাতে, না পারি বের করতে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাহের আলী—‘সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি রে, কখন কী ভুল হয়া যায়!’
তারপর রংপুর থেকে আমিও এলাম ঢাকায়।
ভোরের কাগজ-এ চাকরি করতে গিয়ে একজন সহকর্মী পেলাম। তাঁর নাম শাহানা হুদা রঞ্জনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পাস করেছেন। দারুণ রসিক। কথায় কথায় জানতে পারলাম, রঞ্জনার বাড়িও রংপুর। এবং তাঁর একজন কাজিন আছে, নাম তাহের আলী। শুনে আমি হাসতে হাসতে বাঁচি না। সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি রে, কখন কী ভুল হয়া যায়।
‘আপনিই সেই বড়লোক আত্মীয়, রঞ্জনা!’
রঞ্জনা আর সুমনা শারমীন ছোটবেলার বন্ধু। তাঁরা তখন গল্প করতে শুরু করেন। শোনেন, ‘আমরা কী রকম বড়লোক ছিলাম।’
রঞ্জনার বাবা তখন ঢাকায় একটা ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক।
রঞ্জনা আর সুমনা থাকেন আসাদ গেট কলোনিতে, পড়তে যান ধানমন্ডি ও আজিমপুরের দুটো স্কুলে। তাঁরা যান বাসে চড়ে।
তখন একজন আরেকজনকে বলছেন, ‘দোয়া কর, যেন এত বড়লোক হতে পারি, যেন প্রতিদিন রিকশায় চড়ে চলাচল করতে পারি।’
শুনে দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক রঞ্জনার বাবা বলেছিলেন, ‘কোনো কিছু আশা করলে বড় আশা করো। দোয়া করো, যেন তোমরা প্রতিদিন মোটরসাইকেলে চড়তে পার।’
রঞ্জনা হাসেন। ‘বোঝেন, আমরা কী রকম বড়লোক ছিলাম।’
এখন তাহলে আমার আর তাহের আলীর কথা ভাবুন। আমাদের কাছে তো রঞ্জনারাই বড়লোক।
রঞ্জনার গল্প কেন মনে এল? সম্প্রতি আমাদের আরেক কবিবন্ধু জুয়েল মাজহার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন:
“বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকার ইংরেজি মান!!!
এটা একটি নামীদামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকার ১৮ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে দেওয়া স্ট্যাটাস:
‘Every year I am forgeted my birthday but my son, he is not forgeted. 19 October he give me. Birthday gift. Jear. Melaire brand watch. Feeling happiness.’
আমাদের মেধাবী বাচ্চাদের তাহলে কেন দোষ দিই? ওদের যা পড়ানো হবে তা-ই তো ওরা শিখবে। তাহলে আমাদের শিশুরা কিছু না পারলে তার দায়টা তো আমাদের বড়দেরই নাকি? ফুটনোট: তিনি ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষিকা নন।”
এই স্ট্যাটাস পড়ে আমি একটা মন্তব্য লিখেছিলাম— অনেকটা আঁতেল মার্কা মন্তব্য:
‘আমাদের ইংরেজির অবস্থা খারাপ। তার মানে এই না যে আমাদের বাংলার অবস্থা ভালো। বাংলায় একটা নির্ভুল চিঠি লেখার ক্ষমতা আমাদের বেশির ভাগেরই নেই। কেউ ভুল বাংলা লিখলে আমরা সেটা নিয়ে লজ্জা পাই না। কিন্তু ইংরেজি ভুল করলে আমরা খুব লজ্জা পাই। এটার কারণ কি ঔপনিবেশিক মানস? আসলে কেউ কেউ থাকেন, বানান-প্রতিবন্ধী। ভাষা-প্রতিবন্ধী। তিনি হয়তো তাঁর বিষয়ে খুব ভালো। খুব বড় বিজ্ঞানী বা চিকিৎসক বা খেলোয়াড়। কিন্তু বাংলা বা ইংরেজি লিখতে পারেন না। এটা নিয়ে হাসাহাসি করা উচিত নয়।’
কথাটা বললাম বটে, কিন্তু আমাদের শিক্ষার দৈন্য নিয়ে দুর্ভাবনা তাতে কমে না। যিনি ভাষা-প্রতিবন্ধী, তিনি কেন শিক্ষকতা করবেন?
রঞ্জনা আমাদের একটা গল্প শুনিয়েছেন। আমি বিশদ বর্ণনা দেব না। আমি গল্পের চরিত্রের পরিচয় গোপন রাখতে চাই।
তাঁদের একজন সাবেক সহকর্মী বলছেন, ‘খুলনার সার্কিট হাউসের ডিপোজিটেই আমাদের বাড়ি।’
‘ডিপোজিটে মানে?’
‘ডিপোজিটে মানে ডিপোজিটে। ঠিক ডিপোজিটেই আমাদের বাড়ি। সার্কিট হাউসের বারান্দা থেকেই দেখা যায়।’
একই ভদ্রলোক নাকি একবার আড্ডায় বলেছিলেন, ‘বহুদিন খাওয়াদাওয়া হয় না। হইচই হয় না। রঞ্জনা, আপনার বাড়িতে সবাইকে দাওয়াত দেন। এবার ‘লিভ টুগেদার’ করা দরকার।’
বলাবাহুল্য, ভদ্রলোক যথাক্রমে ‘অপজিট’ ও ‘গেট টুগেদার’ বলতে চেয়েছিলেন।
এই ভদ্রলোকই একবার তাঁদের অফিসের সবচেয়ে বড় কর্তার স্তুতি করছিলেন। বড় স্যার একটা ভালো কাজ করছেন। সবাই তাঁকে শ্রেণিমতো সাধ্যমতো ‘তেল’ দিচ্ছেন। ‘স্যার, আপনি যা করেছেন, এই রকম আর কেউ করেনি।’ ‘স্যার, আপনি একটা ভাবতে পারলেন, ভাবতে পারলেন আবার করতে পারলেন’... ‘আপনি স্যার সত্যিই মহান।’ এর মধ্যে আমাদের ডিপোজিট সাহেব বলে বসলেন, ‘স্যার, আপনি এত ভালো কাজ করেছেন, মনে হচ্ছে আপনাকে মমি করে রেখে দিই...’
এই গল্প শুনে আমরা হাসতে হাসতে বাঁচি না।
আমাদের কিন্তু একটা অবক্ষয় চলছে। শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষা-চলচ্চিত্র ইত্যাদির ক্ষেত্রে আমরা বেশ একটা অবক্ষয়ের কাল পার করছি। আমাদের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো একে একে চলে যাচ্ছেন। তাঁদের বিকল্প দেখছি না।
এই যে একটা শূন্যতা, তার পেছনে একটা কারণ কিন্তু ১৯৭১ সালে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা। তালিকা প্রস্তুত করে বাড়ি থেকে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হলো আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। সবচেয়ে মেধাবী, সবচেয়ে সৃজনশীল মানুষগুলোকে। মুনীর চৌধুরীর মতো নাট্যকার শিক্ষক আমরা আর পাব কই? শহীদুল্লা কায়সারের মতো লেখক আর সাংবাদিক? জহির রায়হানের মতো চলচ্চিত্রকার?
সেই যে শূন্যতা, সেই ক্ষতি, তার ধকল আজও আমাদের দিতে হচ্ছে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
এমনি একদিন খেলার শেষে মাঠে বটগাছের নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছি। আমাদের বন্ধু তাহের আলী বলল, ‘সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি রে, কখন কী ভুল হয়া যায়।’
‘কী ভুল করেছ তুমি, তাহের আলী?’
তাহের আলী বলল, ‘শোনো, ঢাকা গেছি। বড়লোক আত্মীয়র বাড়ি উঠেছি। বাথরুমে গেছি। বালতির অর্ধেকটা ভরা। বালতির পানি ঢেলে দিলাম কমোডে। তখন দেখি, বালতির পানিতে লুঙ্গি ভেজানো ছিল। সেই লুঙ্গির অর্ধেকটা চলে গেছে পাইপের ভেতর। অর্ধেকটা বাইরে। এখন না পারি ঢোকাতে, না পারি বের করতে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাহের আলী—‘সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি রে, কখন কী ভুল হয়া যায়!’
তারপর রংপুর থেকে আমিও এলাম ঢাকায়।
ভোরের কাগজ-এ চাকরি করতে গিয়ে একজন সহকর্মী পেলাম। তাঁর নাম শাহানা হুদা রঞ্জনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পাস করেছেন। দারুণ রসিক। কথায় কথায় জানতে পারলাম, রঞ্জনার বাড়িও রংপুর। এবং তাঁর একজন কাজিন আছে, নাম তাহের আলী। শুনে আমি হাসতে হাসতে বাঁচি না। সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি রে, কখন কী ভুল হয়া যায়।
‘আপনিই সেই বড়লোক আত্মীয়, রঞ্জনা!’
রঞ্জনা আর সুমনা শারমীন ছোটবেলার বন্ধু। তাঁরা তখন গল্প করতে শুরু করেন। শোনেন, ‘আমরা কী রকম বড়লোক ছিলাম।’
রঞ্জনার বাবা তখন ঢাকায় একটা ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক।
রঞ্জনা আর সুমনা থাকেন আসাদ গেট কলোনিতে, পড়তে যান ধানমন্ডি ও আজিমপুরের দুটো স্কুলে। তাঁরা যান বাসে চড়ে।
তখন একজন আরেকজনকে বলছেন, ‘দোয়া কর, যেন এত বড়লোক হতে পারি, যেন প্রতিদিন রিকশায় চড়ে চলাচল করতে পারি।’
শুনে দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক রঞ্জনার বাবা বলেছিলেন, ‘কোনো কিছু আশা করলে বড় আশা করো। দোয়া করো, যেন তোমরা প্রতিদিন মোটরসাইকেলে চড়তে পার।’
রঞ্জনা হাসেন। ‘বোঝেন, আমরা কী রকম বড়লোক ছিলাম।’
এখন তাহলে আমার আর তাহের আলীর কথা ভাবুন। আমাদের কাছে তো রঞ্জনারাই বড়লোক।
রঞ্জনার গল্প কেন মনে এল? সম্প্রতি আমাদের আরেক কবিবন্ধু জুয়েল মাজহার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন:
“বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকার ইংরেজি মান!!!
এটা একটি নামীদামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকার ১৮ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে দেওয়া স্ট্যাটাস:
‘Every year I am forgeted my birthday but my son, he is not forgeted. 19 October he give me. Birthday gift. Jear. Melaire brand watch. Feeling happiness.’
আমাদের মেধাবী বাচ্চাদের তাহলে কেন দোষ দিই? ওদের যা পড়ানো হবে তা-ই তো ওরা শিখবে। তাহলে আমাদের শিশুরা কিছু না পারলে তার দায়টা তো আমাদের বড়দেরই নাকি? ফুটনোট: তিনি ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষিকা নন।”
এই স্ট্যাটাস পড়ে আমি একটা মন্তব্য লিখেছিলাম— অনেকটা আঁতেল মার্কা মন্তব্য:
‘আমাদের ইংরেজির অবস্থা খারাপ। তার মানে এই না যে আমাদের বাংলার অবস্থা ভালো। বাংলায় একটা নির্ভুল চিঠি লেখার ক্ষমতা আমাদের বেশির ভাগেরই নেই। কেউ ভুল বাংলা লিখলে আমরা সেটা নিয়ে লজ্জা পাই না। কিন্তু ইংরেজি ভুল করলে আমরা খুব লজ্জা পাই। এটার কারণ কি ঔপনিবেশিক মানস? আসলে কেউ কেউ থাকেন, বানান-প্রতিবন্ধী। ভাষা-প্রতিবন্ধী। তিনি হয়তো তাঁর বিষয়ে খুব ভালো। খুব বড় বিজ্ঞানী বা চিকিৎসক বা খেলোয়াড়। কিন্তু বাংলা বা ইংরেজি লিখতে পারেন না। এটা নিয়ে হাসাহাসি করা উচিত নয়।’
কথাটা বললাম বটে, কিন্তু আমাদের শিক্ষার দৈন্য নিয়ে দুর্ভাবনা তাতে কমে না। যিনি ভাষা-প্রতিবন্ধী, তিনি কেন শিক্ষকতা করবেন?
রঞ্জনা আমাদের একটা গল্প শুনিয়েছেন। আমি বিশদ বর্ণনা দেব না। আমি গল্পের চরিত্রের পরিচয় গোপন রাখতে চাই।
তাঁদের একজন সাবেক সহকর্মী বলছেন, ‘খুলনার সার্কিট হাউসের ডিপোজিটেই আমাদের বাড়ি।’
‘ডিপোজিটে মানে?’
‘ডিপোজিটে মানে ডিপোজিটে। ঠিক ডিপোজিটেই আমাদের বাড়ি। সার্কিট হাউসের বারান্দা থেকেই দেখা যায়।’
একই ভদ্রলোক নাকি একবার আড্ডায় বলেছিলেন, ‘বহুদিন খাওয়াদাওয়া হয় না। হইচই হয় না। রঞ্জনা, আপনার বাড়িতে সবাইকে দাওয়াত দেন। এবার ‘লিভ টুগেদার’ করা দরকার।’
বলাবাহুল্য, ভদ্রলোক যথাক্রমে ‘অপজিট’ ও ‘গেট টুগেদার’ বলতে চেয়েছিলেন।
এই ভদ্রলোকই একবার তাঁদের অফিসের সবচেয়ে বড় কর্তার স্তুতি করছিলেন। বড় স্যার একটা ভালো কাজ করছেন। সবাই তাঁকে শ্রেণিমতো সাধ্যমতো ‘তেল’ দিচ্ছেন। ‘স্যার, আপনি যা করেছেন, এই রকম আর কেউ করেনি।’ ‘স্যার, আপনি একটা ভাবতে পারলেন, ভাবতে পারলেন আবার করতে পারলেন’... ‘আপনি স্যার সত্যিই মহান।’ এর মধ্যে আমাদের ডিপোজিট সাহেব বলে বসলেন, ‘স্যার, আপনি এত ভালো কাজ করেছেন, মনে হচ্ছে আপনাকে মমি করে রেখে দিই...’
এই গল্প শুনে আমরা হাসতে হাসতে বাঁচি না।
আমাদের কিন্তু একটা অবক্ষয় চলছে। শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষা-চলচ্চিত্র ইত্যাদির ক্ষেত্রে আমরা বেশ একটা অবক্ষয়ের কাল পার করছি। আমাদের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো একে একে চলে যাচ্ছেন। তাঁদের বিকল্প দেখছি না।
এই যে একটা শূন্যতা, তার পেছনে একটা কারণ কিন্তু ১৯৭১ সালে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা। তালিকা প্রস্তুত করে বাড়ি থেকে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হলো আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। সবচেয়ে মেধাবী, সবচেয়ে সৃজনশীল মানুষগুলোকে। মুনীর চৌধুরীর মতো নাট্যকার শিক্ষক আমরা আর পাব কই? শহীদুল্লা কায়সারের মতো লেখক আর সাংবাদিক? জহির রায়হানের মতো চলচ্চিত্রকার?
সেই যে শূন্যতা, সেই ক্ষতি, তার ধকল আজও আমাদের দিতে হচ্ছে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আমাদের গর্ব
আইনস্টাইন, নিউটন, স্টিফেন হকিং – এদের নিয়ে মাতামাতি করি, কিন্তু বাংলাদেশের বা পূর্ববঙ্গের গুণী সন্তানদের, প্রখ্যাত বিজ্ঞানীদের কথা কতটা মনে রাখি? এখনকার স্কুলের পাঠ্যবইতে এদের কথা কতোটা পড়ানো হয় জানিনা, কিন্তু আমার মনে হয়, দেশের প্রতিটি শিশুর জানা উচিৎ এসব বিজ্ঞানীর কথা, যাতে
তারা এঁদেরকে হিরো হিসাবে দেখতে শিখে ছোটবেলা হতে, আর বিজ্ঞানচর্চায় আরো আগ্রহী হয়।
- ফিঙ্গারপ্রিন্টিং এর আবিষ্কারক – কাজি আজিজুল হক (১৮৭২-১৯৩৫)। বাড়ি খুলনার ফুলতলী।
- প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (১৮৬১-১৯৪৪) – রসায়নবিদ, মারকুরিয়াস নাইট্রাইটের আবিষ্কারক। বাড়ি খুলনা।
- জগদীশ চন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭) – বেতার বা রেডিওর আসল আবিষ্কারক, গাছের প্রাণের ব্যাপারে বড় বড় সব আবিষ্কার করেছেন, বাড়ি মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর।
- প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ (১৮৯৩-১৯৭২) – পরিসংখ্যানে বহুল ব্যবহৃত মহলানবিশ ডিসট্যান্সের আবিষ্কারক, ইন্ডিয়ান ইন্স্টিটিউট অফ স্ট্যাটিস্টিক্স এর প্রতিষ্ঠাতা, বাড়ি মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর।
- জামাল নজরুল ইসলাম (১৯৩৯-২০১৩), এস্ট্রোফিজিসিস্ট, বাড়ি ঝিনাইদহ।
- মেঘনাদ সাহা (১৮৯৩-১৯৫৬), পদার্থবিজ্ঞানের থার্মাল আয়নাইজেশনের সাহা ইকুয়েশনের আবিষ্কারক, বাড়ি ঢাকার শেওড়াতলী।
- অমল কুমার রায়চৌধুরী (১৯২৩-২০০৫), পদার্থবিজ্ঞানের আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কসমোলজিতে বহুল ব্যবহৃত রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের আবিষ্কারক, বাড়ি বরিশাল।
- মোহাম্মদ আতাউল করিম (১৯৫৩-), অপটিকাল ফিজিক্সের সেরা ৫০ জন বিজ্ঞানীর একজন, বাড়ি সিলেট।
- সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪), পদার্থবিজ্ঞানের বর্তমানে বহুল আলোচিত বোসন কণিকার নাম তাঁর নামানুসারে, তিনি আইনস্টাইনের সাথে মিলে বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স তত্ত্বের প্রণেতা। বাড়ি কোলকাতা হলেও তাঁর ক্যারিয়ার আর এই আবিষ্কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগেই হয়েছে।
- আবুল হুসাম, আর্সেনিক দূরীকরণের জন্য সনো ফিল্টারের উদ্ভাবক, বাড়ি কুষ্টিয়া।
- মাকসুদুল আলম, পেঁপে, রাবার ও পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছেন, বাড়ি ফরিদপুর।
- শুভ রায়, কৃত্রিম কিডনির উদ্ভাবক, বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি।
- ফজলুর রহমান খান (১৯২৯-১৯৮২), বহুদিন ধরে বিশ্বের সবচেয়ে উচু ভবন সিয়ার্স টাওয়ার ও জন হ্যানকক টাওয়ারের ডিজাইনার, বহুতল ভবন নির্মানের নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবক, বাড়ি ঢাকা।
- শাহ এম ফারুক, কলেরার উপরে গুরুত্বপুর্ণ আবিষ্কার করেছেন, আইসিডিডিআরবিতে কর্মরত।
তারা এঁদেরকে হিরো হিসাবে দেখতে শিখে ছোটবেলা হতে, আর বিজ্ঞানচর্চায় আরো আগ্রহী হয়।
- ফিঙ্গারপ্রিন্টিং এর আবিষ্কারক – কাজি আজিজুল হক (১৮৭২-১৯৩৫)। বাড়ি খুলনার ফুলতলী।
- প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (১৮৬১-১৯৪৪) – রসায়নবিদ, মারকুরিয়াস নাইট্রাইটের আবিষ্কারক। বাড়ি খুলনা।
- জগদীশ চন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭) – বেতার বা রেডিওর আসল আবিষ্কারক, গাছের প্রাণের ব্যাপারে বড় বড় সব আবিষ্কার করেছেন, বাড়ি মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর।
- প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ (১৮৯৩-১৯৭২) – পরিসংখ্যানে বহুল ব্যবহৃত মহলানবিশ ডিসট্যান্সের আবিষ্কারক, ইন্ডিয়ান ইন্স্টিটিউট অফ স্ট্যাটিস্টিক্স এর প্রতিষ্ঠাতা, বাড়ি মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর।
- জামাল নজরুল ইসলাম (১৯৩৯-২০১৩), এস্ট্রোফিজিসিস্ট, বাড়ি ঝিনাইদহ।
- মেঘনাদ সাহা (১৮৯৩-১৯৫৬), পদার্থবিজ্ঞানের থার্মাল আয়নাইজেশনের সাহা ইকুয়েশনের আবিষ্কারক, বাড়ি ঢাকার শেওড়াতলী।
- অমল কুমার রায়চৌধুরী (১৯২৩-২০০৫), পদার্থবিজ্ঞানের আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কসমোলজিতে বহুল ব্যবহৃত রায়চৌধুরী ইকুয়েশনের আবিষ্কারক, বাড়ি বরিশাল।
- মোহাম্মদ আতাউল করিম (১৯৫৩-), অপটিকাল ফিজিক্সের সেরা ৫০ জন বিজ্ঞানীর একজন, বাড়ি সিলেট।
- সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪), পদার্থবিজ্ঞানের বর্তমানে বহুল আলোচিত বোসন কণিকার নাম তাঁর নামানুসারে, তিনি আইনস্টাইনের সাথে মিলে বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স তত্ত্বের প্রণেতা। বাড়ি কোলকাতা হলেও তাঁর ক্যারিয়ার আর এই আবিষ্কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগেই হয়েছে।
- আবুল হুসাম, আর্সেনিক দূরীকরণের জন্য সনো ফিল্টারের উদ্ভাবক, বাড়ি কুষ্টিয়া।
- মাকসুদুল আলম, পেঁপে, রাবার ও পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছেন, বাড়ি ফরিদপুর।
- শুভ রায়, কৃত্রিম কিডনির উদ্ভাবক, বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি।
- ফজলুর রহমান খান (১৯২৯-১৯৮২), বহুদিন ধরে বিশ্বের সবচেয়ে উচু ভবন সিয়ার্স টাওয়ার ও জন হ্যানকক টাওয়ারের ডিজাইনার, বহুতল ভবন নির্মানের নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবক, বাড়ি ঢাকা।
- শাহ এম ফারুক, কলেরার উপরে গুরুত্বপুর্ণ আবিষ্কার করেছেন, আইসিডিডিআরবিতে কর্মরত।
বাংলাভাষা পরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২১)
ভাষার প্রকৃতির মধ্যে একটা গৃহিণীপনা আছে। নতুন শব্দ বানাবার সময় অনেক স্থলেই একই শব্দে কিছু মালমসলা যোগ ক'রে কিংবা দুটো-তিনটে শব্দ পাশাপাশি আঁট করে দিয়ে তাদের বিশেষ ব্যবহারে লাগিয়ে দেয়, নইলে তার ভাণ্ডারে জায়গা হত না। এই কাজে সংস্কৃত ভাষার নৈপুণ্য অসাধারণ। ব্যবস্থাবন্ধনের নিয়মে তার মতো সতর্কতা দেখা যায় না। বাংলা ভাষায় নিয়মের খবরদারি যথেষ্ট পাকা নয়, কিন্তু সেও কতকগুলো নির্মাণরীতি বানিয়েছে। তার মধ্যে অনেকগুলোকে সমাসের পর্যায়ে ফেলা যায়, যেমন : চটামেজাজ নাকিসুর তোলাউনুন ভোলামন। এগুলো হল বিশেষ্য-বিশেষণের জোড়। বিশেষণগুলোও ক্রিয়াপদকে প্রত্যয়ের শান দিয়ে বসানো। সেও একটা মিতব্যয়িতার কৌশল। বদমেজাজি ভালোমানুষি তিনমহলা, এগারোহাতি (শাড়ি) : এখানে জোড়া শব্দের শেষ অংশীদারের পিঠে ইকারের আকারের ছাপ লাগিয়ে দিয়ে তাকে এক শ্রেণীর বিশেষ্য থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে আর-এক শ্রেণীর বিশেষ্যে। অবশেষে সেই বিশেষ্যের গোড়ার দিকে বিশেষণ যোগ ক'রে তাকে বিশেষত্ব দিয়েছে। অবিকৃত বিশেষ্য-বিশেষণের মিলন ঘটানো হয়েছে সহজেই; তার দৃষ্টান্ত অনাবশ্যক। বিশেষ্যের সঙ্গে বিশেষ্য গেঁথে সংস্কৃত বহুব্রীহি মধ্যপদলোপী কর্মধারয়ের মতো এক-একটা বাক্যাংশকে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। যেমন "পুজোবাড়ি', অর্থাৎ পুজো হচ্ছে যে বাড়িতে সেই বাড়ি। কাঠাকয়লা : কাঠ পুড়িয়ে যে কয়লা হয় সেই কয়লা। হাঁটুজল : হাঁটু পর্যন্ত গভীর যে জল সেই জল। মাটকোঠা : মাটি দিয়ে তৈরি হয়েছে যে কোঠা। দুই বিশেষণের যোগে যে সমাস তারও গ্রন্থি ছাড়িয়ে দিলে অর্থের ব্যাখ্যা বিস্তৃত হয়ে পড়ে; যেমন : কাঁচামিঠে : কাঁচা তবুও মিষ্টি। বাদশাহি-কুঁড়ে : বাদশার সমতুল্য তার কুঁড়েমি। সেয়ানা-বোকা : লোকটাকে বোকার মতো দেখায় কিন্তু আসলে সেয়ানা। বিশেষ্য এবং ক্রিয়া থেকে বিশেষণ-করা শব্দের যোগ, যেমন : পটলচেরা : অর্থাৎ পটল চিরলে যে গড়ন পাওয়া যায় সেই গড়নের। কাঠঠোকরা : কাঠে যে ঠোকর মারে। চুলচেরা : চুল চিরলে সে যত সূক্ষ্ম হয় তত সূক্ষ্ম।
কিন্তু শব্দরচনায় বাংলা আষার নিজের বিশেষত্ব আছে, তার আলোচনা করা যাক।
বাংলা ভঙ্গীওয়লা ভাষা। ভাবপ্রকাশের এরকম সাহিত্যিক রীতি অন্য কোনো ভাষায় আমার জানা নেই।
অর্থহীন ধ্বনিসমবায়ে শব্দরচনার দিকে এই ভাষায় যে ঝোঁক আছে তার আলোচনা পূর্বেই করেছি। আমাদের বোধশক্তি যে শব্দার্থজালে ধরা দিতে চায় না বাংলা ভাষা তাকে সেই অর্থেই বন্ধন থেকে ছাড়া দিতে কণ্ঠিত হয় নি, আভিধানিক শাসনকে লঙ্ঘন ক'রে সে বোবার প্রকাশ-প্রণালীকেও অঙ্গীকার করে নিয়েছে।
ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলিতে তার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছি। পোকা কিল্বিল্ করছে : এ বাক্যের ভাবটা ছবিটা কোনো স্পষ্ট ভাষায় বলা যায় না। "খিট্খিটে' শব্দের প্রতিশব্দ ইংরেজিতে আছে; irritable, peevish, pettish; কিন্তু "খিট্খিটে' শব্দের মতো এমন তার জোর নেই। নেশায় চুর্চুর্ হওয়া, কট্মট্ ক'রে তাকানো, ধপাস্ ক'রে পড়া, পা টন্ টন্ করা, গা ম্যাজ্ ম্যাজ্ করা : ঠিক এ-সব শব্দের ভাব বোঝানো ধাতুপ্রত্যয়ওয়ালা ভাষার কর্ম নয়। ইংরেজিতে বলে creeping sensation, বাংলায় বলে "গা ছম্ছম্ করা'; আমার তো মনে হয় বাংলারই জিত। গুটিকয়েক রঙের বোধকে ধ্বনি দিয়ে প্রকাশ করায় বাংলা ভাষার একটা আকুতি দেখতে পাওয়া যায় : টুক্টুকে টক্টকে দগ্দগে লাল, ধব্ধবে ফ্যাক্ফেকে ফ্যাট্ফেটে সাদা, মিস্মিসে কুচকুচে কালো।
বাংলায় শব্দের দ্বিত্ব ঘটিয়ে যে ভাবপ্রকাশের রীতি আছে সেও একটা ইশারার ভঙ্গী, যেমন : টাটকা-টাটকা গরম-গরম শীত-শীত মেঘ-মেঘ জ্বর-জ্বর যাব-যাব উঠি-উঠি। অর্থের অসংগতি, অত্যুক্তি, রূপক-ব্যবহার, তাতেও প্রকাশ হয় ভঙ্গীর চাঞ্চল্য; অন্য ভাষাতেও আছে, কিন্তু বাংলায় আছে প্রচুর পরিমাণে।
আকাশ থেকে পড়া, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া, হাড় কালী করে দেওয়া, পিটিয়ে লম্বা করা, তেসে দেওয়া, গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়ানো, নাকে তেল দিয়ে ঘুমোনো, তেলে বেগুনে জ্বলা, পিত্তি জ্বলে যাওয়া, হাড়ে হাড়ে বজ্জাতি, ঘেন্না পিত্তি, বুদ্ধির ঢেঁকি, পাড়া মাথায় করা, তুলো ধুনে দেওয়া, ঘোল খাইয়ে দেওয়া, হেসে কুরুক্ষেত্র, হাসতে হাসতে পেটের নাড়ি ছেঁড়া, কিল খেয়ে কিল চুরি, আদায় কাঁচকলায় আহ্লাদে আটখানা : এমন বিস্তর আছে।
বাংলায় অনেক জোড়া শব্দ আছে যার এক অংশে অর্থ, অন্য অংশে নিরর্থকতা। তাতে করে অর্থের চারি দিকে একটা ঝাপসা পরিমণ্ডল সৃষ্টি করা হয়েছে; সেই জায়গাটাতে যা তা কল্পনা করবার উপায় থাকে।
আমরা বলি "ওষুধপত্র'। "ওষুধ' বলতে কী বোঝায় তা জানা আছে, কিন্তু "পত্রটা' যে কী তার সংজ্ঞা নির্ণয় করা অসম্ভব। ওটুকু অব্যক্তই রেখে দেওয়া হয়েছে, সুতরাং ওতে অনেক কিছুই বোঝাতে পারে। হয়তো ফীবার্মিক্শ্চারের সঙ্গে মকরধ্বজ, ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপ্শন, থর্মমীটার, কুইনীনের বড়ি, হোমিয়োপ্যাথি ওষুধের বাক্স। হয়তো তাও নয়। হয়তো কেবলমাত্র দু বোতল ডি-গুপ্ত। এমনি "মালপত্র' "দলিলপত্র' বিছানাপত্র' প্রভৃতি শব্দে ব্যক্ত অব্যক্তের যুগলমিলন।
আর-একরকম জোড়মেলানো শব্দ আছে যেখানে দুই ভাগেরই এক মানে, কিংবা প্রায় সমান মানে; যেমন "লোকলস্কর'। এই "লস্কর' শব্দে সব জায়গাতেই যে ফৌজ বোঝাতেই তা নয়; প্রায় ওতে "লোক' শব্দের অর্থের সঙ্গে অনির্দিষ্ট লোকসঙ্ঘের ব্যাপকতা বোঝায়। অন্যরকম করে বলতে গেলে হয়ত বলতুম, হাজার হাজার লোক চলেছে; অথচ গুণে দেখলে হয়ত আড়াইশো'র বেশি লোক পাওয়া যেত না।
খুব "চড়চাপড়' লাগালে : ওর মধ্যে চড়টা সুনিশ্চিত, চাপড়টা অনিশ্চিত। ওটা কি তবে একবার গালে চড়, একবার পিঠে চাপড়। খুব সম্ভব তা নয়। তবে কি অনেকগুলো চড়। হতেও পারে।
মারাধরা মারধোর : বর্ণিত ঘটনায় শুধু হয়তো মারাই হয়েছিল কিন্তু ধরা হয়নি। কিন্তু "মারধোর' শব্দের দ্বারা মারটাকে সুনির্দিষ্ট সীমার বাইরে ব্যাপ্ত করা হল। যে উৎপাতটা ঘটেছিল তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলো এই শব্দে ইঙ্গিতের মধ্যে সেরে দেওয়া হয়েছে।
"কালিকিষ্টি' এটা একটা ভঙ্গীওয়ালা কথা। শুধু "কালো' বলে যখন মনে তৃপ্তি হয় না তখন তার সঙ্গে "কিষ্টি' যোগ করে কালিমাকে আরও অবজ্ঞায় ঘনিয়ে তোলা হয়।
ভাবনাচিন্তা আপদবিপদ কাটাছাঁটা হাঁকডাক শব্দে অর্থের বিস্তার করে। শুধু "চিন্তা' দুঃখজনক, কিন্তু "ভাবনাচিন্তা' বিচিত্র এবং দীর্ঘায়িত।
স্বতন্ত্র শব্দে "আপদ' কিংবা "বিপদ' বলতে যে বিশেষ ঘটনা বোঝায়, যুক্ত শব্দে ঠিক তা বোঝায় না। "আপদবিপদ' সমষ্টিগত, ওর মধ্যে অনির্দিষ্টভাবে নানাপ্রকার দুর্যোগের সম্ভাবনার সংকেত আছে।
"ধারধোর' শব্দে ধার কথার উপরেও আর কিছু অস্পষ্টভাবে উদ্বৃত্ত থাকে। হয়তো, কাউকে ধ'রে পড়া। রূপক অর্থে শুধু "ছাই' শব্দে তুচ্ছতা বোঝায় যথেষ্ট, এই অর্থে "ছাই' শব্দের ব্যবহার হয়ে থাকে, যেমন : কী ছাই বকছ। কিন্তু "ছাইভস্ম কী যে বকছ', এতে প্রলাপের বহর যেন বড়ো করে দেখানো হয়।
"হাঁড়িকুঁড়ি' শব্দ সংক্ষেপে পাকশালার বহুবিধ আয়োজনের ছবি এনে দেয়। এরকম স্থলে তন্নতন্ন বর্ণনার চেয়ে অস্পষ্ট বর্ণনার প্রভাব বেশি। "মামলা-মকদ্দমা' শব্দটা ব্রিটিশ আদালদের দীর্ঘপ্রলম্বিত বিপত্তির দ্বিপদী প্রতীক। এইজাতীয় শব্দের কতকগুলি নমুনা দেওয়া গেল : মাথামুণ্ডু মালমসলা গোনাগুন্তি চালচলন বাঁধাছাঁদা হাসিতামাশা বিয়েথাওয়া দেওয়াথোওয়া বেঁটেখাটো পাকাপোক্ত মায়াদয়া ছুটোছুটি কুটোকাটা কাঁটাখোঁচা ঘোরাফেরা নাচাকোঁদা জাঁকজমক গড়াপেটা জানাশোনা চাষাভুষো দাবিদাওয়া অদলবদল ছেলেপুলে নাতিপুতি।
৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন
কিন্তু শব্দরচনায় বাংলা আষার নিজের বিশেষত্ব আছে, তার আলোচনা করা যাক।
বাংলা ভঙ্গীওয়লা ভাষা। ভাবপ্রকাশের এরকম সাহিত্যিক রীতি অন্য কোনো ভাষায় আমার জানা নেই।
অর্থহীন ধ্বনিসমবায়ে শব্দরচনার দিকে এই ভাষায় যে ঝোঁক আছে তার আলোচনা পূর্বেই করেছি। আমাদের বোধশক্তি যে শব্দার্থজালে ধরা দিতে চায় না বাংলা ভাষা তাকে সেই অর্থেই বন্ধন থেকে ছাড়া দিতে কণ্ঠিত হয় নি, আভিধানিক শাসনকে লঙ্ঘন ক'রে সে বোবার প্রকাশ-প্রণালীকেও অঙ্গীকার করে নিয়েছে।
ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলিতে তার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছি। পোকা কিল্বিল্ করছে : এ বাক্যের ভাবটা ছবিটা কোনো স্পষ্ট ভাষায় বলা যায় না। "খিট্খিটে' শব্দের প্রতিশব্দ ইংরেজিতে আছে; irritable, peevish, pettish; কিন্তু "খিট্খিটে' শব্দের মতো এমন তার জোর নেই। নেশায় চুর্চুর্ হওয়া, কট্মট্ ক'রে তাকানো, ধপাস্ ক'রে পড়া, পা টন্ টন্ করা, গা ম্যাজ্ ম্যাজ্ করা : ঠিক এ-সব শব্দের ভাব বোঝানো ধাতুপ্রত্যয়ওয়ালা ভাষার কর্ম নয়। ইংরেজিতে বলে creeping sensation, বাংলায় বলে "গা ছম্ছম্ করা'; আমার তো মনে হয় বাংলারই জিত। গুটিকয়েক রঙের বোধকে ধ্বনি দিয়ে প্রকাশ করায় বাংলা ভাষার একটা আকুতি দেখতে পাওয়া যায় : টুক্টুকে টক্টকে দগ্দগে লাল, ধব্ধবে ফ্যাক্ফেকে ফ্যাট্ফেটে সাদা, মিস্মিসে কুচকুচে কালো।
বাংলায় শব্দের দ্বিত্ব ঘটিয়ে যে ভাবপ্রকাশের রীতি আছে সেও একটা ইশারার ভঙ্গী, যেমন : টাটকা-টাটকা গরম-গরম শীত-শীত মেঘ-মেঘ জ্বর-জ্বর যাব-যাব উঠি-উঠি। অর্থের অসংগতি, অত্যুক্তি, রূপক-ব্যবহার, তাতেও প্রকাশ হয় ভঙ্গীর চাঞ্চল্য; অন্য ভাষাতেও আছে, কিন্তু বাংলায় আছে প্রচুর পরিমাণে।
আকাশ থেকে পড়া, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া, হাড় কালী করে দেওয়া, পিটিয়ে লম্বা করা, তেসে দেওয়া, গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়ানো, নাকে তেল দিয়ে ঘুমোনো, তেলে বেগুনে জ্বলা, পিত্তি জ্বলে যাওয়া, হাড়ে হাড়ে বজ্জাতি, ঘেন্না পিত্তি, বুদ্ধির ঢেঁকি, পাড়া মাথায় করা, তুলো ধুনে দেওয়া, ঘোল খাইয়ে দেওয়া, হেসে কুরুক্ষেত্র, হাসতে হাসতে পেটের নাড়ি ছেঁড়া, কিল খেয়ে কিল চুরি, আদায় কাঁচকলায় আহ্লাদে আটখানা : এমন বিস্তর আছে।
বাংলায় অনেক জোড়া শব্দ আছে যার এক অংশে অর্থ, অন্য অংশে নিরর্থকতা। তাতে করে অর্থের চারি দিকে একটা ঝাপসা পরিমণ্ডল সৃষ্টি করা হয়েছে; সেই জায়গাটাতে যা তা কল্পনা করবার উপায় থাকে।
আমরা বলি "ওষুধপত্র'। "ওষুধ' বলতে কী বোঝায় তা জানা আছে, কিন্তু "পত্রটা' যে কী তার সংজ্ঞা নির্ণয় করা অসম্ভব। ওটুকু অব্যক্তই রেখে দেওয়া হয়েছে, সুতরাং ওতে অনেক কিছুই বোঝাতে পারে। হয়তো ফীবার্মিক্শ্চারের সঙ্গে মকরধ্বজ, ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপ্শন, থর্মমীটার, কুইনীনের বড়ি, হোমিয়োপ্যাথি ওষুধের বাক্স। হয়তো তাও নয়। হয়তো কেবলমাত্র দু বোতল ডি-গুপ্ত। এমনি "মালপত্র' "দলিলপত্র' বিছানাপত্র' প্রভৃতি শব্দে ব্যক্ত অব্যক্তের যুগলমিলন।
আর-একরকম জোড়মেলানো শব্দ আছে যেখানে দুই ভাগেরই এক মানে, কিংবা প্রায় সমান মানে; যেমন "লোকলস্কর'। এই "লস্কর' শব্দে সব জায়গাতেই যে ফৌজ বোঝাতেই তা নয়; প্রায় ওতে "লোক' শব্দের অর্থের সঙ্গে অনির্দিষ্ট লোকসঙ্ঘের ব্যাপকতা বোঝায়। অন্যরকম করে বলতে গেলে হয়ত বলতুম, হাজার হাজার লোক চলেছে; অথচ গুণে দেখলে হয়ত আড়াইশো'র বেশি লোক পাওয়া যেত না।
খুব "চড়চাপড়' লাগালে : ওর মধ্যে চড়টা সুনিশ্চিত, চাপড়টা অনিশ্চিত। ওটা কি তবে একবার গালে চড়, একবার পিঠে চাপড়। খুব সম্ভব তা নয়। তবে কি অনেকগুলো চড়। হতেও পারে।
মারাধরা মারধোর : বর্ণিত ঘটনায় শুধু হয়তো মারাই হয়েছিল কিন্তু ধরা হয়নি। কিন্তু "মারধোর' শব্দের দ্বারা মারটাকে সুনির্দিষ্ট সীমার বাইরে ব্যাপ্ত করা হল। যে উৎপাতটা ঘটেছিল তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলো এই শব্দে ইঙ্গিতের মধ্যে সেরে দেওয়া হয়েছে।
"কালিকিষ্টি' এটা একটা ভঙ্গীওয়ালা কথা। শুধু "কালো' বলে যখন মনে তৃপ্তি হয় না তখন তার সঙ্গে "কিষ্টি' যোগ করে কালিমাকে আরও অবজ্ঞায় ঘনিয়ে তোলা হয়।
ভাবনাচিন্তা আপদবিপদ কাটাছাঁটা হাঁকডাক শব্দে অর্থের বিস্তার করে। শুধু "চিন্তা' দুঃখজনক, কিন্তু "ভাবনাচিন্তা' বিচিত্র এবং দীর্ঘায়িত।
স্বতন্ত্র শব্দে "আপদ' কিংবা "বিপদ' বলতে যে বিশেষ ঘটনা বোঝায়, যুক্ত শব্দে ঠিক তা বোঝায় না। "আপদবিপদ' সমষ্টিগত, ওর মধ্যে অনির্দিষ্টভাবে নানাপ্রকার দুর্যোগের সম্ভাবনার সংকেত আছে।
"ধারধোর' শব্দে ধার কথার উপরেও আর কিছু অস্পষ্টভাবে উদ্বৃত্ত থাকে। হয়তো, কাউকে ধ'রে পড়া। রূপক অর্থে শুধু "ছাই' শব্দে তুচ্ছতা বোঝায় যথেষ্ট, এই অর্থে "ছাই' শব্দের ব্যবহার হয়ে থাকে, যেমন : কী ছাই বকছ। কিন্তু "ছাইভস্ম কী যে বকছ', এতে প্রলাপের বহর যেন বড়ো করে দেখানো হয়।
"হাঁড়িকুঁড়ি' শব্দ সংক্ষেপে পাকশালার বহুবিধ আয়োজনের ছবি এনে দেয়। এরকম স্থলে তন্নতন্ন বর্ণনার চেয়ে অস্পষ্ট বর্ণনার প্রভাব বেশি। "মামলা-মকদ্দমা' শব্দটা ব্রিটিশ আদালদের দীর্ঘপ্রলম্বিত বিপত্তির দ্বিপদী প্রতীক। এইজাতীয় শব্দের কতকগুলি নমুনা দেওয়া গেল : মাথামুণ্ডু মালমসলা গোনাগুন্তি চালচলন বাঁধাছাঁদা হাসিতামাশা বিয়েথাওয়া দেওয়াথোওয়া বেঁটেখাটো পাকাপোক্ত মায়াদয়া ছুটোছুটি কুটোকাটা কাঁটাখোঁচা ঘোরাফেরা নাচাকোঁদা জাঁকজমক গড়াপেটা জানাশোনা চাষাভুষো দাবিদাওয়া অদলবদল ছেলেপুলে নাতিপুতি।
৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন
বাংলাভাষা পরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০)
অব্যয়। বাংলা ভাষায় প্রশ্নসূচক অব্যয় সম্বন্ধে পূর্বেই আলোচনা করেছি।
প্রশ্নসূচক কি শব্দের অনুরূপ আর-একটি "কি' আছে, তাকে দীর্ঘস্বর দিয়ে লেখাই কর্তব্য। এ অব্যয় নয়, এ সর্বনাম। এ তার প্রকৃত অর্থের প্রয়োজন সেরে মাঝে মাঝে খোঁচা দেবার কাজে লাগে, যেমন : কী তোমার ছিরি, কী-যে তোমার বুদ্ধি।
তিনটি আছে যোজক অব্যয় শব্দ : এবং আর ও। "এবং' সংস্কৃত শব্দ। এর প্রকৃত অর্থ "এইমতো'। ইংরেজি The king marches with his elephants, horses and soldiers। The room is full of chairs, tables, clothes-racks and almirahs.
বাংলায় যদি বলি "রাস্তা দিয়ে চলেছে হাতি আর ঘোড়া', তা হলে বোঝাবে বিশেষ করে ওরাই চলেছে।
"আর' শব্দের আরও কয়েকটি কাজ আছে, যেমন : আর কত খাবে : অর্থাৎ অতিরিক্ত আরও কত খাবে। আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে না : অর্থাৎ পুনশ্চ দেখা হবে না।
তোমাকে আর চালাকি করতে হবে না : এ একটা ভঙ্গীওয়ালা কথা। এই শব্দ থেকে "আর' শব্দটা বাদ দিলেও চলে, কিন্তু তাতে ঝাঁজ মরে যায়।
সাহিত্যে "ও' শব্দটা "এবং' শব্দের সমান পর্যায়ে চলেছে। কিন্তু চলতি ভাষায় "ও' সংস্কৃত "চ'এর মতো, যথা : আমি যাচ্ছি তুমিও যাবে, অ্যাঙ যায় ব্যাঙ যায় খল্সে বলে আমিও যাব।
এক কালে এই "ও' ছিল "হ' রূপে, যেমন : সেহ, এহ বাহ্য, এহ তো মানুষ নয়। এই "হ' অবিকৃত রূপে বাকি আছে সাধু ভাষায় "কেহ' শব্দে। চলতি ভাষায় "কেও' থেকে ক্রমে "কেউ' হয়েছে। পুরাতন সাহিত্যে "কেহু' পাওয়া যায়, "তেঁহ শব্দটা আজ হয়েছে "তিনি'। "ওহ' নেই কিন্তু সাধু ভাষায় "উহা' আছে। "যেহ' নেই, আছে "যাহা'। এই শেষ দুটি বিশেষণ অপ্রাণী সম্পর্কে।
যোজক "ও'র উৎপত্তি ফার্সি ঊঅ (অন্তস্থ ব) শব্দ থেকে, সুতরাং and'এর প্রতিশব্দরূপে এর ব্যবহার অবৈধ নয়। কিন্তু তবু ভাষায় ভালো করে মিশ খায় নি। তুমি ও আমি একসঙ্গেই যাব : এ খাঁটি বাংলা নয়। আমরা সহজে বলি : তুমি আমি একসঙ্গেই যাব। কেউ কেউ মনে করেন "অপি' থেকে "ও' হয়েছে, কিন্তু স্বরবিকারের নিয়ম অনুসারে সেটা সম্ভব কি না সন্দেহ করি।
রাজাও চলেছে সন্ন্যাসীও চলেছে : এ খাঁটি বাংলা। কিন্তু "রাজা ও সন্নাসী চলেছে' কানে ঠিক লাগে না। সে এগোয়ও না পিছোয়ও না : "ও' শব্দের এই যথার্থ ব্যবহার। সে এগোয় না ও পিছোয় না : এ বাক্যটা দুর্বল।
তুমিও যেমন, হবেও বা : এ-সব জায়গায় "ও' ভাষাভঙ্গীর সহায়তা করে।
দেখা যায় "এবং' শব্দটাকে দিয়ে আমরা অনেক স্থানে andশব্দের অনুকরণ করাই। He has a party of enemies and they vilify him in the newspapers এ বাক্যটা ইংরেজি মতে শুদ্ধ, কিন্তু আমরা যখন ওরই তর্জমা করে বলি "তাঁর একদল শত্রু আছে এবং ওরা খবরের কাগজে তাঁর নিন্দে করে', তখন বোঝা উচিত এটা বাংলারীতি নয়। আমরা এখানে "এবং' বাদ দিই। He has enemies and they are subsidised by the government এই বাক্যটা তর্জমা করবার সময় ফস্ করে বলা অসম্ভব নয় যে : তাঁর শত্রু আছে এবং তারা সরকারের বেতনভোগী। কিন্তু ওটা ঠিক হবে না, "এবং' পরিত্যাগ করতে হবে। বাক্যের এক অংশে "থাকা', আর-এক অংশে "হওয়া', এদের মাঝখানে "এবং মধ্যস্থতা করবার অধিকার রাখে না। তিনি হচ্ছেন পাকা জোচ্চোর, এবং তিনি নোট জাল করেন : ইংরেজিতে চলে, বাংলায় চলে না।
"সে দরিদ্র এবং সে মূর্খ' এ চলে, "সে চরকা কাটে এবং ধান ভেনে খায়' এও চলে। কারণ প্রথম বাক্যের দুই অংশই অস্তিত্ববাচক, শেষ বাক্যের দুই অংশই কর্তৃত্ববাচক। কিন্তু "সে দরিদ্র এবং সে ধান ভেনে খায়' এ ভালো বাংলা নয়। আমরা বলি : সে দরিদ্র, ধান ভেনে খায়। ইংরেজিতে অনায়াস বলা চলে : She is poor and lives by husking rice।
প্রয়োগবিশেষে "যে' সর্বনামশব্দ ধরে অব্যয়রূপ, যেমন : হরি যে গেল না। "যে' শব্দ "গেল না' ব্যাপারটা নির্দিষ্ট করে দিল। তিনি বললেন যে, আজই তাঁকে যেতে হবে : "তাঁকে যেতে হবে' বাক্যটাকে "যে' শব্দ যেন ঘের দিয়ে স্বতন্ত্র করে দিলে। শুধু উক্তি নয় ঘটনাবিশেষকেও নির্দিষ্ট করা তার কাজ, যেমন : মধু যে রোজ বিকেলে বেড়াতে যায় আমি জানতুম না। মধু বিকেলে বেড়াতে যায়, এই ব্যাপারটা "যে' শব্দের দ্বারা চিহ্নিত হল।
আর-একটা অব্যয় শব্দ আছে "ই'। "ও' শব্দটা মিলন জানায়, "ই' শব্দ জানায় সাতন্ত্র্য। "তুমিও যাবে', অর্থাৎ মিলিত হয়ে যাবে। "তুমিই যাবে', অর্থাৎ একলা যাবে। "সে যাবেই ঠিক করেছে', অর্থাৎ তার যাওয়াটাই একান্ত। "ও' দেয় জুড়ে, "ই' ছিঁড়ে আনে।
বক্রোক্তির কাজেও "ই'কে লাগানো হয়েছে : কী কাণ্ডই করলে, কী বাঁদরামিই শিখেছে। "কী শোভাই হয়েছে' ভালোভাবে বলা চলে, কিন্তু মন্দাভাবে বলা আরও চলে। এর সঙ্গে "টা' জুড়ে দিলে তীক্ষ্ণতা আরও বাড়ে, যেমন : কী ঠকানটাই ঠকিয়েছে। আমরা সোজা ভাষায় প্রশংসা করে থাকি : কী চমৎকার, কী সুন্দর। ওর সঙ্গে একটু-আধটু ভঙ্গিমা জুড়ে দিলেই হয়ে দাঁড়ায় বিদ্রূপ।
"তা' শব্দটা কোথাও সর্বনাম কোথাও অব্যয়। তুমি যে না বলে যাবে তা হবে না : এখানে না বলে যাওয়ার প্রতিনিধি হচ্ছে তা, অতএব "সর্বনাম'। তা, তুমি বরং গাড়ি পাঠিয়ে দিয়ো : এই "তা' অব্যয় এবং অর্থহীন, না থাকলেও চলে। তবু মনে হয় একটুখানি ঠেলা দেবার জন্যে যেন প্রয়োজন আছে। তা, এক কাজ করলে হয় : একটা বিশেষ কাজের দিকটা ধরিয়ে দিল ঐ "তা'।
"বুঝি', সহজ অর্থ "বোধ করি'। অথচ বাংলা ভাষায় "বুঝি' "বোধ করি' "বোধ হচ্ছে' বললে সংশয়যুক্ত অনুমান বোঝায় : লোকটা বুঝি কালা, তুমি বুঝি কলকাতায় যাবে। "তুমি কি যাবে' এই বাক্যে "কি' অব্যয়ে সুস্পষ্ট প্রশ্ন। কিন্তু "তুমি বুঝি যাবে' এই প্রশ্নে যাবে কি না সন্দেহ করা হচ্ছে। বাংলা ভাষায় "বুঝি' শব্দে বুঝি ভাবটাকে অনিশ্চিত করে রাখে। বুঝির সঙ্গে "বা' জুড়ে দিলে তাতে অনুমানের সুরটা আরও প্রবল হয়।
যদি, যদি বা, যদিই বা, যদিও বা। যদি অন্যায় কর শান্তি পাবে : এটা একটা সাধারণ বাক্য। যদি বা অন্যায় ক'রে থাকি : এর মধ্যে একটু ফাঁক আছে, অর্থাৎ না করার সম্ভাবনা নেই-যে তা নয়। যদিই বা অন্যায় করে থাকি : অন্যায় করাটা নিশ্চিত বলে ধরে নিলেও আরও কিছু বলবার আছে। যদিও বা অন্যায় করে থাকি : অন্যায় সত্ত্বেও স্পর্ধা আছে মনে।
"তো' অব্যয়শব্দে অনেক স্থলে "তবু' বোঝায়, যেমন : বেলায় এলে তো খেলে না কেন। কিন্তু, তুমি তো বলেই খালাস, সে তো হেসেই অজ্ঞান, আমি তো ভালো মনে করেই তাকে ডেকেছিলুম, তুমি তো বেশ লোক, সে তো মস্ত পণ্ডিত-- এ-সব স্থলে "তো' শব্দে একটু ভর্ৎসনার বা বিস্ময়ের আভাস লাগে, যথা : তুমি তো গেলে না, সে তো বসেই রইল, তবে তো দেখছি মাটি হল।
"গো' শব্দের প্রয়োগ সম্বোধনে "তুমি' বর্গের মানুষ সম্বন্ধে, "তুই', বা "আপনি' বর্গের নয় : কেন গো, মশায় গো, কী গো, ওগো শুনে যাও, হাঁ গো তোমার হল কী। সংস্কৃত "ভোঃ' শব্দের মতো এর বহুল ব্যবহার নেই। হাঁ গো, না গো : মুখের কথায় চলে; মেয়েদের মুখেই বেশি। ভয় কিংবা ঘৃণা-প্রকাশে "মা গো'। "বাবা গো' শুধু ভয়-প্রকাশে। "শোনো' শব্দের প্রতি "গো' যোগ দিয়ে অনুরোধে মিনতির সুর লাগানো যায়। "কী গো' কেন গো' শব্দে বিদ্রূপ চলে : কেন গো, এত রাগ কেন; কেন গো, তোমার যে দেখি গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল; কী গো, এত রাগ কেন গো মশায়; কী গো, হল কী তোমার। ভয় বা দুঃখ-প্রকাশে মেয়েদের মুখে "কী হবে গো', কিংবা অনুনয়ে "একা ফেলে যেয়ো না গো'। "হাঁগা' কেনে গা' গ্রাম্য ভাষায়।
শুধু "হে' শব্দ আহ্বান অর্থে সাহিত্যেই আছে। মুখের কথায় চলে "ওহে'। কিংবা প্রশ্নের ভাবে : কে হে, কেন হে, কী হে। অনুজ্ঞায় "চলো হে'। মাননীয়দের সম্বন্ধে এই "ওহে'র ব্যবহার নেই। "তুমি' "তোমার' সঙ্গেই এর চল, "আপনি' বা "তুই' শব্দের সঙ্গে নয়।
"রে' শব্দ অসম্মানে কিংবা স্নেহপ্রকাশে : হাঁ রে, কেন রে, ওরে বেটা ভূত,ওরে হতভাগা, ওরে সর্বনেশে। এর সম্বন্ধ "তুই' "তোমা'র সঙ্গে।
"লো' "লা' মেয়েদের মুখের সম্বোধন। এও "তুই' শব্দের যোগে। ভদ্রমহল থেকে ক্রমশ এর চলন গেছে উঠে।
অব্যয় শব্দ আরও অনেক আছে, কিন্তু এইখানেই শেষ করা যাক।
৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন
প্রশ্নসূচক কি শব্দের অনুরূপ আর-একটি "কি' আছে, তাকে দীর্ঘস্বর দিয়ে লেখাই কর্তব্য। এ অব্যয় নয়, এ সর্বনাম। এ তার প্রকৃত অর্থের প্রয়োজন সেরে মাঝে মাঝে খোঁচা দেবার কাজে লাগে, যেমন : কী তোমার ছিরি, কী-যে তোমার বুদ্ধি।
তিনটি আছে যোজক অব্যয় শব্দ : এবং আর ও। "এবং' সংস্কৃত শব্দ। এর প্রকৃত অর্থ "এইমতো'। ইংরেজি The king marches with his elephants, horses and soldiers। The room is full of chairs, tables, clothes-racks and almirahs.
বাংলায় যদি বলি "রাস্তা দিয়ে চলেছে হাতি আর ঘোড়া', তা হলে বোঝাবে বিশেষ করে ওরাই চলেছে।
"আর' শব্দের আরও কয়েকটি কাজ আছে, যেমন : আর কত খাবে : অর্থাৎ অতিরিক্ত আরও কত খাবে। আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে না : অর্থাৎ পুনশ্চ দেখা হবে না।
তোমাকে আর চালাকি করতে হবে না : এ একটা ভঙ্গীওয়ালা কথা। এই শব্দ থেকে "আর' শব্দটা বাদ দিলেও চলে, কিন্তু তাতে ঝাঁজ মরে যায়।
সাহিত্যে "ও' শব্দটা "এবং' শব্দের সমান পর্যায়ে চলেছে। কিন্তু চলতি ভাষায় "ও' সংস্কৃত "চ'এর মতো, যথা : আমি যাচ্ছি তুমিও যাবে, অ্যাঙ যায় ব্যাঙ যায় খল্সে বলে আমিও যাব।
এক কালে এই "ও' ছিল "হ' রূপে, যেমন : সেহ, এহ বাহ্য, এহ তো মানুষ নয়। এই "হ' অবিকৃত রূপে বাকি আছে সাধু ভাষায় "কেহ' শব্দে। চলতি ভাষায় "কেও' থেকে ক্রমে "কেউ' হয়েছে। পুরাতন সাহিত্যে "কেহু' পাওয়া যায়, "তেঁহ শব্দটা আজ হয়েছে "তিনি'। "ওহ' নেই কিন্তু সাধু ভাষায় "উহা' আছে। "যেহ' নেই, আছে "যাহা'। এই শেষ দুটি বিশেষণ অপ্রাণী সম্পর্কে।
যোজক "ও'র উৎপত্তি ফার্সি ঊঅ (অন্তস্থ ব) শব্দ থেকে, সুতরাং and'এর প্রতিশব্দরূপে এর ব্যবহার অবৈধ নয়। কিন্তু তবু ভাষায় ভালো করে মিশ খায় নি। তুমি ও আমি একসঙ্গেই যাব : এ খাঁটি বাংলা নয়। আমরা সহজে বলি : তুমি আমি একসঙ্গেই যাব। কেউ কেউ মনে করেন "অপি' থেকে "ও' হয়েছে, কিন্তু স্বরবিকারের নিয়ম অনুসারে সেটা সম্ভব কি না সন্দেহ করি।
রাজাও চলেছে সন্ন্যাসীও চলেছে : এ খাঁটি বাংলা। কিন্তু "রাজা ও সন্নাসী চলেছে' কানে ঠিক লাগে না। সে এগোয়ও না পিছোয়ও না : "ও' শব্দের এই যথার্থ ব্যবহার। সে এগোয় না ও পিছোয় না : এ বাক্যটা দুর্বল।
তুমিও যেমন, হবেও বা : এ-সব জায়গায় "ও' ভাষাভঙ্গীর সহায়তা করে।
দেখা যায় "এবং' শব্দটাকে দিয়ে আমরা অনেক স্থানে andশব্দের অনুকরণ করাই। He has a party of enemies and they vilify him in the newspapers এ বাক্যটা ইংরেজি মতে শুদ্ধ, কিন্তু আমরা যখন ওরই তর্জমা করে বলি "তাঁর একদল শত্রু আছে এবং ওরা খবরের কাগজে তাঁর নিন্দে করে', তখন বোঝা উচিত এটা বাংলারীতি নয়। আমরা এখানে "এবং' বাদ দিই। He has enemies and they are subsidised by the government এই বাক্যটা তর্জমা করবার সময় ফস্ করে বলা অসম্ভব নয় যে : তাঁর শত্রু আছে এবং তারা সরকারের বেতনভোগী। কিন্তু ওটা ঠিক হবে না, "এবং' পরিত্যাগ করতে হবে। বাক্যের এক অংশে "থাকা', আর-এক অংশে "হওয়া', এদের মাঝখানে "এবং মধ্যস্থতা করবার অধিকার রাখে না। তিনি হচ্ছেন পাকা জোচ্চোর, এবং তিনি নোট জাল করেন : ইংরেজিতে চলে, বাংলায় চলে না।
"সে দরিদ্র এবং সে মূর্খ' এ চলে, "সে চরকা কাটে এবং ধান ভেনে খায়' এও চলে। কারণ প্রথম বাক্যের দুই অংশই অস্তিত্ববাচক, শেষ বাক্যের দুই অংশই কর্তৃত্ববাচক। কিন্তু "সে দরিদ্র এবং সে ধান ভেনে খায়' এ ভালো বাংলা নয়। আমরা বলি : সে দরিদ্র, ধান ভেনে খায়। ইংরেজিতে অনায়াস বলা চলে : She is poor and lives by husking rice।
প্রয়োগবিশেষে "যে' সর্বনামশব্দ ধরে অব্যয়রূপ, যেমন : হরি যে গেল না। "যে' শব্দ "গেল না' ব্যাপারটা নির্দিষ্ট করে দিল। তিনি বললেন যে, আজই তাঁকে যেতে হবে : "তাঁকে যেতে হবে' বাক্যটাকে "যে' শব্দ যেন ঘের দিয়ে স্বতন্ত্র করে দিলে। শুধু উক্তি নয় ঘটনাবিশেষকেও নির্দিষ্ট করা তার কাজ, যেমন : মধু যে রোজ বিকেলে বেড়াতে যায় আমি জানতুম না। মধু বিকেলে বেড়াতে যায়, এই ব্যাপারটা "যে' শব্দের দ্বারা চিহ্নিত হল।
আর-একটা অব্যয় শব্দ আছে "ই'। "ও' শব্দটা মিলন জানায়, "ই' শব্দ জানায় সাতন্ত্র্য। "তুমিও যাবে', অর্থাৎ মিলিত হয়ে যাবে। "তুমিই যাবে', অর্থাৎ একলা যাবে। "সে যাবেই ঠিক করেছে', অর্থাৎ তার যাওয়াটাই একান্ত। "ও' দেয় জুড়ে, "ই' ছিঁড়ে আনে।
বক্রোক্তির কাজেও "ই'কে লাগানো হয়েছে : কী কাণ্ডই করলে, কী বাঁদরামিই শিখেছে। "কী শোভাই হয়েছে' ভালোভাবে বলা চলে, কিন্তু মন্দাভাবে বলা আরও চলে। এর সঙ্গে "টা' জুড়ে দিলে তীক্ষ্ণতা আরও বাড়ে, যেমন : কী ঠকানটাই ঠকিয়েছে। আমরা সোজা ভাষায় প্রশংসা করে থাকি : কী চমৎকার, কী সুন্দর। ওর সঙ্গে একটু-আধটু ভঙ্গিমা জুড়ে দিলেই হয়ে দাঁড়ায় বিদ্রূপ।
"তা' শব্দটা কোথাও সর্বনাম কোথাও অব্যয়। তুমি যে না বলে যাবে তা হবে না : এখানে না বলে যাওয়ার প্রতিনিধি হচ্ছে তা, অতএব "সর্বনাম'। তা, তুমি বরং গাড়ি পাঠিয়ে দিয়ো : এই "তা' অব্যয় এবং অর্থহীন, না থাকলেও চলে। তবু মনে হয় একটুখানি ঠেলা দেবার জন্যে যেন প্রয়োজন আছে। তা, এক কাজ করলে হয় : একটা বিশেষ কাজের দিকটা ধরিয়ে দিল ঐ "তা'।
"বুঝি', সহজ অর্থ "বোধ করি'। অথচ বাংলা ভাষায় "বুঝি' "বোধ করি' "বোধ হচ্ছে' বললে সংশয়যুক্ত অনুমান বোঝায় : লোকটা বুঝি কালা, তুমি বুঝি কলকাতায় যাবে। "তুমি কি যাবে' এই বাক্যে "কি' অব্যয়ে সুস্পষ্ট প্রশ্ন। কিন্তু "তুমি বুঝি যাবে' এই প্রশ্নে যাবে কি না সন্দেহ করা হচ্ছে। বাংলা ভাষায় "বুঝি' শব্দে বুঝি ভাবটাকে অনিশ্চিত করে রাখে। বুঝির সঙ্গে "বা' জুড়ে দিলে তাতে অনুমানের সুরটা আরও প্রবল হয়।
যদি, যদি বা, যদিই বা, যদিও বা। যদি অন্যায় কর শান্তি পাবে : এটা একটা সাধারণ বাক্য। যদি বা অন্যায় ক'রে থাকি : এর মধ্যে একটু ফাঁক আছে, অর্থাৎ না করার সম্ভাবনা নেই-যে তা নয়। যদিই বা অন্যায় করে থাকি : অন্যায় করাটা নিশ্চিত বলে ধরে নিলেও আরও কিছু বলবার আছে। যদিও বা অন্যায় করে থাকি : অন্যায় সত্ত্বেও স্পর্ধা আছে মনে।
"তো' অব্যয়শব্দে অনেক স্থলে "তবু' বোঝায়, যেমন : বেলায় এলে তো খেলে না কেন। কিন্তু, তুমি তো বলেই খালাস, সে তো হেসেই অজ্ঞান, আমি তো ভালো মনে করেই তাকে ডেকেছিলুম, তুমি তো বেশ লোক, সে তো মস্ত পণ্ডিত-- এ-সব স্থলে "তো' শব্দে একটু ভর্ৎসনার বা বিস্ময়ের আভাস লাগে, যথা : তুমি তো গেলে না, সে তো বসেই রইল, তবে তো দেখছি মাটি হল।
"গো' শব্দের প্রয়োগ সম্বোধনে "তুমি' বর্গের মানুষ সম্বন্ধে, "তুই', বা "আপনি' বর্গের নয় : কেন গো, মশায় গো, কী গো, ওগো শুনে যাও, হাঁ গো তোমার হল কী। সংস্কৃত "ভোঃ' শব্দের মতো এর বহুল ব্যবহার নেই। হাঁ গো, না গো : মুখের কথায় চলে; মেয়েদের মুখেই বেশি। ভয় কিংবা ঘৃণা-প্রকাশে "মা গো'। "বাবা গো' শুধু ভয়-প্রকাশে। "শোনো' শব্দের প্রতি "গো' যোগ দিয়ে অনুরোধে মিনতির সুর লাগানো যায়। "কী গো' কেন গো' শব্দে বিদ্রূপ চলে : কেন গো, এত রাগ কেন; কেন গো, তোমার যে দেখি গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল; কী গো, এত রাগ কেন গো মশায়; কী গো, হল কী তোমার। ভয় বা দুঃখ-প্রকাশে মেয়েদের মুখে "কী হবে গো', কিংবা অনুনয়ে "একা ফেলে যেয়ো না গো'। "হাঁগা' কেনে গা' গ্রাম্য ভাষায়।
শুধু "হে' শব্দ আহ্বান অর্থে সাহিত্যেই আছে। মুখের কথায় চলে "ওহে'। কিংবা প্রশ্নের ভাবে : কে হে, কেন হে, কী হে। অনুজ্ঞায় "চলো হে'। মাননীয়দের সম্বন্ধে এই "ওহে'র ব্যবহার নেই। "তুমি' "তোমার' সঙ্গেই এর চল, "আপনি' বা "তুই' শব্দের সঙ্গে নয়।
"রে' শব্দ অসম্মানে কিংবা স্নেহপ্রকাশে : হাঁ রে, কেন রে, ওরে বেটা ভূত,ওরে হতভাগা, ওরে সর্বনেশে। এর সম্বন্ধ "তুই' "তোমা'র সঙ্গে।
"লো' "লা' মেয়েদের মুখের সম্বোধন। এও "তুই' শব্দের যোগে। ভদ্রমহল থেকে ক্রমশ এর চলন গেছে উঠে।
অব্যয় শব্দ আরও অনেক আছে, কিন্তু এইখানেই শেষ করা যাক।
৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন
আমরা প্রত্যেকেই কিন্তু এক একটা মোমবাতি
আরিফ ভাই,
ছোটবেলার প্রতিজ্ঞা থেকেই সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য একটা স্কুল করা ( নিজে ভুক্তভুগি ছিলাম বলেই হয়তো )
বিদেশে কাজ করে যা বেতন পাই, তা থেকেই টুকটুক করে চালাই এই প্রতিষ্ঠান... কারও কাছ থেকে বিন্দু মাত্র টাকা ডোনেশান নেয়নি... যা পেরেছি নিজেই করেছি
আর পারছি না
টাকা না হয় আমি সারাজীবন এই স্কুলের পিছে দিয়েই যাব কিন্তু, এই মুহূর্তে কিছু ভলান্টিয়ার না হলেই নয়
আমি দেশের বাইরে থেকে এটা এতদূর এনেছি ... আমি দেশে থাকলে হয়তো এভাবে আপনাকে বলতাম না
প্লিজ কিছু ভলান্টিয়ার জোগাড় করে দিন
আমাদের শাখা তিনটি- ঢাকা, চট্টগ্রাম আর নারায়ণগঞ্জ ... বর্তমান ছাত্র সংখ্যা ৫০০
আমরা অংক, ইংরেজি এবং বিজ্ঞানের ক্লাস নেই ... এটা কোন পরিপূর্ণ স্কুল না, বরঞ্চ ফ্রি কোচিং সেন্টারের মতোই... যেখানে গরীব ছাত্রদের রুটিন করে মৌলিক জ্ঞানের ভিত্তি করে দেয়া হয়। তাছাড়া, প্রতিমাসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চলচিত্র দেখা, পরিছন্নতা শিক্ষা ... এসব তো আছেই
এছাড়া আছে তিনটি উন্মুক্ত পাঠাগার, যেখানে আছে প্রায় ৮০০০ বই (যে কেউ গিয়ে পড়তে পারে কোনরূপ মেম্বারসিপ ছাড়া)
পুরো কাজটি চালাতে আমাদের প্রধানত প্রতিদিন ১৫ জনের মতো স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক দরকার, দরকার আর কিছু ছাত্র উপদেষ্টা
নিজের আয় থেকেই টাকা দিয়ে ইনশাল্লাহ আমি সারাজীবন চালিয়েই যাব আমার এই বিদ্যানন্দ (Bidyanondo) স্কুলটা ... কিন্তু, এই মুহূর্তে কিছু ভলান্টিয়ার না হলেই নয়
একটু কি দেখবেন?
আপনার এক লেখনীতে হয়তো এই প্রতিষ্ঠানটির স্বেচ্ছাসেবক সমস্যাটি চিরতরে নাই হয়ে যাবে।
তাই আপনার দ্বারস্থ হলাম। আপনার সাহায্যের অপেক্ষায়।
ইতি
---
... তাকে কি উত্তর দিবো জানি না; বরং আসেন, তাকে উত্তরটা আমরা একসাথেই দেই
কারণ, আমরা প্রত্যেকেই কিন্তু এক একটা মোমবাতি
বাবা মা খরচ করে ম্যাচ কিনে আমাদের মাঝে আলো জ্বালিয়েছে
আমাদের আশেপাশে অনেক সুবিধাবঞ্চিত মোমবাতি আছে, যাদের বাবা-মা’রা হয়তো তাদের জ্বলে উঠার মত শিক্ষাটা দিতে পারছে না
আমি যদি আমার থেকে কিছু আলো, আমার পাশের বাসার সেই সুবিধা বঞ্চিত মোমবাতিটাকে দেই, তাহলে কিন্তু আমার এতটুকুনও ক্ষতি হবে না
হবে কি?
বা, তাতে আমি মোমবাতিটার আলো, কি একটুও কমবে?
লেখক ঃ আরিফ আর হোসাইন
ছোটবেলার প্রতিজ্ঞা থেকেই সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য একটা স্কুল করা ( নিজে ভুক্তভুগি ছিলাম বলেই হয়তো )
বিদেশে কাজ করে যা বেতন পাই, তা থেকেই টুকটুক করে চালাই এই প্রতিষ্ঠান... কারও কাছ থেকে বিন্দু মাত্র টাকা ডোনেশান নেয়নি... যা পেরেছি নিজেই করেছি
আর পারছি না
টাকা না হয় আমি সারাজীবন এই স্কুলের পিছে দিয়েই যাব কিন্তু, এই মুহূর্তে কিছু ভলান্টিয়ার না হলেই নয়
আমি দেশের বাইরে থেকে এটা এতদূর এনেছি ... আমি দেশে থাকলে হয়তো এভাবে আপনাকে বলতাম না
প্লিজ কিছু ভলান্টিয়ার জোগাড় করে দিন
আমাদের শাখা তিনটি- ঢাকা, চট্টগ্রাম আর নারায়ণগঞ্জ ... বর্তমান ছাত্র সংখ্যা ৫০০
আমরা অংক, ইংরেজি এবং বিজ্ঞানের ক্লাস নেই ... এটা কোন পরিপূর্ণ স্কুল না, বরঞ্চ ফ্রি কোচিং সেন্টারের মতোই... যেখানে গরীব ছাত্রদের রুটিন করে মৌলিক জ্ঞানের ভিত্তি করে দেয়া হয়। তাছাড়া, প্রতিমাসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চলচিত্র দেখা, পরিছন্নতা শিক্ষা ... এসব তো আছেই
এছাড়া আছে তিনটি উন্মুক্ত পাঠাগার, যেখানে আছে প্রায় ৮০০০ বই (যে কেউ গিয়ে পড়তে পারে কোনরূপ মেম্বারসিপ ছাড়া)
পুরো কাজটি চালাতে আমাদের প্রধানত প্রতিদিন ১৫ জনের মতো স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক দরকার, দরকার আর কিছু ছাত্র উপদেষ্টা
নিজের আয় থেকেই টাকা দিয়ে ইনশাল্লাহ আমি সারাজীবন চালিয়েই যাব আমার এই বিদ্যানন্দ (Bidyanondo) স্কুলটা ... কিন্তু, এই মুহূর্তে কিছু ভলান্টিয়ার না হলেই নয়
একটু কি দেখবেন?
আপনার এক লেখনীতে হয়তো এই প্রতিষ্ঠানটির স্বেচ্ছাসেবক সমস্যাটি চিরতরে নাই হয়ে যাবে।
তাই আপনার দ্বারস্থ হলাম। আপনার সাহায্যের অপেক্ষায়।
ইতি
---
... তাকে কি উত্তর দিবো জানি না; বরং আসেন, তাকে উত্তরটা আমরা একসাথেই দেই
কারণ, আমরা প্রত্যেকেই কিন্তু এক একটা মোমবাতি
বাবা মা খরচ করে ম্যাচ কিনে আমাদের মাঝে আলো জ্বালিয়েছে
আমাদের আশেপাশে অনেক সুবিধাবঞ্চিত মোমবাতি আছে, যাদের বাবা-মা’রা হয়তো তাদের জ্বলে উঠার মত শিক্ষাটা দিতে পারছে না
আমি যদি আমার থেকে কিছু আলো, আমার পাশের বাসার সেই সুবিধা বঞ্চিত মোমবাতিটাকে দেই, তাহলে কিন্তু আমার এতটুকুনও ক্ষতি হবে না
হবে কি?
বা, তাতে আমি মোমবাতিটার আলো, কি একটুও কমবে?
লেখক ঃ আরিফ আর হোসাইন
বিদ্রোহী
বল বীর-
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারী' আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
বল বীর-
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি'
চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি'
ভূলোক দ্যূলোক গোলোক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির! আমি চিরদুর্দম, দূর্বিনীত, নৃশংস,
মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দূর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!
বল বীর-
চির-উন্নত মম শির! আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি,
আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’।
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দেই তিন দোল্;
আমি চপোলা-চপোল হিন্দোল।
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা!
আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরীত্রির;
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির অধীর।
বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির! আমি চির-দূরন্ত দুর্মদ
আমি দূর্দম মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম্ হ্যায় হর্দম্ ভরপুর্ মদ। আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান। আমি ঈন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য; আমি কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির।
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর-
চির-উন্নত মম শির! আমি সন্ন্যাসী, সুর সৈনিক,
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।
আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কূর্ণিশ।
আমি বজ্র, আমি ঈষাণ-বিষানে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শৃঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশুল, ধর্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র-মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দহন করিব বিশ্ব।
আমি প্রাণ-খোলা হাসি উল্লাস, -আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস
আমি মহাপ্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস!
আমি কভু প্রশান্ত, -কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!
আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,
আমি উজ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল ঊর্মির হিন্দোল-দোল!- আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেনী, তন্বী নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি! আমি উন্মন, মন-উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর।
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয় লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষূব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যাথা সূনিবিড়,
চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর থর থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক’রে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তাঁর কাঁকণ-চুড়ির কন্-কন্।
আমি চির শিশু, চির কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচুলি নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়াছবি!
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ! আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন চিতে চেতন,
আমি বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।
ছুটি ঝড়ের মতন করতালী দিয়া
স্বর্গ মর্ত্য-করতলে,
তাজী বোর্রাক্ আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে! আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রী, বাড়ব বহ্নি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল, অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি তড়িতে চড়িয়া, উড়ে চলি জোড় তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ,
আমি ত্রাস সঞ্চারি’ ভুবনে সহসা, সঞ্চারি ভূমিকম্প। ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’-
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’। আমি দেবশিশু, আমি চঞ্চল,
আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা-সিন্ধু উতলা ঘুম্ঘুম্
ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম
মম বাঁশরীর তানে পাশরি’।
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী। আমি রুষে উঠে যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোযখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া! আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরনীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস ধন্যা-
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!
আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি! আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!! আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার,
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি হল বলরাম স্কন্ধে,
আমি উপাড়ি' ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে। মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি আমি সেই দিন হব শান্ত!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন! আমি চির-বিদ্রোহী বীর -
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!
কবি ঃ কাজী নজরুল ইসলাম
Say, Valiant,
Say: High is my head!
Looking at my head
Is cast down the great Himalayan peak!
Say, Valiant,
Say: Ripping apart the wide sky of the universe,
Leaving behind the moon, the sun, the planets
and the stars
Piercing the earth and the heavens,
Pushing through Almighty's sacred seat
Have I risen,
I, the perennial wonder of mother-earth!
The angry God shines on my forehead
Like some royal victory's gorgeous emblem.
Say, Valiant,
Ever high is my head!
I am irresponsible, cruel and arrogant,
I an the king of the great upheaval,
I am cyclone, I am destruction,
I am the great fear, the curse of the universe.
I have no mercy,
I grind all to pieces.
I am disorderly and lawless,
I trample under my feet all rules and discipline!
I am Durjati, I am the sudden tempest of ultimate summer,
I am the rebel, the rebel-son of mother-earth!
Say, Valiant,
Ever high is my head!
I am the hurricane, I am the cyclone
I destroy all that I found in the path!
I am the dance-intoxicated rhythm,
I dance at my own pleasure,
I am the unfettered joy of life!
I am Hambeer, I am Chhayanata, I am Hindole,
I am ever restless,
I caper and dance as I move!
I do whatever appeals to me, whenever I like,
I embrace the enemy and wrestle with death,
I am mad. I am the tornado!
I am pestilence, the great fear,
I am the death of all reigns of terror,
I am full of a warm restlessness for ever!
Say, Valiant,
Ever high is my head!
I am creation, I am destruction,
I am habitation, I am the grave-yard,
I am the end, the end of night!
I am the son of Indrani
With the moon in my head
And the sun on my temple
In one hand of mine is the tender flute
While in the other I hold the war bugle!
I am the Bedouin, I am the Chengis,
I salute none but me!
I am thunder,
I am Brahma's sound in the sky and on the earth,
I am the mighty roar of Israfil's bugle,
I am the great trident of Pinakpani,
I am the staff of the king of truth,
I am the Chakra and the great Shanka,
I am the mighty primordial shout!
I am Bishyamitra's pupil, Durbasha the furious,
I am the fury of the wild fire,
I burn to ashes this universe!
I am the gay laughter of the generous heart,
I am the enemy of creation, the mighty terror!
I am the eclipse of the twelve suns,
I herald the final destruction!
Sometimes I am quiet and serene,
I am in a frenzy at other times,
I am the new youth of dawn,
I crush under my feet the vain glory of the Almighty!
I am the fury of typhoon,
I am the tumultuous roar of the ocean,
I am ever effluent and bright,
I trippingly flow like the gaily warbling brook.
I am the maiden's dark glassy hair,
I am the spark of fire in her blazing eyes.
I am the tender love that lies
In the sixteen year old's heart,
I am the happy beyond measure!
I am the pining soul of the lovesick,
I am the bitter tears in the widow's heart,
i am the piteous sighs of the unlucky!
I am the pain and sorrow of all homeless sufferers,
i am the anguish of the insulted heart,
I am the burning pain and the madness of the jilted lover!
I am the unutterable grief,
I am the trembling first touch of the virgin,
I am the throbbing tenderness of her first stolen kiss.
I am the fleeting glace of the veiled beloved,
I am her constant surreptitious gaze.
I am the gay gripping young girl's love,
I am the jingling music of her bangles!
I am the eternal-child, the adolescent of all times,
I am the shy village maiden frightened by her own budding youth.
I am the soothing breeze of the south,
I am the pensive gale of the east.
I am the deep solemn song sung by the wondering bard,
I am the soft music played on his lyre!
I am the harsh unquenched mid-day thirst,
I am the fierce blazing sun,
I am the softly trilling desert spring,
I am the cool shadowy greenery!
Maddened with an intense joy I rush onward,
I am insane! I am insane!
Suddenly I have come to know myself,
All the false barriers have crumbled today!
I am the rising, I am the fall,
I am consciousness in the unconscious soul,
I am the flag of triumph at the gate of the world,
I am the glorious sign of man's victory,
Clapping my hands in exultation I rush like the hurricane,
Traversing the earth and the sky.
The mighty Borrak is the horse I ride.
It neighs impatiently, drunk with delight!
I am the burning volcano in the bosom of the earth,
I am the wild fire of the woods,
I am Hell's mad terrific sea of wrath!
I ride on the wings of the lightning with joy and profound,
I scatter misery and fear all around,
I bring earth-quakes on this world!
I am Orpheus's flute,
I bring sleep to the fevered world,
I make the heaving hells temple in fear and die.
I carry the message of revolt to the earth and the sky!
I am the mighty flood,
Sometimes I make the earth rich and fertile,
At another times I cause colossal damage.
I snatch from Bishnu's bosom the two girls!
I am injustice, I am the shooting star,
I am Saturn, I am the fire of the comet,
I am the poisonous asp!
I am Chandi the headless, I am ruinous Warlord,
Sitting in the burning pit of Hell
I smile as the innocent flower!
I am the cruel axe of Parsurama,
I shall kill warriors
And bring peace and harmony in the universe!
I am the plough on the shoulders of Balarama,
I shall uproot this miserable earth effortlessly and with ease,
And create a new universe of joy and peace.
Weary of struggles, I, the great rebel,
Shall rest in quiet only when I find
The sky and the air free of the piteous groans of the oppressed.
Only when the battle fields are cleared of jingling bloody sabres
Shall I, weary of struggles, rest in quiet,
I the great rebel.
I am the rebel eternal,
I raise my head beyond this world,
High, ever erect and alone!
Poet : Kazi Nazrul Islam
Translation: Kabir Chowdhury
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারী' আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
বল বীর-
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি'
চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি'
ভূলোক দ্যূলোক গোলোক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির! আমি চিরদুর্দম, দূর্বিনীত, নৃশংস,
মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দূর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!
বল বীর-
চির-উন্নত মম শির! আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি,
আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’।
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দেই তিন দোল্;
আমি চপোলা-চপোল হিন্দোল।
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা!
আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরীত্রির;
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির অধীর।
বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির! আমি চির-দূরন্ত দুর্মদ
আমি দূর্দম মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম্ হ্যায় হর্দম্ ভরপুর্ মদ। আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান। আমি ঈন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য; আমি কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির।
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর-
চির-উন্নত মম শির! আমি সন্ন্যাসী, সুর সৈনিক,
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।
আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কূর্ণিশ।
আমি বজ্র, আমি ঈষাণ-বিষানে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শৃঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশুল, ধর্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র-মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দহন করিব বিশ্ব।
আমি প্রাণ-খোলা হাসি উল্লাস, -আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস
আমি মহাপ্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস!
আমি কভু প্রশান্ত, -কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!
আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,
আমি উজ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল ঊর্মির হিন্দোল-দোল!- আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেনী, তন্বী নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি! আমি উন্মন, মন-উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর।
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয় লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষূব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যাথা সূনিবিড়,
চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর থর থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক’রে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তাঁর কাঁকণ-চুড়ির কন্-কন্।
আমি চির শিশু, চির কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচুলি নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়াছবি!
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ! আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন চিতে চেতন,
আমি বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।
ছুটি ঝড়ের মতন করতালী দিয়া
স্বর্গ মর্ত্য-করতলে,
তাজী বোর্রাক্ আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে! আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রী, বাড়ব বহ্নি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল, অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি তড়িতে চড়িয়া, উড়ে চলি জোড় তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ,
আমি ত্রাস সঞ্চারি’ ভুবনে সহসা, সঞ্চারি ভূমিকম্প। ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’-
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’। আমি দেবশিশু, আমি চঞ্চল,
আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা-সিন্ধু উতলা ঘুম্ঘুম্
ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম
মম বাঁশরীর তানে পাশরি’।
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী। আমি রুষে উঠে যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোযখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া! আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরনীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস ধন্যা-
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!
আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি! আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!! আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার,
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি হল বলরাম স্কন্ধে,
আমি উপাড়ি' ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে। মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি আমি সেই দিন হব শান্ত!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন! আমি চির-বিদ্রোহী বীর -
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!
কবি ঃ কাজী নজরুল ইসলাম
The Rebel
Say, Valiant,
Say: High is my head!
Looking at my head
Is cast down the great Himalayan peak!
Say, Valiant,
Say: Ripping apart the wide sky of the universe,
Leaving behind the moon, the sun, the planets
and the stars
Piercing the earth and the heavens,
Pushing through Almighty's sacred seat
Have I risen,
I, the perennial wonder of mother-earth!
The angry God shines on my forehead
Like some royal victory's gorgeous emblem.
Say, Valiant,
Ever high is my head!
I am irresponsible, cruel and arrogant,
I an the king of the great upheaval,
I am cyclone, I am destruction,
I am the great fear, the curse of the universe.
I have no mercy,
I grind all to pieces.
I am disorderly and lawless,
I trample under my feet all rules and discipline!
I am Durjati, I am the sudden tempest of ultimate summer,
I am the rebel, the rebel-son of mother-earth!
Say, Valiant,
Ever high is my head!
I am the hurricane, I am the cyclone
I destroy all that I found in the path!
I am the dance-intoxicated rhythm,
I dance at my own pleasure,
I am the unfettered joy of life!
I am Hambeer, I am Chhayanata, I am Hindole,
I am ever restless,
I caper and dance as I move!
I do whatever appeals to me, whenever I like,
I embrace the enemy and wrestle with death,
I am mad. I am the tornado!
I am pestilence, the great fear,
I am the death of all reigns of terror,
I am full of a warm restlessness for ever!
Say, Valiant,
Ever high is my head!
I am creation, I am destruction,
I am habitation, I am the grave-yard,
I am the end, the end of night!
I am the son of Indrani
With the moon in my head
And the sun on my temple
In one hand of mine is the tender flute
While in the other I hold the war bugle!
I am the Bedouin, I am the Chengis,
I salute none but me!
I am thunder,
I am Brahma's sound in the sky and on the earth,
I am the mighty roar of Israfil's bugle,
I am the great trident of Pinakpani,
I am the staff of the king of truth,
I am the Chakra and the great Shanka,
I am the mighty primordial shout!
I am Bishyamitra's pupil, Durbasha the furious,
I am the fury of the wild fire,
I burn to ashes this universe!
I am the gay laughter of the generous heart,
I am the enemy of creation, the mighty terror!
I am the eclipse of the twelve suns,
I herald the final destruction!
Sometimes I am quiet and serene,
I am in a frenzy at other times,
I am the new youth of dawn,
I crush under my feet the vain glory of the Almighty!
I am the fury of typhoon,
I am the tumultuous roar of the ocean,
I am ever effluent and bright,
I trippingly flow like the gaily warbling brook.
I am the maiden's dark glassy hair,
I am the spark of fire in her blazing eyes.
I am the tender love that lies
In the sixteen year old's heart,
I am the happy beyond measure!
I am the pining soul of the lovesick,
I am the bitter tears in the widow's heart,
i am the piteous sighs of the unlucky!
I am the pain and sorrow of all homeless sufferers,
i am the anguish of the insulted heart,
I am the burning pain and the madness of the jilted lover!
I am the unutterable grief,
I am the trembling first touch of the virgin,
I am the throbbing tenderness of her first stolen kiss.
I am the fleeting glace of the veiled beloved,
I am her constant surreptitious gaze.
I am the gay gripping young girl's love,
I am the jingling music of her bangles!
I am the eternal-child, the adolescent of all times,
I am the shy village maiden frightened by her own budding youth.
I am the soothing breeze of the south,
I am the pensive gale of the east.
I am the deep solemn song sung by the wondering bard,
I am the soft music played on his lyre!
I am the harsh unquenched mid-day thirst,
I am the fierce blazing sun,
I am the softly trilling desert spring,
I am the cool shadowy greenery!
Maddened with an intense joy I rush onward,
I am insane! I am insane!
Suddenly I have come to know myself,
All the false barriers have crumbled today!
I am the rising, I am the fall,
I am consciousness in the unconscious soul,
I am the flag of triumph at the gate of the world,
I am the glorious sign of man's victory,
Clapping my hands in exultation I rush like the hurricane,
Traversing the earth and the sky.
The mighty Borrak is the horse I ride.
It neighs impatiently, drunk with delight!
I am the burning volcano in the bosom of the earth,
I am the wild fire of the woods,
I am Hell's mad terrific sea of wrath!
I ride on the wings of the lightning with joy and profound,
I scatter misery and fear all around,
I bring earth-quakes on this world!
I am Orpheus's flute,
I bring sleep to the fevered world,
I make the heaving hells temple in fear and die.
I carry the message of revolt to the earth and the sky!
I am the mighty flood,
Sometimes I make the earth rich and fertile,
At another times I cause colossal damage.
I snatch from Bishnu's bosom the two girls!
I am injustice, I am the shooting star,
I am Saturn, I am the fire of the comet,
I am the poisonous asp!
I am Chandi the headless, I am ruinous Warlord,
Sitting in the burning pit of Hell
I smile as the innocent flower!
I am the cruel axe of Parsurama,
I shall kill warriors
And bring peace and harmony in the universe!
I am the plough on the shoulders of Balarama,
I shall uproot this miserable earth effortlessly and with ease,
And create a new universe of joy and peace.
Weary of struggles, I, the great rebel,
Shall rest in quiet only when I find
The sky and the air free of the piteous groans of the oppressed.
Only when the battle fields are cleared of jingling bloody sabres
Shall I, weary of struggles, rest in quiet,
I the great rebel.
I am the rebel eternal,
I raise my head beyond this world,
High, ever erect and alone!
Poet : Kazi Nazrul Islam
Translation: Kabir Chowdhury
বাংলাভাষা পরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯)
ক্রিয়াপদে দু রকমের অনুজ্ঞা আছে। এক, উপস্থিত ব্যক্তিকে অনুরোধ বা আদেশ করা। আর, উপস্থিত বা অনুপস্থিত কারও সম্বন্ধে ইচ্ছা প্রকাশ করা, যেমন : "ও করুক'।
হোক যাক চলুক বা করুক প্রভৃতি শব্দগুলিতে ক প্রত্যয় পুরোনো ভাষায় সর্বত্র প্রচলিত ছিল না, যথা : জাউ, মন্দ পবন বহু, উদিত হউ চন্দা, মউরগণ নাদ করু।
পূর্বেই বলেছি বাংলা ভাষার প্রধান লক্ষণ, তার ভঙ্গীর প্রাবল্য। উপরোক্ত শ্রেণীর ক্রিয়াপদে একটা অনর্থক গে শব্দের যোগে যে ইঙ্গিত প্রকাশ করা হয় সেটা সহজ শব্দের দ্বারা হয় না, যথা : হোকগে করুকগে মরুকগে। এতে ঔদাসীন্যে ও ক্ষোভে জড়িয়ে যে ভাবটা ব্যক্ত করে সেটা অন্য ভাষায় সহজে বলা যায় না। কেননা গে শব্দের কোনো অর্থ নেই, ওটা একটা মুদ্রা। "হোকগে' শব্দের ইংরেজি তর্জমা করতে হলে বলতে হয় : Let it happen, I don't care। ওর সঙ্গে "তুমিও যেমন' যদি যোগ করা যায় তা হলে ভঙ্গিমা আরও প্রবল হয়ে ওঠে। ইংরেজি বাক্যে হয়তো এর কাছাকাছি যায় : Oh let it be, don't bother। মোটের উপর এই শব্দভঙ্গীর ভাবখানা এই যে, যা হচ্ছে বা করা হচ্ছে সেটা ভালো নয়, সেটা ক্ষতিকর, বা অপ্রিয়, কিন্তু তবু ওটাকে গ্রাহ্য করার দরকার নেই। "মরুকগে' শব্দে এই ভাষাভঙ্গী খুবই স্পষ্ট হয়েছে। এই ছোট্ট বাংলা শব্দটির ইংরেজি প্রতিবাক্য : Hang it, let it go to the dogs।
ইংরেজিতে সাধারণ ব্যবহারের ক্রিয়াপদ অনুজ্ঞায় প্রায়ই এক মাত্রার হয়, যেমন, run stop cut beat shoot march hold throw। যেখানে যুগ্ম ক্রিয়াপদ ব্যবহার হয় সেখানে এক মাত্রার দুটি শব্দ জোড়া লাগে, যেমন : come in, go out, cut down, stand up, run on ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এইরূপ সংক্ষিপ্ত শব্দে আজ্ঞার জোর পৌঁছয়। স্কাউটের বা ফৌজের কুচকাওয়াজে ইংরেজিতে যে-সব আদেশবাক্য আছে এই কারণে সেগুলো জোরালো হয়। যে-সকল শব্দ ব্যঞ্জনবর্ণে শেষ হয় তারা ধাক্কা দেয় জোরে। stand upশব্দ উভয়ে মিলে দুই মাত্রার বটে কিন্তু তাতে দুই ব্যঞ্জনবর্ণের দুটো ঠোকর আছে।
"দাঁড়াও' শব্দটাও দুই মাত্রার, কিন্তু তার আগাগোড়া স্বরবর্ণ, তাদের স্পর্শ মোলায়েম। কথাটা ধাঁ করে ছোটে না।
"তুই' "তোরা' বর্গের অনুজ্ঞায় এই দুর্বলতা নেই! বোস্ ওঠ্ ছোট্ থাম্ কাট্ মার্ ধর্ খেল্ : এগুলি দৌড়দার শব্দ। আদিকালে ভাষায় "তু' "তুই' ছিল একমাত্র মধ্যম-পুরুষের সর্বনাম শব্দ। সেটা যদি চলে আসত তা হলে ক্রিয়াপদকে স্বরবর্ণ এমন নরম করে রাখত না, হসন্ত ব্যঞ্জনবর্ণে তাকে তীক্ষ্ণতা দিত। "করো' হ'ত "কর্'। "কোরো' হ'ত "করিস'। "দাঁড়া' শব্দ যদিও স্বরবর্ণ বহন করে তবু "দাঁড়াও' শব্দের চেয়ে তার মধ্যে প্রভুশক্তি বেশি। "ঘুমো' আর "ঘুমোও' তুলনা করলে অনুজ্ঞার দিক থেকে প্রথমোক্তটির প্রবলতা মানতে হয়।
চলতি বাংলা ভঙ্গীপ্রধান ভাষা, তার একটা লক্ষণ ক্রিয়াপদের অনুজ্ঞায় অসংগত ভাবে "না' শব্দের ব্যবহার। এর কাজ হচ্ছে আদেশ বা অনুরোধকে অনুনয়ে নরম করে আনা।
"হোক না' "করোই না' ক্রিয়াপদে "না' শব্দে নির্বন্ধ প্রকাশ পায়, কোনো-এক পক্ষের অনিচ্ছাকে যেন ঠেলে দেওয়া। "না' শব্দের দ্বারা "হাঁ' প্রকাশ করা আর প্রথমপুরুষ-বাচক "আপনি'কে মধ্যমপুরুষের অর্থে ব্যবহার একই মনস্তত্ত্বমূলক। যিনি উপস্থিত আছেন যেন তিনি উপস্থিত নেই, তাঁর সঙ্গে মোকাবিলায় কথা বলার স্পর্ধা বক্তার পক্ষে সম্ভব নয়, এই ভাণের দ্বারাই তাঁর উপস্থিতির মূল্য যায় বেড়ে। তেমনি অনুরোধ জানানোর পরক্ষণেই "না' বলে তার প্রতিবাদ ক'রে অনুরোধের মধ্যে সম্মানের কাকুতি এনে দেওয়া হয়। "না' শব্দের ক্রিয়াপদের রূপ বাংলা ভাষার আর-একটি বিশেষত্ব, যথা : আমি নই, তুমি নও, সে নয়, তিনি নন, আমি নেই, তুমি নেই, সে নেই, তিনি নেই; হই নে, হও না, হয় না, হন না, হয় নি, হন নি।
বাংলা ক্রিয়াপদে নানারকম শব্দ-যোজনায় নানারকম ভঙ্গী। তার কতকগুলি সার্থক, কতকগুলি নিরর্থক। ক্রিয়াপদে এতরকম ইশারা বোধ হয় আর-কোনো ভাষায় নেই।
পড়ল বা, করলে বা, শব্দে আশঙ্কার সূচনা। কোনো ক্রিয়াবিশেষণ-যোগে এর ভাবটা প্রকাশ হতে পারত না।
এতে যদি ইকার যোগ করা যায় তাতে আর-একরকম ভঙ্গী এসে পড়ে। হলই বা, করলই বা : এর ভঙ্গীতে সুরের বৈচিত্র্য অনুসারে ক্ষমাও বোঝাতে পারে, স্পর্ধাও বোঝাতে পারে, উপেক্ষাও বোঝাতে পারে।
হল বুঝি, করল বুঝি, হল ব'লে, করল ব'লে : আসন্ন অপ্রিয়তার আশঙ্কা।
হল যে, করল যে : উদ্বেগ।
হল তো, করলে তো : অপ্রত্যাশিতের সম্বন্ধে বিস্ময়।
আবার ওকেই প্রশ্নের সুরে বদলিয়ে যদি বলা হয় "হল তো?' তা হলে জানানো হয় : এখন তো আর কোনো নালিশ রইল না?
হোক না, করুক না, হোক্গে, করুক্গে, মরুক্গে : ঔদাসীন্য।
হলই বা, করলই বা, নাই বা হল, নাহয় হল : স্পর্ধার ভাষা।
হবে বা, হবেও বা : দ্বিধা এবং স্বীকার মিশিয়ে।
হবেই হবে, করবেই করবে : সুনিশ্চিত প্রত্যাশা।
করতেই হবে, হতেই হবে, করাই চাই, হওয়াই চাই : ইচ্ছার জোর প্রয়োগ।
হলেই হল : অর্থাৎ হয় যদি তবে আর-কোনো তর্কের দরকার নেই।
হোকগে ছাই, মরুকগে ছাই : প্রবল ঔদাস্য।
৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন
হোক যাক চলুক বা করুক প্রভৃতি শব্দগুলিতে ক প্রত্যয় পুরোনো ভাষায় সর্বত্র প্রচলিত ছিল না, যথা : জাউ, মন্দ পবন বহু, উদিত হউ চন্দা, মউরগণ নাদ করু।
পূর্বেই বলেছি বাংলা ভাষার প্রধান লক্ষণ, তার ভঙ্গীর প্রাবল্য। উপরোক্ত শ্রেণীর ক্রিয়াপদে একটা অনর্থক গে শব্দের যোগে যে ইঙ্গিত প্রকাশ করা হয় সেটা সহজ শব্দের দ্বারা হয় না, যথা : হোকগে করুকগে মরুকগে। এতে ঔদাসীন্যে ও ক্ষোভে জড়িয়ে যে ভাবটা ব্যক্ত করে সেটা অন্য ভাষায় সহজে বলা যায় না। কেননা গে শব্দের কোনো অর্থ নেই, ওটা একটা মুদ্রা। "হোকগে' শব্দের ইংরেজি তর্জমা করতে হলে বলতে হয় : Let it happen, I don't care। ওর সঙ্গে "তুমিও যেমন' যদি যোগ করা যায় তা হলে ভঙ্গিমা আরও প্রবল হয়ে ওঠে। ইংরেজি বাক্যে হয়তো এর কাছাকাছি যায় : Oh let it be, don't bother। মোটের উপর এই শব্দভঙ্গীর ভাবখানা এই যে, যা হচ্ছে বা করা হচ্ছে সেটা ভালো নয়, সেটা ক্ষতিকর, বা অপ্রিয়, কিন্তু তবু ওটাকে গ্রাহ্য করার দরকার নেই। "মরুকগে' শব্দে এই ভাষাভঙ্গী খুবই স্পষ্ট হয়েছে। এই ছোট্ট বাংলা শব্দটির ইংরেজি প্রতিবাক্য : Hang it, let it go to the dogs।
ইংরেজিতে সাধারণ ব্যবহারের ক্রিয়াপদ অনুজ্ঞায় প্রায়ই এক মাত্রার হয়, যেমন, run stop cut beat shoot march hold throw। যেখানে যুগ্ম ক্রিয়াপদ ব্যবহার হয় সেখানে এক মাত্রার দুটি শব্দ জোড়া লাগে, যেমন : come in, go out, cut down, stand up, run on ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এইরূপ সংক্ষিপ্ত শব্দে আজ্ঞার জোর পৌঁছয়। স্কাউটের বা ফৌজের কুচকাওয়াজে ইংরেজিতে যে-সব আদেশবাক্য আছে এই কারণে সেগুলো জোরালো হয়। যে-সকল শব্দ ব্যঞ্জনবর্ণে শেষ হয় তারা ধাক্কা দেয় জোরে। stand upশব্দ উভয়ে মিলে দুই মাত্রার বটে কিন্তু তাতে দুই ব্যঞ্জনবর্ণের দুটো ঠোকর আছে।
"দাঁড়াও' শব্দটাও দুই মাত্রার, কিন্তু তার আগাগোড়া স্বরবর্ণ, তাদের স্পর্শ মোলায়েম। কথাটা ধাঁ করে ছোটে না।
"তুই' "তোরা' বর্গের অনুজ্ঞায় এই দুর্বলতা নেই! বোস্ ওঠ্ ছোট্ থাম্ কাট্ মার্ ধর্ খেল্ : এগুলি দৌড়দার শব্দ। আদিকালে ভাষায় "তু' "তুই' ছিল একমাত্র মধ্যম-পুরুষের সর্বনাম শব্দ। সেটা যদি চলে আসত তা হলে ক্রিয়াপদকে স্বরবর্ণ এমন নরম করে রাখত না, হসন্ত ব্যঞ্জনবর্ণে তাকে তীক্ষ্ণতা দিত। "করো' হ'ত "কর্'। "কোরো' হ'ত "করিস'। "দাঁড়া' শব্দ যদিও স্বরবর্ণ বহন করে তবু "দাঁড়াও' শব্দের চেয়ে তার মধ্যে প্রভুশক্তি বেশি। "ঘুমো' আর "ঘুমোও' তুলনা করলে অনুজ্ঞার দিক থেকে প্রথমোক্তটির প্রবলতা মানতে হয়।
চলতি বাংলা ভঙ্গীপ্রধান ভাষা, তার একটা লক্ষণ ক্রিয়াপদের অনুজ্ঞায় অসংগত ভাবে "না' শব্দের ব্যবহার। এর কাজ হচ্ছে আদেশ বা অনুরোধকে অনুনয়ে নরম করে আনা।
"হোক না' "করোই না' ক্রিয়াপদে "না' শব্দে নির্বন্ধ প্রকাশ পায়, কোনো-এক পক্ষের অনিচ্ছাকে যেন ঠেলে দেওয়া। "না' শব্দের দ্বারা "হাঁ' প্রকাশ করা আর প্রথমপুরুষ-বাচক "আপনি'কে মধ্যমপুরুষের অর্থে ব্যবহার একই মনস্তত্ত্বমূলক। যিনি উপস্থিত আছেন যেন তিনি উপস্থিত নেই, তাঁর সঙ্গে মোকাবিলায় কথা বলার স্পর্ধা বক্তার পক্ষে সম্ভব নয়, এই ভাণের দ্বারাই তাঁর উপস্থিতির মূল্য যায় বেড়ে। তেমনি অনুরোধ জানানোর পরক্ষণেই "না' বলে তার প্রতিবাদ ক'রে অনুরোধের মধ্যে সম্মানের কাকুতি এনে দেওয়া হয়। "না' শব্দের ক্রিয়াপদের রূপ বাংলা ভাষার আর-একটি বিশেষত্ব, যথা : আমি নই, তুমি নও, সে নয়, তিনি নন, আমি নেই, তুমি নেই, সে নেই, তিনি নেই; হই নে, হও না, হয় না, হন না, হয় নি, হন নি।
বাংলা ক্রিয়াপদে নানারকম শব্দ-যোজনায় নানারকম ভঙ্গী। তার কতকগুলি সার্থক, কতকগুলি নিরর্থক। ক্রিয়াপদে এতরকম ইশারা বোধ হয় আর-কোনো ভাষায় নেই।
পড়ল বা, করলে বা, শব্দে আশঙ্কার সূচনা। কোনো ক্রিয়াবিশেষণ-যোগে এর ভাবটা প্রকাশ হতে পারত না।
এতে যদি ইকার যোগ করা যায় তাতে আর-একরকম ভঙ্গী এসে পড়ে। হলই বা, করলই বা : এর ভঙ্গীতে সুরের বৈচিত্র্য অনুসারে ক্ষমাও বোঝাতে পারে, স্পর্ধাও বোঝাতে পারে, উপেক্ষাও বোঝাতে পারে।
হল বুঝি, করল বুঝি, হল ব'লে, করল ব'লে : আসন্ন অপ্রিয়তার আশঙ্কা।
হল যে, করল যে : উদ্বেগ।
হল তো, করলে তো : অপ্রত্যাশিতের সম্বন্ধে বিস্ময়।
আবার ওকেই প্রশ্নের সুরে বদলিয়ে যদি বলা হয় "হল তো?' তা হলে জানানো হয় : এখন তো আর কোনো নালিশ রইল না?
হোক না, করুক না, হোক্গে, করুক্গে, মরুক্গে : ঔদাসীন্য।
হলই বা, করলই বা, নাই বা হল, নাহয় হল : স্পর্ধার ভাষা।
হবে বা, হবেও বা : দ্বিধা এবং স্বীকার মিশিয়ে।
হবেই হবে, করবেই করবে : সুনিশ্চিত প্রত্যাশা।
করতেই হবে, হতেই হবে, করাই চাই, হওয়াই চাই : ইচ্ছার জোর প্রয়োগ।
হলেই হল : অর্থাৎ হয় যদি তবে আর-কোনো তর্কের দরকার নেই।
হোকগে ছাই, মরুকগে ছাই : প্রবল ঔদাস্য।
৭ কার্তিক, ১৩৪৫ শান্তিনিকেতন
Bangladesh Liberation War-01
A thirteen minutes long documentary by the Liberation War, describing the havoc of 1971 war. The War For Bangladeshi Independence, 1971 ...
একদা
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের কথা।
আমার এক বন্ধুর দাদা গেছে মাঠে। হাওয়া খেতে না। সেই সময় প্লাস্টিকের বদনা এবং ল্যাট্রিন কোনটাই ছিল না। এইজন্য তিনি পিতলের বদনা নিয়ে মাঠে গেছেন ''কাজ'' সারতে।
গ্রামটা সুন্দরবনের পাশে। হঠাৎ বাথরুম করার প্রাক্কালে তিনি দেখলেন, কাছকাছি একটা বাঘ উকিঁঝুকি মারছে। এই অবস্থায় পৃথিবীর যেকোনো মানুষ জ্ঞান হারিয়ে লাট খেয়ে পড়ে যেতো।
আমার বন্ধুর দাদা ভীষণ বিরক্ত হলেন। এই রকম একান্ত একটা ব্যক্তিগত সময়ে বাঘের উপস্থিতি তার মোটেও সহ্য হলো না। ক্রোধের চোটে তিনি বদনা ছুড়ে মারলেন বাঘের দিকে। নিখুঁত নিশানা। পিতলের বদনা গিয়ে লাগলো বাঘের মাথায়। ঘটনাস্থলেই বাঘের তাৎক্ষণিক মৃত্যু। পত্রিকার ভাষায়, গুরুতর আঘাতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে বাঘের অকাল মৃত্যু।
এই সত্যি গল্প কিনা, জানি না। তবে এটা ঠিক, বাঙালি বাঘ ভয় পায় না। বাঙালি সাপ ভয় পায় না। ঝড়, জলোচ্ছাস, পুলিশের টিয়ার গ্যাস, বোমা, হরতাল কোনো কিছুকেই বাঙালি তেমন ভয় পায় না। যতখানি ভয় পায় অংক, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ইংরেজি ইত্যাদি সাবজেক্টকে।
আমাদের সময়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় অংকের প্রশ্ন দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলা ছিল নিয়মিত ঘটনা।
এর কারণ, আমাদের অধিকাংশ শিক্ষকরা অংক, বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোকে সহজে উপস্থাপন করতে পারেননি। ফলে শৈশবেই এইসব বিষয় নিয়ে আমাদের ভীতি ঢুকে গেছে।
তাই অংক পরীক্ষার দিন আমাদের জ্বর আসে। ফিজিক্স পরীক্ষার আগের রাতে আমাদের পেট নেমে যায়।
এর মধ্যে একটা মজার ভিডিও পেলাম। ''স্কুল অব এক্সসেলেন্স'' নামে একটা অনলাইন স্কুল খোলা হয়েছে। যাদের টার্গেট হচ্ছে কমেডির মাধ্যমে অংক এবং বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলোকে তুলে ধরা।
তাদের ওয়েবসাইটে চমক হাসানের ''চমক জাগানিয়া'' একটা ভিডিও দেখলাম। গণিতের শূণ্য বিষয়টা এত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন, বলার বাইরে। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরবে। হাসি শেষ মনে হবে, আহ, অংক বিষয়টা এতো সহজ!!!!
আহা, শৈশবে কেন চমক হাসানকে পেলাম না।
তাহলে আমি অংক শিখে অ্যারোনোটিকাল ইনজিনিয়ার হতে পারতাম। আমার বাড়ি থাকতো, গাড়ি থাকতো, সুন্দরী বউ থাকতো। বসে বসে সুন্দরী মেয়েদের ছবি দেখে দীর্ঘশ্বাস লুকাতে হতো না।
হায় আপসোস, বিরাট আপসোস।
লেখক ঃ আসিফ ইনতায রাবি
আমার এক বন্ধুর দাদা গেছে মাঠে। হাওয়া খেতে না। সেই সময় প্লাস্টিকের বদনা এবং ল্যাট্রিন কোনটাই ছিল না। এইজন্য তিনি পিতলের বদনা নিয়ে মাঠে গেছেন ''কাজ'' সারতে।
গ্রামটা সুন্দরবনের পাশে। হঠাৎ বাথরুম করার প্রাক্কালে তিনি দেখলেন, কাছকাছি একটা বাঘ উকিঁঝুকি মারছে। এই অবস্থায় পৃথিবীর যেকোনো মানুষ জ্ঞান হারিয়ে লাট খেয়ে পড়ে যেতো।
আমার বন্ধুর দাদা ভীষণ বিরক্ত হলেন। এই রকম একান্ত একটা ব্যক্তিগত সময়ে বাঘের উপস্থিতি তার মোটেও সহ্য হলো না। ক্রোধের চোটে তিনি বদনা ছুড়ে মারলেন বাঘের দিকে। নিখুঁত নিশানা। পিতলের বদনা গিয়ে লাগলো বাঘের মাথায়। ঘটনাস্থলেই বাঘের তাৎক্ষণিক মৃত্যু। পত্রিকার ভাষায়, গুরুতর আঘাতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে বাঘের অকাল মৃত্যু।
এই সত্যি গল্প কিনা, জানি না। তবে এটা ঠিক, বাঙালি বাঘ ভয় পায় না। বাঙালি সাপ ভয় পায় না। ঝড়, জলোচ্ছাস, পুলিশের টিয়ার গ্যাস, বোমা, হরতাল কোনো কিছুকেই বাঙালি তেমন ভয় পায় না। যতখানি ভয় পায় অংক, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ইংরেজি ইত্যাদি সাবজেক্টকে।
আমাদের সময়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় অংকের প্রশ্ন দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলা ছিল নিয়মিত ঘটনা।
এর কারণ, আমাদের অধিকাংশ শিক্ষকরা অংক, বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোকে সহজে উপস্থাপন করতে পারেননি। ফলে শৈশবেই এইসব বিষয় নিয়ে আমাদের ভীতি ঢুকে গেছে।
তাই অংক পরীক্ষার দিন আমাদের জ্বর আসে। ফিজিক্স পরীক্ষার আগের রাতে আমাদের পেট নেমে যায়।
এর মধ্যে একটা মজার ভিডিও পেলাম। ''স্কুল অব এক্সসেলেন্স'' নামে একটা অনলাইন স্কুল খোলা হয়েছে। যাদের টার্গেট হচ্ছে কমেডির মাধ্যমে অংক এবং বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলোকে তুলে ধরা।
তাদের ওয়েবসাইটে চমক হাসানের ''চমক জাগানিয়া'' একটা ভিডিও দেখলাম। গণিতের শূণ্য বিষয়টা এত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন, বলার বাইরে। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরবে। হাসি শেষ মনে হবে, আহ, অংক বিষয়টা এতো সহজ!!!!
আহা, শৈশবে কেন চমক হাসানকে পেলাম না।
তাহলে আমি অংক শিখে অ্যারোনোটিকাল ইনজিনিয়ার হতে পারতাম। আমার বাড়ি থাকতো, গাড়ি থাকতো, সুন্দরী বউ থাকতো। বসে বসে সুন্দরী মেয়েদের ছবি দেখে দীর্ঘশ্বাস লুকাতে হতো না।
হায় আপসোস, বিরাট আপসোস।
লেখক ঃ আসিফ ইনতায রাবি
Subscribe to:
Posts (Atom)